মেজভাই

মেজভাই

ভার্সিটির টগবগে তরুণ তখন ! আব্বা তখনো মানি অর্ডার পাঠান ! পড়াশুনার অনুপাত ঘোরাঘুরি ও খেলাধুলার সাথে কমপেয়ার করলে খুবই সামান্য ! ভূয়া থাকি জিয়া হলে । সিটের মালিক গ্রামের বড় ভাই সেরাজুল ইসলাম প্রধান । ফিটফাট মানুষ ! দশবার শার্ট ঝাড়া দেয়, বাইরে থেকে রুমে ফিরলেই ! হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে, লেগে থাকা ঘামগুলোকে হলের ছোট্ট ব্যালকুনিতে শুকোতে দেয় । আমি পুরোই বিপরীত । ছোট বোন ধলির নখদর্পনে থাকতো আমার কাগজ, কলম ও পোশাক আশাকের হিসেব ! সেই অগোছালো মানুষটাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সেরাজুল ভাই । ওনার ঋন ভুলে যাবার জিনিস নয়, এবং ভুলবোও না !

বন্ধুদের অনেকই তখন টি এস সি নামক জায়গাটাকে বিকেলে আড্ডার স্থান করে নিয়েছে । আমি নিয়েছি ছোট্ট কমন রুমটাকে ! ওখানে টেবিল টেনিসের একটা টেবিল, একটা ক্যারামবোর্ড আর দাবার গুটি এলোমেলো ভাবে থাকত । ছাত্রের অনুপাতে সরঞ্জাম নিত্যন্ত গরিব । আগে আসলে আগে পাবেন নীতিতে পুরাপুরি বিশ্বাসী । কলেজ লাইফের হোস্টেলে মাছের মাথা খেতে আগে যেতাম ডাইনিং রুমে, আর হলে ডাইনিংয়ের ট্রেডমার্কা গন্ধেই অর্ধ ভুড়িভোজ হয়ে যেত, তাই ওদিকে রয়ে সয়ে যেতাম । ফার্স্ট হয়ে ঢোকার টার্গেট ছিল কমনরুমে, আর মাছের মাথা ছিল টেবিল টেনিসের ব্যাট । ওটাকে হাতে পেলেই ক্ষুধা তৃষ্ণা, দিন দুনিয়া সব যেতাম ভুলে । প্রতিপক্ষ না থাকলে দেয়ালকে বানাতাম প্রতিপক্ষ ! অপেক্ষা করতাম প্রতিক্ষের ! কতেকদিন জুটলেও বেশীর ভাগ সময়ই নেতাদের হাতে সপে দেয়া লাগতো বল ও ব্যাট । ওনারা তখন সিগারেট ফুকিয়ে হৈচৈ করে প্রাকটিস করতেন টেবিল টেনিসের ।আমার স্থান তখন ঠি ক উপরের টি ভি রুমটায় ! মাঝে মাঝে বই খাতা নিয়ে বসতাম মুজিব হলের রিডিং রুমটাতে । মাঝে মাঝে শফিকে পেতাম ওখানে । লিকু ও মাজহার থাকত প্রায়ই । এটাই ছিল প্রথম বর্ষের দৈনন্দিন রুটিন ।

মাঝে মাঝে যেতাম মেজভাই, মোস্তফা ভাইয়ের কাছে । ও তখন বাড্ডার একটা মেসে থাকত ! ইরাক ফেরত বিদেশে ভাই আমার ! নিজে পড়াশুনা বেশীদুর করতে পারে নাই । পড়াশুনার প্রতি ভীষন দরদ ছিল মনে । ফ্যামিলির প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় আলাদা চোখে দেখতো আমাকে । আমিও সুযোগটা নিতাম ! টু পাইস কামানোর জন্য ছয় নম্বর মুড়ির টি ন, ট্যাম্পু করে যেতাম ওর ওখানে । রোজগার খারাপ হত না , কেননা ছাত্রের আইডি দেখিয়ে মুড়ির টি নের ভাড়া দিতাম হাফ। বিলাসবহুল না হলেও ভালই চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ !

ভার্সিটির মাঝপথে আব্বা বিদায় জানালেন পৃথিবীকে ! আমিও পড়ার খরচ টি উশনির ইনকাম দিয়ে চালিয়ে নিলাম । বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লাম , ছোটখাট চাকুরিও জুটেছে কপালে । বিয়ে নামক দিল্লীকা লাড্ডুও আধা হজম হয়েছে । গিন্নী সংসার সাজানোর চেয়ে বিসিএস ও আমার পিএইচডি নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনে । জোর জবরদস্তি করে চিঠে পাঠাতে বলে জাপানের প্রফেসরদের কাছে ! আমি চিঠি পাঠাই তবে সেটা প্রফেসরগন পড়েন কিনা সেটা আর জানা হয় না !

মোস্তফা ভাই লোভনীয় একটা জব নিয়ে তখন দুবাইয়ে । যোগাযোগের মাধ্যম কাগজের চিঠি । খুব একটা হত না । দুজনেরই সংসার হয়েছে ।

গিন্নীর স্বপ্নের জালের একাংশ বুনে ফেলেছে ততদিনে । দিনাজপুর কলেজের লেকচারের পদবি লাগিয়েছে নিজের নামের সাথে । আমি কম্পিউটারের কি চাপি আর ঢাকায় বন্ধুদের সাথে মেসের লাইফ ।

উপরওয়ালার মনে হয় দয়া হয়েছিল । জাপানের মনবসুর সিলেকশনের নোটিশ পাঠিয়েছেন একদিন । সবাই খুশি ছিল তবে বেশী খুশি হয়েছিল আমার বিদেশী মেজভাইটা !

এদেশে এসেই ভাইকে জিনিসপত্রের আকাশচুম্বী দামের কথা জানালাম । উদাহরন হিসেবে মুলোর দাম যে দুশো টাকা সেটাও লিখলাম । উত্তর আসলো এরকম “ জিনিস পত্রের দামের কথা চিন্তা করলে না খেয়ে মারা যাবি । ভুলেও দাম নিয়ে মাথা ঘামাবি না “ । টেকনোলজির উন্নতিতে কাগজের ব্যবহার কমে মুখের ব্যবহার বাড়লো । সময় জ্ঞানের তোয়াক্কা না করে রাত দুপুরে কথা বলতাম দুজন ফোনে । ভাই দেশের কোন ছোটমোট সুখবর শুনলেই ফোন করে বলতো “ শুনেছিস অমুক না ফাস্ট হয়েছে, অমুক বৃত্তি পেয়েছে । আজ আব্বা থাকলে খুবই খুশি হতেন ! “ দুজনের চোখ যে আর্দ্র হতো সেটা ভিডিও ফোন না হলেও বুঝতাম !

সময় তার আপন গতিতে চলে কয়েক বছর পার করেছে । বয়স বাড়ায় ভাই বিদেশ ছেড়ে দেশে গেল । ছোটকাল থেকে এই ভাইটির ছিল নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি অগাধ ভালবাসা । যাত্রা দেখলে ভাত বন্ধ আমাদের বাড়িতে, এটা জেনেও মিস করতো না যাত্রা দেখা । আব্বা ধুমপান করলেও ছেলেরা সেটা করুক এটাতে বিশ্বাসী ছিলেন না । তারপরেও ভাই মনে হয় সবচেয়ে কম বয়সে নেশাখোর হয়ে গিনিজ বুকে নাম লিখিয়েছিল । বিদেশে একলা জীবনে যে কত অনিয়ম করেছে আল্লাহ মালুম । বিভিন্ন রোগ নিয়ে কাটাচ্ছিল জীবন ।

স্কাইপে দেখা হয়েছিল অনেকদিন পর ! ফোনে কথা হত প্রায়ই । মেয়ের বিয়ে ও ছেলের পড়াশুনা নিয়ে চিন্তিত থাকত বেশী ! বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ করে বিদায় জানালো সবাইকে । বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল বিদেশ থেকে । আমাকে বেচে থাকার উপদেশ দিয়ে নিজেই বিদায় নিয়েছিল আগে।

এখনো খুজি ভাইকে । রাত বিরাতে ফোনের রিংয়ে দৌড়ে উঠাই রিসিভার । আশা করি ভাইয়ের ফোনের । রং নাম্বারের ফোনে ঘোর কাটে !
পৃথিবীতে টেকনোলজির উন্নতি হলেও পরপারে মনে হয় এখনো সেকেলে সিস্টেম । জানানোর লিস্টটা লম্বা হতেই চলেছে । ওর মতোই আমাদের একটা ভাই এসেছে ওর মেয়ের কাছে । ছেলেটাও মাস্টারস করতে যাচ্ছে । জানানো হয় নাই এখনো !

কাজের ভীড়ে, জীবনের স্রোতে ভুলে থাকার এ্যাকটিং করতে হয় । ভাষাহীন সেই ড্রামায় আমিই অভিনেতা আমিই শ্রোতা । নাটকের পর্দা নিজেই উঠাই নিজেই ফেলাই । প্রাত্যাহিক জীবনের ছোট ঘটনাগুলি নাটকের পর্দা তুলতে উদ্বুদ্ধ করে । অনেকদিন পর স্কুল বন্ধু বাবলুর দেখা পেলাম ফেসবুকে । কথা হচ্ছিল ফোনে । কথাবার্তার এক পর্যায়ে উঠলো মোস্তফা ভাইয়ের কথা ! বয়সের গ্যাপ থাকলেও গুরু শিষ্যের মত সম্পর্ক ছিল ওদের মাঝে । ও বলেই চলছিল ভাইয়ের হাজারো কথা । আমি শুধু হু হা করে পার করেছিলাম সময় । মনের ভিতরে তখন জমে থাকা কষ্টের লাভাগুলি খুজছিল উৎগিরনের পথের…

( মোঃ মাহবুবর রহমান , তোত্তরি, জাপান )
ডঃ মোঃ মাহবুবর রহমান , তোত্তরি, জাপান