লেখাটি দু’একবার পোষ্ট করা হয়েছে। বারবার ফিরে আসছে বিধায় কিছুটা এডিট করে আবার পোষ্ট করলাম।
আমার দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচাইতে বড় গুলি বিনিময় এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ
১৯৯১ সালের ২৭ অক্টোবর । যথারীতি মধুর ক্যান্টিনে সকাল ১১টার মধ্যেই উপস্থিত ছিলাম।ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ বেশ কয়েকটা মটর সাইকেলযোগে জগন্নাথ হলের দিক থেকে হাকিম চত্বর হয়ে মধুর ক্যান্টিনের সামনে এসে থামল।
প্রত্যেকটি মটর সাইকেলে কমপক্ষে দু’জন ছিল এবং ১০ থেকে ১৫টি মটর সাইকেল ছিল। এই গ্রুপের মধ্যে ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন সদ্য ছাত্রলীগে যোগদানকারী ক্যাম্পাসে সর্বাধিক পরিচিত মুখ উপস্থিত ছিল।
ছাত্রদলে তারা নীরু-অভি গ্রুপ হিসেবে পরিচিত ছিল । কথিত আছে নব্বই এর গনআন্দোলনে নীরু-অভি এরশাদের হয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমন করে গনআন্দোলনকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল।এক পর্যায়ে তারা সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ডা: মিলন হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত ছিল।
কোন্ প্রক্রিয়ায় তারা সেদিন ছাত্রলীগে যোগদান করেছিল তা’ আমার কাছে আজও অজানা।ক্যাম্পাসে তাদের সবার সাথে এক সময়ের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে অনেকেই ধরে নিয়েছিল এই প্রক্রিয়ায় আমার স্বক্রিয় অংশগ্রহন ছিল । প্রকৃত সত্য হচ্ছে তাদের join করা পর্যন্ত আমার কাছে কোন তথ্য ছিল না বা আমার কোন সম্পৃক্ততা ছিল না।
ছাত্রলীগের এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহন কি প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে সে সম্পর্কে ন্যূনতম ধারনা থাকলে হয়ত এধরনের প্রশ্ন উঠত না।
যা’হোক মটর সাইকেল থেকে নেমে সবাই আমার দিকে আসল। আমি আম গাছটির নীচে দাঁড়ানো ছিলাম। যারা দেখল তারা ভাবতেই পারে আমি যেন ওদের আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আসলে আমি ঐ দিনে ওদের মধুর ক্যান্টিনে আসার কোন সিদ্ধান্তের কথা জানতামইনা। ওরা এসেই একই দলের পুরনো শত্রুদের শক্তি প্রদর্শনে ত্রস্ত হল। যোগদানকারীদের মধ্যে যারা সেদিন শক্তির মহরায় অংশ নিয়েছিল বলে মনে পড়ছে তারা হল: মাসুদুর রহমান মাসুদ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে), খানে মির্জা মাসুদ জুয়েল (নিজ এলাকা সাতক্ষীরায় প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছিল), মজ্ঞুরুল আলম লিটু (ছাত্রলীগ এবং পরবর্তীতে আওয়ামী রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছে), নির্মল দাস (DUCSU সদস্য ছিল), মামুন, শফিক, মাহাফুজ, ফরিদ আহম্মেদ সেন্টু, আসাদ, মিঠু, শিশির, গুড্ডু প্রমুখ।
পুরনো ছাত্রলীগের মধ্যে মোস্তাক আহম্মেদ সেন্টু, আবীর, স্বপন বসু, জাকির, বাপ্পীসহ অনেকে। পরবর্তীতে ছাত্রদলের অনভিপ্রেত অংশের ছাত্রলীগে যোগদানে সৃস্ট ক্ষোভ থেকে গ্রুপিং-এর শিকার হয়ে জাকির এবং বাপ্পী নৃশংসভাবে খুন হয় এবং ফিরোজ গুলিবিদ্ধ হয়।
মধুর ক্যান্টিনে উল্লেখিতদের দেখতে পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ল।ছাত্রদলের সবাই যেন ভূত দেখতে পেল।ছাত্রদলের সাধারন সম্পাদক জনাব ইলিয়াস আলী ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে দৌঁড়ে গিয়ে ডাকসু ভবনের একটি টেবিলের নীচে ঢুকল।
ছাত্রলীগের সম্মিলিত গ্রুপ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শক্তির মহরা প্রদর্শন শেষে একটি অংশ জগন্নাথ হলে ফিরে গেল। অন্য অংশটি জহুরুল হল ছাত্র সংসদের ভিপি টোকন, হিরু, বাবুল তালুকদার, শামীম, তমি, রতন, প্রমুখ ধানমন্ডির দিকে চলে যায়।
ইতোমধ্যে সদ্য ক্ষমতাসীন বিএনপি’র ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মাঝে তাদের নেতা ইলিয়াস আলীর assaulted হওয়ার ব্যাপারটি ছড়িয়ে পড়ল ।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি হাবিবুন্নবী খান সোহেল এবং সাধারন সম্পাদক আলী আক্কাছ নাদিমের নেতৃত্বে মলচত্বরের দিক থেকে Arts building এবং Lecture theatre এর মাঝখানের রাস্তা দিয়ে গুলি করতে করতে মধুর ক্যানটিনের দিকে এগোচ্ছিল । গুলিবর্ষণের তোপে আমরা হাকিম চত্বরে চলে যেতে বাধ্য হলাম। গুলির শব্দে আমাদের একটি গ্রুপ জগন্নাথ হল থেকে back করে counter দিতে শুরু করল।
অন্য গ্রুপটি অবশ্য জানতেই পারলনা তখন ক্যাম্পাসে কোন্ প্রলয় কান্ড ঘটছিল। ছাত্রলীগের অবশ্য ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল। আগের রাতেই মাত্র রাজা, আমিন (বর্তমানে আওয়ামীলীগের সহ-প্রচার সম্পাদক) এবং স্বপন (ক্যাম্পাস শ্যাডো স্বপন) চট্টগ্রাম থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে ফিরেছিল।
বৃষ্টির মত গুলি বিনিময় চলছিল। ছাত্রদল ক্যাম্পাসের ভেতরে থাকায় এবং long-ranged arms ব্যবহার করায় তারা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। ছাত্রদলের shelter ছিল ডাকসু ভবন, ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া, ভাষা ইনস্টিটিউট এবং লাইব্রেরী। অপরপক্ষে, ছাত্রলীগ উন্মুক্ত রাস্তায়। পুরো রাস্তার মাঝে ডাসই ছিল একমাত্র shelter।
সংগত কারনে আমরা এক পর্যায়ে ইয়াজ উদ্দিন স্যারের বাসার সামনে শামসুন্নাহার হলের দিকে যেখানটায় সীমানা দেয়াল বাঁক নিয়েছে সেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ডাসের shelter – এ একমাত্র স্বপন বসু তখনও counter দিচ্ছিল। যতদুর মনে পড়ে আমি , রাজা এবং আমাদের পার্শ্বে মুন্সীগজ্ঞের বিপ্লব (বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দিন সাহেবের ছেলে বর্তমানে মেয়র) আমরা একসাথে দাঁড়ানো ছিলাম। অবস্থা অনেকটা হতাশাব্যজ্ঞক ছিল। একমাত্র স্বপন ছাড়া বাকীরা refuelling এর জন্য হলে ব্যাক করল।
এর মধ্যে নাদিম-শামীম, গালিব-লিটনরা লাইব্রেরীর far-right corner থেকে targeted গুলি করছিল এবং ডাসের সরাসরি পিছনে টিএসসি’র এবং শামসুন্নাহার হলের মাঝামাঝি রাস্তায় মিজান গুলিবিদ্ধ হল।
একটি ভ্যান নিয়ে মিজানকে তুলতে যাব এর মধ্যে দেখলাম স্যারের বাসার দেয়ালে পর পর দু’টি গুলি এসে লাগল। রাজা বলল, “ গুলি কোথায় গেল? তোরগায়েলাগেনিতো ?” এর মধ্যে আরেকটি গুলি আমার ডান হাত ছুঁয়ে গেল যেটি আমি টের পেলাম।
রাজা এবার চিৎকার করে বলল ,”তোর পায়ে গুলি লেগেছে।” আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার পা’ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে । এর মধ্যে শুনলাম বিপ্লবের গুলি লেগেছে। আমাকে ইসাহাক আলী খান পান্না, আফজাল হোসেন (বর্তমানে আওয়ামীলীগের তথ্যও গবেষনা সম্পাদক) এবং কয়েকজন মিলে একটি ভ্যানে তুলে জগন্নাথ হলের ভেতর দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সীতে নিয়ে গেল। আমি ভ্যানের মধ্যে হাসছিলাম যেন কিছুই হয়নি । সবার মনোবল ধরে রাখতে হবেতো!
দু’এক ঘন্টা পর পান্না গিয়ে খবর দিল গুলিবিদ্ধ মিজান (মিজানের একটি ভাস্কর্য টিএসসি’র সড়ক দ্বীপে রয়েছে) আর নাই। ছাত্রদলের বিখ্যাত ক্যাডারদ্বয় গালিব-লিটন killed সাথে ১/২ জন টোকাইও killed ।
সূর্যসেন হল ছাত্র-সংসদের ভিপি এবং বর্তমানে আওয়ামীলীগ্র তথ্যও গবেষনা সম্পাদক আফজাল হোসেন তার ঘড়িটি ফার্মেসীতে বন্ধক রেখে আমার জন্য ঔষধ কিনে আনলেন।জরুরী ঔষধ কেনার মত তখন আমাদের কারো কাছেই টাকা ছিল না।কিন্তু আফজাল হেসেন তার নিজের ঘড়িটি আবার টাকা দিয়ে ফেরত নিতে পারবেন কি-না সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেননা।তবুও কোন্ অনুভূতি থেকে সেটি করেছিলেন তা’ বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
পরে জানতে পারলাম ছাত্রদল অতিরিক্ত fuel খরচ করে প্রায় শূন্য ছিল। পক্ষান্তরে ছাত্রলীগ refuelled হয়ে পূনরায় রোকেয়া হলের ভেতর থেকে আক্রমনে গেলে ছাত্রদল আর ধোপে টেকেনি। প্রয়াত দুই সেন্টুর (কালা এবং সাদা সেন্টু হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিল) আক্রমনে ছাত্রদলের দুই শীর্ষ ক্যাডার গালিব এবং লিটন ভাষা ইনস্টিটিউটের সামনে প্রাণ দিয়েছিল।
সন্ধ্যার দিকে দেখলাম আবুল কাসেম মন্টু ভাই, কে এম সহিদ উল্লা ভাই, মোজাহিদুর রহমান হেলো ভাই, কাজল ভাই এবং তেজগাঁর শামসুল আরেফিন শ্যামল ভাই, সায়েদাবাদের এবিএম আমজাদ হোসেন উপস্থিত হলেন। মেডিকেলে থাকা আমার জন্য নিরাপদ নয়। ডা: জালাল ভাই’র সাথে কথা বলে মালিবাগ ভূঁইয়া ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হল।
সকালে আঁধার না কাটতেই ডা: বদিউজ্জামান ভূঁইয়া (আওয়ামীলীগের সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক এবং ক্লিনিকের মালিক) ডাবলু ভাই এসে বললেন, ” বিবিসি’র খবরে তোমার নাম শুনতে পেয়ে সরাসরি সিলেট থেকে চলে এলাম।জানতাম তোমাকে এখানে আনা হবে।কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ক্লিনিক রেইড করবে । মন্টুরা গাড়ী নিয়ে আসছে এখনই পালাতে হবে।”
আমাকে ধানমন্ডিতে আমার পরিচিত একটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় । নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছুদিন সেখানে থেকে privately ডা: সরোয়ার প্রথম দিকে বাসায় এসে dressing করে দিয়ে যেত এবং পরবর্তী কিছুদিন শেঁওরাপাড়ায় ওর ক্লিনিকে গিয়ে dressing করিয়ে নিতাম।মাসাধিককাল সময় লেগেছিল দু’টি গুলিতে আঘাতপ্রাপ্ত ডান পা’টি ভাল হতে ।
অনেকদিন আগের কথা । ডায়েরী লেখা হয়নি । তথ্যগত ভুল সংশোধন প্রশংসনীয় হবে ।
মোঃ শফিকুল আলম , সাবেক সভাপতি , ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ(১৯৯২-১৯৯৩)