আমাদের দেশের লোকসংগীতের যে ভাণ্ডার রয়েছে, তা এক ঐশ্বর্য ভাণ্ডার৷ প্রতিটা অঞ্চল ভেদে গান রয়েছে আমাদের৷ কিন্তু আমাদের তরুণ প্রজন্ম লালনের গান ছাড়া অন্য লোকগান সম্পর্কে কতটা জানে? এ দায় কি তাদের? নাকি এ আমাদের ব্যর্থতা?
আমার জন্ম আশির দশকে৷ এই সময়টাতে শহুরে মানুষের কাছে বিনোদন ছিল রেডিও এবং টেলিভিশন, তাও সেসময় ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না৷ থাকলেও দেখা যেত বাংলাদেশ টেলিভিশন চ্যানেল৷ আর ঐ একটি চ্যানেল এবং বাংলাদেশ বেতারের সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগানের সঙ্গে আমাদের প্রজন্মের পরিচয়৷ সে সময়ই আমরা জেনেছি ভাটি অঞ্চলের গান ভাটিয়ালি, অর্থাৎ মাঝি মাল্লাদের গান – ‘কল কল ছল ছল নদী করে টলমল ঢেউ হানে ঝড় তুফানেতে…., আবার রংপুর অঞ্চলের গান ভাওয়াইয়া, আছে জারি, সারি, মুর্শিদি, লালন, বাউল, পালা গান বা মৈমনসিংহ গীতিকা, গম্ভীরা, কবিগানের কথা৷
স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতায় গাওয়া হত এ সব গান৷ জারি বা সারি গানের আলাদা প্রতিযোগিতা ছিল৷ এছাড়া লোকসংগীত বিভাগে বাকি গানগুলো গাওয়া হত৷ আমাদের লোকগানের এই যে বিপুল সম্ভার এগুলো সম্পর্কে তখনই ধারণা হয়েছিল আমাদের৷ লোকের মুখে মুখে গান থেকেই তো লোকগান৷ এর অন্যতম প্রধান বাউল গান, বাউল শিল্পীরা মুখে মুখেই গান বাঁধতেন৷ বাউল সংগীতের মধ্যে অনন্য হলো লালনগীতি৷ বাউল গান যদিও গ্রামীন কথ্য ভাষায় গীত হত, কিন্তু এর পরতে পরতে যেন গভীর তত্ত্বজ্ঞান লুকিয়ে আছে৷ লালন ফকিরের বাউল গানের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ৷ বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক৷ তারা মানবতার বাণী প্রচার করেন৷ বাউল সাধকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে লালন সাঁই৷ সাঁইজি তাঁর গানের মাধ্যমে বাউল মতের দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছিলেন৷
আর অন্যান্য লোকগানের মধ্যে বাউল গানই আজ বর্তমান প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ কিন্তু এর কারণ কেবল গানের কথা নয়, ভিন্নভাবে একে উপস্থাপন৷ অর্থাৎ ব্যান্ড সংগীতে প্রবেশ করেছে লালনের গান৷ আর সেই গানকেই গ্রহণ করছে তরুণ শ্রোতারা৷ যেমন ‘দলছুট’ ব্যান্ড ৯০ এর দশকের শেষ ভাগে কিংবদন্তি বাউল শিল্পী শাহ আবদুল করিমের ‘গাড়ি চলে না’ গানটিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাদের ব্যান্ডের মাধ্যমে৷ প্রায় দেড় হাজার গানের স্রষ্টা শাহ আবদুল করিম৷ ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে’, তাঁর এরকম অসংখ্য গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ কেবল দলছুট ব্যান্ড নয়, তাঁর গান বেছে নিয়েছে ‘বাংলা’সহ জনপ্রিয় অনেক ব্যান্ড ও ব্যান্ড শিল্পীরা৷
ব্যান্ড শিল্পীদের মাধ্যমে এ সব গান আজ পরিচিত পেয়েছে নতুন প্রজন্মের কাছে৷ লালনের গানও আজ বেশি পরিচিত ব্যান্ডের সুবাদে৷ ‘বাংলা ব্যান্ড’ এবং ‘লালন’ এই দু’টি ব্যান্ড ২০০০ সালের পর থেকে লালনের বেশ কিছু জনপ্রিয় গান ভিন্নভাবে পৌঁছে দিয়েছে তরুণ প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছে৷ ‘পারে লয়ে যাও আমায়’, ‘সহজ মানুষ’, ‘জাত গেলো জাত গেলো বলে’ এই গানগুলো সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়৷ কিন্তু কথা হলো গানগুলোর যে দর্শন তা কি বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছাচ্ছে নাকি তারা কেবল সুর এবং ব্যান্ডের পরিবেশনাটাকেই গ্রহণ করছে?
লালনের গান বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কতটা প্রাসঙ্গিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাকে বুঝতে হলে লালনের গান কেবল শোনা নয়, উপলব্ধি করতে হবে৷ কিন্তু ব্যান্ড সংগীতের মাধ্যমে তারা কি সেটা উপলব্ধি করছে? আর একটা বিষয় হলো নিজের দেশ, নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষাটাকে ভালোভাবে বোঝার জন্য সব ধরনের লোকগান, অর্থাৎ মাটির গানের সাথে সম্পৃক্ততা থাকা চাই প্রত্যেকটি মানুষের৷ কেবল বাউল গান নয়, আমাদের লোকগানের যে বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে তার সাথে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেয়াটাও শিল্পীদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে৷ ব্যান্ড শিল্পীরা এই যে বাউল গান গাইছেন তার গীতিকার বা মূল শিল্পী সম্পর্কে যদি কিছু কথা গানের আগে উপস্থাপন করেন এবং ব্যান্ডের অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গে যদি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র যেমন: বাঁশি, খোল, একতারা, দোতরার ব্যবহার করতেন তাহলে হয়ত গানগুলো আরো প্রাণ ছুঁয়ে যেত৷
আমাদের দেশের সরকারের উচিত লোকগানের শিল্পীদের যথাযোগ্য সম্মানীর ব্যবস্থা করা এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলে তারা যাতে নিজেদের গান সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা৷ পাশাপাশি একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যেখানে শুধু লোকগান শেখানো হবে এবং তা নিয়ে গবেষণা হবে৷
বাংলার লোকগান নিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজ করে গেছেন সদ্য প্রয়াত শিল্পী ও গবেষক কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য৷ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি লোক গানের দল ‘দোহার’, আজকের দিনে ব্যান্ডের যুগে এটা আসলেই একটা ব্যতিক্রমী দল৷ আর এই ব্যতিক্রম আয়োজনের কারণেই কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয়, বাংলাদেশেও ভীষণ জনপ্রিয় দলটি৷ কালিকা প্রসাদ গ্রামবাংলা থেকে খুঁজে আনতেন এক একটি লোকগান, তার স্বাভাবিক সুর, তাল অবিক্রিত রেখে, মূল যন্ত্রানুষঙ্গ অক্ষত রেখে, যেভাবে সেটি পরিবেশন করতেন, লোকপ্রিয় করে তুলতেন, সেই আন্তরিকতা, সেই চেষ্টা আজকের সস্তা জনপ্রিয়তার যুগে সত্যিই বিরল৷ হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের গান, লালনের গান, ঝুমুর গান এসব লোকগান সম্পর্কে রীতিমত গবেষণা করতেন কালিকা৷ এ বিষয়ে ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান৷
কালিকার প্রস্থানে বাংলার লোকগানের গবেষণা পথ হারালো৷ কে আর গানের মাধ্যমে লোকগান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেবে? এই খরার সময়ে একজন কালিকাকে ভীষণ দরকার ছিল আমাদের৷ আর কেউ কি এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসবে? গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকগানকে আবারো সজীব, সমৃদ্ধ করতে বর্তমান প্রজন্ম কি কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না? প্রশ্নটা আপনাদের কাছেই রেখে যাচ্ছি৷ (অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলে)