ফজলুল বারী: যে হেফাজতে ইসলাম বিএনপির সমর্থনে ঢাকায় এসে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মতিঝিল সহ রাজধানী জুড়ে তান্ডব চালিয়েছে সেই হেফাজত রোববার ঢাকায় ঘটা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা দিয়েছে! শেখ হাসিনাকে হেফাজতের সমাবেশ থেকে উপাধি দেয়া হয়েছে কওমী জননী।
সরকার সমর্থক এক আলেম হেফাজতের আমীর আল্লামা শফিকে স্বাধীনতা পদক দেবার আহবান করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বিষয়টিকে কটাক্ষ করে বলা হচ্ছে তেঁতুল এখন মিষ্টি। এসব নিয়ে পর্যালোচনা করবো এ লেখায়। হেফাজতের মতিঝিল তান্ডবের সেই দিনরাত্রির কথা মনে করুন আরেকবার। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরন মঞ্চের উত্তাল আন্দোলনের শুরুতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়সংগঠনের নেতারা মঞ্চে ওঠার চেষ্টা করছিলেন।
বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা নেতা মেজর (অবঃ) হাফিজ টিভিতে প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলেন মনতো চায় ওখানে চলে যাই। বিএনপি নেতারা তখন তরুনদের ওই মঞ্চ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তোলার আহবানও করছিলেন। কিন্তু তাতে সাড়া না পেয়ে তখন সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে ঢাকায় ফিরে এক বক্তৃতায় খালেদা জিয়া বলেন ‘শাহবাগে নাস্তিকদের সমাবেশ চলছে। এটা কিসের গণজাগরন? কোন গণজাগরন না। ওখানে কিছু ছেলেপুলে গাজা খেয়ে নাচানাচি করছে!’ মূলত খালেদা জিয়ার ওই বক্তৃতার পরেই বিএনপির তরুন নেতাকর্মীরা শাহবাগ ত্যাগ করে। খালেদার বক্তব্যের আস্কারায় নাস্তিকদের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামে হেফাজত। তাদের শাপলা চত্ত্বর মহাসমাবেশ সফল করতে বিএনপির নেতাকর্মীদের আহবান জানান খালেদা জিয়া। ওই সময়েও সংলাপের কথাবার্তা চলছিল।
হেফাজতের মহাসমাবেশে সরকারের পতন হয়ে যাবে মনে করে খালেদা জিয়া তখন সংলাপে সাড়া দেননি। শাপলা চত্বরের সেই সমাবেশ বিশৃংখল হয়ে উঠলে আগুন দেয়া হয় মতিঝিল-বায়তুল মোকাররম এলাকায়। বায়তুল মোকাররম এলাকার কোরান শরীফের দোকানগুলোও তখন আগুনে পুড়ে। ধংস করা হয় বিজয় নগর এলাকার রাস্তার সব গাছ। উস্কানির অভিযোগে বন্ধ করা হয় দিগন্ত টিভির সম্প্রচার। পরি স্থিতি নিয়ন্ত্রনে বিজিবি নামানো হয়। তাদের অপারেশনে হেফাজতকে মতিঝিল থেকে তুলে দেয়া সম্ভব হলেও ছড়ানো হয় আড়াই হাজার লাশ গুমের গুজব। গোটা পরিস্থিতি সামাল দিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক অপপ্রচারের একটি হলো ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শের এই দলের নেতাকর্মীরা আল্লাহ খোদা মানেনা। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের পক্ষে এই প্রচারনা আরও জোরদার করা হয়। এর অংশ হিসাবে খুনিরা শুরু থেকে সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতির অন্যতম ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ দেয়। মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা শ্লোগান বাদ দিয়ে চালু করা হয় পাকিস্তানি স্টাইলের বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সংবিধানের ওপর লিখা হয় বিসমিল্লাহ। ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করা হয়। বাংলাদেশে যখন কোন নির্বাচন এসেছে তখনই একটি প্রচারনা হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরতে পারলে ইসলাম ধংস হয়ে যাবে। উলুধবনি হবে মসজিদে। শাঁখা সিঁদুর পড়তে হবে মেয়েদের। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটিকে এই অপপ্রচার থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। মানুষকে বোঝাতে হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।
অনেকে মনে করতে পারবেন ১৯৯৬ সালে ২১ বছর ক্ষমতায় ফেরার পর আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতার মাথায় ওঠে গোলটুপি। আরেক মজার সত্য একটি প্রচারনাও ছিল। তাহলো বামপন্থীদের নিয়ে জোট হলেও শেখ হাসিনা নিয়মিত নামাজ পড়েন। এমনকি তাহাজুদের নামাজও পড়েন। আর মৌলবাদী জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার ভোর হয় বেশ দেরিতে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা পায় আওয়ামী লীগ। এই সুযোগে ধর্ম নিরপেক্ষতা সংবিধানে ফিরলেও বিসমিল্লাহ আর রাষ্ট্র ধর্ম দুটো বিষয়ে হাত দেবার সাহস তারা করেনি। চেষ্টাও করেনি। এসব কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির সামাজিক বাস্তবতা।
হেফাজতের মতিঝিল তান্ডবের পর নানা অপপ্রচারের মুখে আওয়ামী লীগ নীরবে হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে মন দেয়। বলা হয় এটি শেখ হাসিনার শত্রূকে বন্ধু বানানোর কৌশলের অংশ। দেশে বিদেশের নানাক্ষেত্রে এই কৌশলটি কাজে লাগিয়ে চলছেন শেখ হাসিনা। দুটো উদাহরন দেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কারনে বাংলাদেশ তিস্তার পানির হিস্যা পাচ্ছেনা এটি জেনেও শেখ হাসিনা আজ পর্যন্ত মমতার বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য দেননি। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচিত অং সান সুকির বিরুদ্ধেও আজ পর্যন্ত দেননি কোন বক্তব্য। চাইলেতো যে কোন বক্তব্য দিনে দশবার দেয়া যায়। বক্তব্য দিলেতো আর সমাধান চলে আসবেনা। আখেরে এসব সমস্যা ক্ষমতায় যতদিন আছেন শেখ হাসিনাকেই ফেস করে সমাধান আনার চেষ্টা করতে হবে। হেফাজতের সঙ্গেও সম্পর্কন্নোয়নে রাজনৈতিক প্রশাসনিক নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছিল। এরজন্যে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম অঞ্চলের নেতাদের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হয়। আর হেফাজতের আমীরের ছেলে পালন করেন বিশেষ ভূমিকা। এ নিয়ে হেফাজতে ভাঙ্গনও এসেছে। কিন্তু সেখানে আল্লামা শফির নেতৃত্বাধীন অংশটি বড় এবং প্রভাবশালী। হেফাজতকে নিউট্রালাইজডকে করতে পারায় প্রাথমিক সাফল্য যেটি সরকার পেয়েছে তাহলো তাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় সংগঠনটি আর কখনো রাস্তায় নামেনি। এরমাঝে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার স্বীকৃতি সরকারের সঙ্গে হেফাজত তথা মাদ্রাসা ভিত্তিক দেশের বড় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অগ্রগতি ঘটে।
বাংলাদেশে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক শিক্ষা সম্প্রদায়টিও বেশ বড় এবং প্রভাবশালী। ১৩ লক্ষ ছাত্রছাত্রী পড়ে কওমী মাদ্রাসাগুলোয়। কিন্তু কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সর্বোচ্চ পড়াশুনার সরকারি স্বীকৃতি ছিলোনা। এই স্বীকৃতির ঘটনা ঘটলো সেই সংগঠনের উদ্যোগে যাদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের নিত্য প্রচারনা দলটি আল্লাহ-খোদা মানেনা। কিন্তু হেফাজতের নেতা আল্লামা শফি সরকারি ভূমিকায় আশ্বস্ত সন্তুষ্ট হয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্বর্ধনার আয়োজন করেন। সম্পর্কের উন্নয়নের জন্যে বেশ কিছুদিন ধরে আওয়ামী লীগ সহ ১৪ দলের নেতাকর্মীদের হেফাজত সহ এর নেতা আল্লামা শফির বিরুদ্ধে কথাবার্তা না বলতে সতর্ক করেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের এক সভায় শেখ হাসিনা বলেন আল্লামা শফিকে যাতে আর কেউ যাতে তেঁতুল হুজুর না বলেন।
এখন হেফাজতের সঙ্গে সরকার তথা আওয়ামী লীগের সম্পর্কোন্নয়নে দলটি আগামীতে কতোটা উপকৃত হবে না হবে তা ভবিষ্যতকাল বলবে। এই সম্পর্কোন্নয়নে নাখোশ বিএনপিপন্থীরা বলা শুরু করেছেন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার স্বীকৃতি দেবার সময় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরন করা হয়নি। বিএনপি কেনো ক্ষমতায় থাকতে এসব করেনি এ নিয়ে কোন বক্তব্য নেই। ভোটের বাজারে হেফাজত তথা মাদ্রাসা ভিত্তিক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দোয়া চায় আওয়ামী লীগ-এন্টি আওয়ামী লীগ উভয়পক্ষ।
রোববারের সম্বর্ধনায়ও শেখ হাসিনাও আসন্ন নির্বাচনের জন্যে দোয়া চেয়েছেন। সেখানে সরাসরি কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া না হলেও আওয়ামী লীগ চায় এইপক্ষটি যাতে ভোটের প্রচারনায় অন্যবারের মতো প্রকাশ্যে বিরোধিতায় না যায়। রোববারের মহাসমাবেশ অন্তত সে রকম একটি অপ্রকাশ্য আশ্বাস অথবা চক্ষু লজ্জারও সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন সবপক্ষই ভোটবাড়ানোর সব চেষ্টাই করবে। কারন কোন রাজনৈতিক দলই এখানে রামকৃষ্ণ মিশন অথবা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম নয়। হেফাজতের শাপলা চত্বর অভিযানের পর আড়াই হাজার লাশের অপপ্রচারে জড়িত পক্ষ রোববার হেফাজতের শেখ হাসিনার সম্বর্ধনাকে কেন্দ্রকে ঢাকায় যানজটের রিপোর্ট করেছে। এতে প্রকাশ পেয়েছে শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা দেয়ায় তাদের মনোঃকষ্ট! শত্রুপক্ষকে জয় করে তাদের সম্বর্ধনা পাওয়া কী শেখ হাসিনার ব্যর্থতা?