ফজলুল বারী :একদল দেখি ফেসবুকে এভাবে প্রোফাইল আপডেট করছেন! ছাত্রলীগে জব শুরু করেছেন? ছাত্রলীগ তাহলে জবও দেয়? তা বেতন কতো? আর অন্যসব সুবিধাদি? কী বললেন? বেতন লাগেনা বা লাগবেনা? তাহলে কী অমুক অমুকের পকেট কাটবেন বা হলে অমুককে আটকে রেখে মুক্তিপন নেবেন? এটা কিন্তু ছাত্রলীগ না। এটা ভুল ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নামে এখন যেটা ভুল গড়া হয়েছে তা ইতিহাস প্রাচীন সংগঠনটির সংগে মানানসই না। ছাত্রলীগ নামটি এদের ধারন করেনা। ধারন করতে পারেনা।
ছাত্রলীগের সংগে মিছিলে কেটেছে আমার কৈশোর-যৌবন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মিছিলের সংগে হেঁটে আমাদের প্রজন্মও সাংবাদিক হিসাবে বিকশিত হয়েছে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরাই ছিলেন আমাদের বন্ধু। এদের প্রায় সবাই আমাদের মতো না খাওয়া পোড় খাওয়া, লিকলিকে গড়নের ছিলেন। সারাদিন মিছিল সংগ্রাম করে হলের মেঝেতে বা এক চৌকিতে দু’জন তিনজন ঘুমাতেন। সকালে নাস্তা করতেন হলের স্টলে বা মধুতে। যেখানে কম টাকায় খাবার পাওয়া যেতো। গ্রেফতার ভয়ের সময়গুলোতেতো চলতো আরও কঠিন জীবন।
এখনতো সব তেল চকচকে চেহারা। শুনি একেকজন দামী গাড়ি বাড়ির মালিক। বাজারের সর্বশেষ দামী মোবাইল সেট ব্যবহার করেন। অনেক কল রিসিভ করতে হয়। তাই অনেকের একটা মোবাইলে চলেওনা। কারো কারো ব্যক্তিগত অফিস, স্টাফও আছে। আছে গোপন ব্যবসা-ঘরসংসার। ফেসবুকে মাঝে মাঝে দেখি ছাত্রলীগের অমুক নেতা অমুকের পড়াশুনার খরচ দেবেন! অমুকের চিকিৎসার সমুদয় খরচ মিটিয়ে দিচ্ছেন! বিশাল একদল সহমত ভাই, আপনি মহান দৃষ্টান্ত ভাই, আপনিই ছাত্রলীগ, আপনিই নেত্রীর কান্ডারী বলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন সে সব পোষ্টে! আমি অবাক হয়ে যাই, ছাত্রলীগের নেতা যে চাকরি করেনা, অফিসিয়েলি ব্যবসা নেই, সে কিভাবে এত টাকার মালিক বনে গেলে? সত্যি এই ছাত্রলীগ আমি চিনিনা।
আমাদের সময়ের ছাত্রলীগ নেতারা ছিলেন পোড় খাওয়া সংগ্রামী, সৎ। অনেক লাজ লজ্জাও তাদের মধ্যে কাজ করতো। সর্বশেষ ছাত্রদের বিভিন্ন আন্দোলন, ডাকসু নির্বাচনেও সবার ধারনা হয়েছে শুধু ছাত্রলীগ না মূলধারার কোন ছাত্র সংগঠনই এখন আর সাধারন ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেনা। কারন সাধারন ছাত্ররা সারাক্ষন এদের জীবন দেখে। প্রিয় প্রজন্ম সাধারন ছাত্ররা এখন অনেক চালাক চতুর। এদের ভয় দেখিয়ে শ্রদ্ধা ভালোবাসা পাওয়া যায়না। আদায়ও করা যায়না। তাই সুযোগ পেলে এরা ডাকসুর মতো অন্যজনকে ভোট দেয়।
এখন দেশের সাধারন ছাত্রছাত্রীদের কাছে গড়পড়তা সব ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীই সাধারন ধারনায় চাঁদাবাজ। ধান্ধাবাজ। এদের বেশিরভাগ নিয়মিত পড়াশুনাও করেনা। ব্যতিক্রমী কতিপয় থাকতে পারেন এখনকার নেতারা আর সাধারন ছাত্রদের কাছে না দলে সংগঠনে তাদের আশ্রয় নেতার কাছে দায়বদ্ধ। অনেকে এমনও বলেন ছাত্রলীগ এত কষ্ট সংগ্রাম করেছে এখন একটু ভোগ করবেনা? কষ্ট যারা করেছে তাদের বেশিরভাগ এখন ভোগ করছে। এই ছাত্রলীগ বা এই সংগঠনগুলো কষ্ট করা সংগঠন না। এদের নেতাকর্মীদের প্রায় সবার জন্মই হয়েছে ভোগবাদী ধান্ধাবাজ সময়ে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পর সে রকম রাজনৈতিক আন্দোলন আর এদেশে হয়নি।
এখন ছেলেমেয়েরা সংগঠনে যোগ দেয় ভাইদের মাধ্যমে বা কারনে। ভাইরা ভর্তি বা হলের সিটের জন্য তদবির করেন। পারিবারিক ভাবে বা কারনে এখন সংগঠনে যোগ দেয় কম। বুদ্ধিমান পরিবার কর্তা নেতা ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়ান। তাদের ঘেটু নেতাদের মাধ্যমে যারা সংগঠনে যোগ দেয় এদের সিংহভাগ সংগঠনটি সম্পর্ক বিশদ জানেনা। এখন আবার বেশি জানা লাগেনা বা বেশি জানা ভালোনা। কিছু নেতার নাম শ্লোগান জানলেই চলে। তাদের ভাইরাও এসব জানেনা। এ যেন বাংলাদেশের দূর্ঘটনা প্রবন রাস্তার মতো। চালক গাড়ি চালাতে শিখেছে ওস্তাদের কাছে। ওস্তাদই ট্রাফিক রুল কিছু জানতোনা। শিষ্যকে শেখাবে কী করে। তাই পথ বাংলাদেশের দূর্ঘটনাময়। বাংলাদেশের রাজনীতিও এখন দূর্ঘটনাময়, কারন এখানে কেউ তার সংগঠন জানেনা। জানে ভাই। নেত্রী। এনাফ।
এক সময় তোফায়েল আহমদরা ছাত্রলীগ দেখতেন। সর্বশেষ দেখতেন ওবায়দুল কাদের। এখন যারা ছাত্রলীগ দেখেন তারা মূলত সেই গাড়ির ওস্তাদ কিসিমের। তার দরকার কে কে সবকিছুতে বলতে পারবে সহমত ভাই। এটা যত ভালো বলা যাবে তাতে কালেভদ্রে নেত্রীর কাছে যাওয়া যাবে ছবি তোলা যাবে। আর একবার ছবি তুলতে পারলেই…! অতএব যা ঘটার তাই ঘটছে। এখন আবার গডফাদার নেতারাই ছাত্রলীগ নিয়ে গ্রুপিং করেন। গ্রুপিং বজায় রাখেন। এরজন্য খুনখারাবি থেকে শুরু করে হেন বাজে কাজ নেই যা তারা করেননা। আসলে এখন শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের কোথাও কোন নি:স্বার্থ নেতাকর্মী নেই। শেখ হাসিনা দলটিকে ক্ষমতায় অনেছেন। ক্ষমতায় ধরে রেখেছেন। আর অন্য সবাই মিলে করে খাচ্ছেন আরকী!
সর্বশেষ ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষনাকে কেন্দ্র করে এ সংগঠনের ভোগবাদী চরিত্রটি আর উৎকট প্রকাশিত হয়েছে। পদপ্রাপ্ত, পদবঞ্চিত উভয়পক্ষই ভোগের জন্য ভোগের আশায় এখানে এসেছেন। তাই পদবঞ্চিতরা প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের পিটিয়ে লাল বানিয়ে দিয়েছে পদপ্রাপ্তরা। কী বেয়াদব, আমাদের সহমত ভাই না বলে উল্টো প্রতিবাদ করে! ছাত্রলীগ দূরে থাক এদের কেউ কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনাকে ধারন করেনা। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর কয়েক পাতা পড়ে থাকতে পারে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা এই বই ছাত্রলীগের চেয়ে বেশি পড়েছে মুখস্ত করে শিবিরের ছেলেমেয়েরা। তাদের অনেকে বইটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচনাও শুরু করে। ধান্ধার ব্যস্ততাও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এই বইটি পড়েও বঙ্গবন্ধুকে ধারন করার চেস্টা করেনি।
নতুন কমিটি ঘোষনার পর আরেকটি বিষয় বোঝাগেলো! কথিত গোয়েন্দা রিপোর্ট বলে যা শোনা যায় তা ফালতু। অথবা এটাই দক্ষতা আমাদের কথিত রাজনৈতিক সহমতভাই গোয়েন্দাদের। নতুন কমিটি নিয়ে যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের সতর্ক করছি। এই সংগঠনগুলো যারা করবেন তাদের এসব মেনে নিয়েই করতে হবে। যদি কারো সংগঠন বদলের ইচ্ছা থাকে তা অন্যকথা। যদিও জানি রাজনৈতিক জ্ঞানহীন ধান্ধাবাজরা এখন এই মুহুর্তে ছাত্রলীগের মতো সোনার ডিম পাড়া সংগঠন ছাড়বার মতো বোকা নন। তাহলে এখন পদত্যাগ সহ এসব লোক হাসানোর কী দরকার।