ফজলুল বারী: মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় হালকা ভাবে অনেক কিছু লিখতে গিয়েও কঠিন বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে হয়! আম্ফানের হামলা আক্রমন বাংলাদেশের আর কলকাতার টিভিতে দেখতে গিয়ে তেমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।
আমি লিখেছিলাম এপাশে বলছে পানি, আরেকপাশে জল। ব্যাস একটি বিতর্ক চালু হয়ে গেলো! কোনটা গ্রহনযোগ্য? বাঙালি না আরবি/উর্দু! পানি শব্দটা কোথা থেকে কিভাবে এসেছে এসব নিয়ে নানান আলোচনা!
কিন্তু বিশ্বাস করুন বিষয়টি এতোটা সিরিয়াস হয়ে উঠবে তা ভাবিনি। লেখার সময় নষ্ট করে এতে অংশগ্রহনটাও আমার অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। জবাব দিতে গিয়ে আমি লিখেছিলাম, এটা ঠিক করে দেবার কী আছে।
চেয়ার-শার্টের মতো যে যা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, তাই বলবেন। ব্যাস হয়ে গেলো বিপদ! কেনো বললাম যে যা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন! ‘তাহলে বাংলাদেশপন্থী আর পাকিস্তানপন্থীতে পার্থক্য থাকলো কী’! ইত্যাদি।
মোটামুটি একজন পানি বললে সে পাকিস্তানি জ্ঞানে তলিয়ে গেলো আর জল বললে ওপরে উঠে গেলো আর কী! বিশ্বাস করুন মাঝে মাঝে এসব বিতর্ককে উটকোও মনে হয়। যদিও এসবও কিছু লোকের বিনোদন বিষয়!
অথচ একজন জল বলবে না পানি বলবে এতে একটা জাতি বা গোষ্ঠী উচ্ছন্নে যাবেনা। এসব কোন একটি দেশজাতির মূল সমস্যাও নয়। এসব বিতর্কে জড়ানোকে মানে সময়ের অপচয়ও।
এসব নানা আলোচনা বিতর্কের সময় আমার সাংবাদিক নির্মল সেনকে খুব মনে পড়ে যায়। দাদা প্রায় আমাকে সহজ করে অনেক কঠিন কঠিন কথা বলতেন। যেমন একদিন আমাকে বলেন ফজলুল বারী, আমি নির্মল সেনকে জবাই করলে কী দেখতে পাবে জানো?
কী দাদা? দেখবে ভিতরে একটা হিন্দু লোক বসে আছে! আর তুমি ফজলুল বারীকে জবাই করলে দেখবো ভেতরে বসা একজন মুসলমান মানুষ। ঠিক এভাবে আমরা বাইরে যত বড় কথা বলে বেড়াইনা কেনো নড়াচড়াতেই অনেক স্বরূপ বেরিয়ে আসে!
যেমন বাংলাদেশের শুধু মুসলমান মৌলবাদী না সব ধর্মেরই মৌলবাদী আছে। বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে মুসলমানগুলো চোখে পড়ে। দেখে ভয় করে। যেমন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা বিপদজ্জনক।
সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত আমার কিছু প্রিয় প্রজন্ম এই রোজায় এক উপজেলা শহরে প্রতিদিন রোজাদারদের খাবার দিচ্ছিল। ধর্মসূত্রে ছেলেগুলো হিন্দু। বিষয়টি নিয়ে যাতে কোথাও কোন সমস্যা দেখা না দেয় সে জন্যে তারা একটি কৌশলের আশ্রয় নেয়।
তাহলো, খাবার বিতরনের সময় তারা তাদের মুসলমান বন্ধুদের কাজে লাগাচ্ছিল। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। একদিন তাদের একজন জানালো তাদের মুরব্বিদের বাধার মুখে তারা আর এখন কাজটি করতে পারছেনা।
মুরব্বিরা প্রশ্ন তুলেছে হিন্দু হয়ে তারা কেনো রোজায় মুসলমানদের খাবার দেবে? আমাকে ছেলেটি তখন মজা করে বলে ভাইরে এতোদিন মুসলমান মৌলবাদী দেখতাম। এখন ঘরের ভিতর হিন্দু মৌলবাদী দেখছি।
এসব ভালোমন্দ নিয়েইতো আমাদের সমাজ। ঈদ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মসজিদ ভিত্তিক কিছু অনুদান দিয়েছেন। রোজায় বাংলাদেশের মুসলমানরা অনেক দান খয়রাত করেন।
করোনা ভাইরাস ইস্যুতে ভয়ে ভয়ে হলেও বাংলাদেশ মসজিদে যাতায়াতকে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করা চেষ্টা করেছে। অস্ট্রেলিয়া যেদিন ইনডোরে দশজনের বেশি মানুষের সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে তখন আর মুখে মসজিদ বলতে হয়নি।
সে দিনই স্থানীয় সব মসজিদ-গির্জা-মন্দির কমিটি নিজেরাই এগুলোয় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এগুলো এখনও তালাবদ্ধ। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে তালা শব্দটাই উচ্চারন সম্ভব নয়। করোনার মধ্যেই নাসিরনগরে এক বিশাল জানাজা সমাবেশ হয়েছে।
এরপর বলা হয়েছে সেখানে নিশ্চয় শুধু মানুষ নয় ফেরেস্তারাও এসেছিল! সে জন্যে জানাজার আগে হঠাৎ করে তারা এসে আবার হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেছেন! গরিব বাংলাদেশের অনেক সমস্যা।
দেশটির এক কোটির বেশি মানুষ বিদেশে অনেক কষ্ট করে রোজগারের টাকা দেশে পাঠান। আরব দেশে তাদের মিসকিন ডাকা হয়। এটি দেশের জন্যে মোটেও মর্যাদার নয়।
কাজেই এসব ফেরেস্তাদের শুধু জানাজায় কাজে না লাগিয়ে দেশের কুদরতি সমৃদ্ধিতেও কী কাজে লাগানো যায় না? তাহলে আমরা এসব মিসকিনরা বিদেশে থেকে দেশের বদনাম না কামিয়ে সবাই দেশে ফিরে আসতাম।
বাংলাদেশে যে শেখ হাসিনা দাপটের সঙ্গে দেশ চালান, তিনি তাহাজুদের নামাজ পড়েন আর ফজরের পর কোরান তেলোয়াত করে দিন শুরু করেন বললেই শুধু হবেনা, তাঁকে সারাক্ষন নানা অপশক্তির বিরুদ্ধেও সতর্ক থাকতে হয়।
করোনার এই সময়ে ঈদে আগে প্রধানমন্ত্রী মসজিদ ভিত্তিক কিছু অনুদান দিয়েছেন। এর কারন বোধকরি করোনার কারনে মুসল্লিদের যাতায়াত কমে যাওয়ায় ইমাম-মুয়াজ্জিন সহ মসজিদ সংশ্লিষ্টদের আয়ও কমে গেছে।
যে আয়ে তাদের সংসার চলে। কিন্তু আমাকে একজন এর লিঙ্ক দিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেন প্রধানমন্ত্রী এই সময়ে শুধু মসজিদে টাকা দিতে পারেননা। অন্য ধর্মের উপাসনালয়েও সমানভাবে টাকা দেয়া উচিত ছিল।
প্রধানমন্ত্রী এটা ঠিক করেননি ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি নিশ্চয় একজন ধর্ম নিরপেক্ষ প্রগতিশীল ব্যক্তি। ধর্ম মন্ত্রনালয় বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মের প্রধান উৎসবকে কেন্দ্র করে নানান অনুদানের ব্যবস্থা করে।
এখন যেহেতু ঈদ, তাই মসজিদ ভিত্তিক অনুদান দিয়েছে এমন ধারনার বক্তব্য দিয়েও পার পাওয়া গেলোনা। আমি অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত। এ সমাজটাকে নিজের অভিজ্ঞতায় পড়ি। আওয়ামী লীগের সমস্যাগুলোও জানি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দেওয়া দলটি নিয়ে যে বাংলাদেশে দেখতে নারি’র শেষ নেই! বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু তাকে হত্যার পর অন্যতম মূল একটি প্রচারনা ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে সংখ্যাগুরুর ধর্মকে তিনি অবজ্ঞা-অপমান করেছেন!
যুদ্ধ বিধবস্ত বাংলাদেশ পরিচালনার খুব অল্প সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপরও ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মদ-জুয়া বন্ধ থেকে শুরু নানাকিছু করেও এদের বিবেচনায় মুসলমান হতে পারেননি বাংলাদেশের জাতির পিতা!
দেশের পাকিস্তানপন্থী সো কল্ড ইসলামপন্থীদের অপ্রচার থেকে দেশ এবং নিজের পরিজনসহ জীবনও রক্ষা করতে পারেননি। এরপর থেকে একুশ বছর পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনের আগে দেশ থেকে ইসলাম যাবার আশংকা দেখা দিয়েছে!
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ইসলাম যাবে, মসজিদে উলুধবনি হবে, সবাইকে শাঁখা-সিঁদুর পরতে হবে এমন মুখস্ত নানান অপ্রচার চলতো। প্রতিটি নির্বাচন উপলক্ষে গজব নামতো সংখ্যালঘুদের জীবনে।
ভোটের আগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো প্রার্থীরা প্রকাশ্যে বলে দিতো, আপনাদের আর কষ্ট করে ভোট কেন্দ্রে যাবার দরকার নেই। আপনাদের ভোট আমরা পেয়ে গেছি, ইত্যাদি!
আর ভোটের পর শুরু হতো আক্রমন। কারন ভোট দিক আর নাই দিক, মুখস্ত মনে করা হতো সংখ্যালঘু মানেই তারা নৌকায় ভোট দিয়েছে। এরজন্য প্রতিটি নির্বাচনের পর নীরবে দেশ ছাড়তে হতো সংখ্যালঘুদের।
আর প্রতিটা ভোটের আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের গোলটুপি পরে ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় এসব বলে বলে কত যে কসরত করে অতঃপর ক্ষমতায় ফিরতে হয়েছে।
এর কারনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় সহ ক্ষমতায় ফিরে সংবিধান সংশোধন করতে গিয়েও জিয়ার বিসমিল্লাহ, এরশাদের রাষ্ট্রধর্মে হাত দেবার চেষ্টা করেনি।
এর আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সাংবিধানিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলেও তারাও ধর্মীয় ইস্যুর দিকে যায়নি। অথচ বাংলাদেশের পরিচিত আত্মস্বীকৃত প্রগতিশীলবৃ্ন্দ নানা সময়ে সংবিধানে এ দুটির অস্তিত্ব নিয়ে গেলো গেলো রব তোলেন!
কবে যে তারা ক্ষমতায় আসবেন আর দেশের সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন! কবে আসবেন? কেউ জানেননা। তারাও না। বিশ্বজুড়ে নানান হিসাব-নিকাশও এখন বদলে গেছে।
প্রতিবেশী ধর্ম নিরপেক্ষ দেশটায় বিজেপি নামের একটি দল ক্ষমতায় ঝেঁকে বসাতেও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের যারা প্রভাবিত করতে পারে এমন শক্তি-অপশক্তিকে বুঝে শুনে হ্যান্ডেল করতে পারেন।
শেখ হাসিনা এটি এখনও ভালোভাবে পারছেন বলেইতো এখনও বেঁচে আছেন। সংক্ষিপ্ত শক্তির প্রগতিশীল অথবা বিশেষ কিছু ব্যক্তির কাছে নিরপেক্ষতা প্রমান করতে কী তাকে পিতার মতো প্রান দিতে হবে?
এসবের কোন প্রয়োজন নেই। এসব বাংলাদেশের এখন কোন মূল সমস্যাও নয়। বাংলাদেশকে ঠিকপথেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তাঁর শুধু আরও বেশ কিছুদিন সুস্থ বেঁচে থাকা দরকার।
অপশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারিতে জনতার ঢল কী দেখেন? দিন শেষে এই দেশের মানুষ হারেনা। ছোট ছোট বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব না দিলেও আমাদের চলবে। বাংলাদেশি বলতে হলেও আমরাতো আসলে বাঙালি।