ফজলুল বারী:লঞ্চের নাম অভিযান-দশ। এখন এর নাম দেয়া যায়, মানুষ পুড়িয়ে বারবিকিউ করার অভিযান! বাংলাদেশের এসব লঞ্চগুলোকে বিদেশিরা লেখে ফেরী। অভিযানের যাত্রীদের পুড়িয়ে বারবিকিউ করতে জ্বলন্ত লঞ্চ তথা ফেরীর ছবি-নিউজ প্রকাশিত হয়েছে প্রধান সব বিদেশি প্রচার মাধ্যমে।
অভিযান-দশ লঞ্চের মালিক হাম জালাল বলেছেন তার এই লঞ্চে নতুন ইঞ্জিন লাগিয়েছেন। এইতো সেদিন! মানে নতুন ইঞ্চিন মানেই সবকিছু সুং-শাং ফাইন! এখন জানা যাচ্ছে লঞ্চের ইঞ্জিন বদল-চালকেরই সনদ-অনুমোদন কিছুই ছিলোনা। লঞ্চটি পরীক্ষামূলক চালানো হচ্ছিল। কিন্তু পরীক্ষামূলক কোন ট্রিপ যে এত যাত্রী নিয়ে বানিজ্যিকভাবে চালাতে নেই এমন বিষয় নজরদারীরও কেউ যেন নেই আমাদের দেশটায়!
বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলে যাতায়াতের বিলাস বহুল লঞ্চগুলোর নানান নামডাক! অভিযান-দশ এর রাজকীয় সাজ-সজ্জার ফুটেজও এখন পাওয়া যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু বাইরে ফিটফাট ভেতরটা যে সদরঘাট! ডিজিটাল বাংলাদেশের নানান ব্যবস্থাপনা আজও এনালগ! তাই এগুলোর একেকটি ঘটনার পর কেউ জানেনা এগুলোয় যাত্রী কারা ছিলেন লঞ্চে, কত যাত্রী ছিলেন!
এই লঞ্চগুলোতে ভিআইপি কেবিনও থাকে। অভিযান-দশ লঞ্চে কেবিন ছিল একাশিটি। কিন্তু এই বাংলাদেশের নদীযাত্রার ভিআইপিরা মূলত টাকার ভিআইপি। বিদ্যা-বুদ্ধির কম। রাষ্ট্রও তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করে! তাই নেপালে বিমান দূর্ঘটনার পর জাতীয় শোক ঘোষনা করা হয়েছিল। কিন্তু অভিযান-দশে পুড়ে এত মানুষ যে মরলো, বারবিকিউ হলো, এরজন্যে জাতীয় শোক ঘোষনা করতে হয়নি।
কারন যারা এসব শোক ঘোষনা করে তাদের কাছে লঞ্চে যারা ডেকে ঘুমিয়ে বাড়ি যায় তারা সব ফকিন্নির পুত! ফকিন্নির পুতরা মরলে জাতীয় শোক ঘোষনা করতে হয়না। বিমানযাত্রী মরলে হয়। বাংলাদেশের একেকটা ঘটনার পর বঙ্গবন্ধুকে বেশি করে আমাদের মনে পড়ে। আসলে তিনিই দেশের চাষা-ভূষা-ফকিন্নির পুতদের নেতা ছিলেন। জনসভায় দাঁড়িয়ে চোর-ডাকাত-ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে বলতেন। এরজন্যে শয়তান ভিআইপির দল জোটবদ্ধ হয়ে তাকে হত্যা করেছে।
অভিযান-দশে দু’জন মাত্র ভিআইপি যাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেছে! ইনি পাথরঘাটা থানার ইউএনও হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ ও তার স্ত্রী উম্মুল আরা। লঞ্চের দ্বিতীয় তলার ভিআইপি কেবিনে তারা ছিলেন। মানুষের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গলে ইউএনও সহযাত্রী স্ত্রীকে নিয়ে লাফিয়ে নামতে গিয়ে তার স্ত্রী’র পা ভেঙ্গেছে।
ইউএনও বেঁচে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য দিয়েছেন! অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন আগুন জ্বলা লঞ্চটি অমুক জায়গায় থামতে চেয়েছে। না পেরে অমুক জায়গায় থেমেছে! কিন্তু ইউএনও’র মনে হয়েছে আগুনে ইঞ্জিন অকার্যকর হয়ে পড়ায় লঞ্চটি নিয়ন্ত্রনহীন দীর্ঘক্ষণ শীতের কুয়াশা আচ্ছাদিত নদীতে ভাসছিল।
দিয়াকুল গ্রামের পাশে লঞ্চটি আটকালে ইউএনও সহ অনেকে তীরে লাফিয়ে নামেন। কিন্তু ওই সময়ে গোটা লঞ্চ আগুনের তাপ আর ধোয়ায় এতোটাই আচ্ছাদিত ছিল যে কারও পক্ষেই জান নিয়ে স্বাভাবিক পলায়ন সম্ভব ছিলোনা। অনেকে দিয়াকুল গ্রামে নামার পর টের পান তার সন্তান বা প্রিয়জন কেউ লঞ্চে রয়ে গেছেন। তখন তাকে আনতে আবার লঞ্চে গিয়ে তারা আর ফেরেননি।
এই লঞ্চ দূর্ঘটনার শিকারদের দিয়াকুল গ্রামের মানুষজন যেভাবে মানবিক সহায়তা দিয়েছেন তা খুব কম মিডিয়ায় এসেছে। দিয়াকুল গ্রামের লোকজন ট্রিপল নাইনে ফোন করে কোন সাড়া পায়নি। ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন এসেছে সকালে। কিন্তু তাদের গ্রামে প্রজ্জ্বলিত লঞ্চটি ভেড়ার পর থেকে নদীতে ভাসমান মানুষজনকে উদ্ধার সহ নানান সহায়তা দিয়ে গেছে গ্রামের মানুষ।
বিপন্ন শীতার্ত মানুষ যারা পরনের কাপড় হারিয়েছে বা ভিজে জবজবা হয়েছে তাদেরকে তারা নিজেদের কাপড় পরতে দিয়েছে। কুয়াশার অন্ধকার রাতে ট্রলার নিয়ে নদীতে ভাসমান মানুষ খুঁজে তুলে এনেছে তীরে-শুশ্রূষা করেছে নিজেদের বাড়িতে। তারা হাহাকার করে বলেছে, তাপ এতটাই তীব্র ছিল যে লঞ্চের কাছে যাওয়া যাচ্ছিলোনা। নতুবা তারা আরও অনেক যাত্রীকে বাঁচাতে পারতেন।
বাংলাদেশে তদবিরবাজদের একুশে-স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। দিয়াকুল গ্রামের মানুষগুলোই এমন পদকের আসল যোগ্য। কিন্তু তাদের পক্ষে তদবির করবে কে? আমরা দিয়াকুল গ্রামবাসীর পক্ষে একুশে অথবা স্বাধীনতা পদকের দাবি করে রাখলাম। কেউ শুনলে শুনুক।
অভিযান-দশ লঞ্চ দূর্ঘটনার পর দেশের টেলিভিশনগুলোয় যথারীতি আমরা পন্ডিতনমন্যদের ব্যাপক বক্তব্য শুনছি। বাংলাদেশের এরা সবকিছু জানেন। এখন গবেষনার একটি বিষয় হলো লঞ্চে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্রপাতি, যাত্রী নিরাপত্তার বিষয়গুলো যথাযথ ছিলো কিনা। এসব থাকলেই বা কি! লঞ্চের লোকজন যদি এসবের ব্যবহার না জানে তাহলে যন্ত্র দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখে কী লাভ।
লঞ্চে যারা কাজ করে তাদের বেতন সহ নানান যোগ্যতাও দেখতে হবে। কাঁঠাল গাছে আম আশা করে লাভ নেই। এরমাঝে জানা গেছে লঞ্চে অগ্নি নির্বাপন সরঞ্জামাদি ছিল যৎসামান্য। এবং কারও কোন প্রশিক্ষন ছিলোনা। লঞ্চ মালিকরা ডাকেননা বলে ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন তাদের প্রশিক্ষণ দিতে যানওনা! সোজা কথা!
অগ্নি নির্বাপন সহ নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি দেখভালের কর্তৃপক্ষ ঘুষ দিয়ে সার্টিফিকেট দিতে অভ্যস্ত। শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গার মতো তাদেরকেই লঞ্চ দূর্ঘটনার কারন নির্নয় করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে! তাদের সার্টিফিকেটে আছে এই লঞ্চের নিরাপত্তা সরঞ্জমাদির সুষ্ঠু মেয়াদ ২০২২ সালের অমুক তারিখ পর্যন্ত! আর কি চাই! কিতাব ফকফকা।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের বাড়ি যেতে এমন প্রজ্জ্বলিত লঞ্চে বারবিকিউ হবার ঘটনা না থাকলেও অপঘাত মৃত্যুর ইতিহাস নতুন নয়। এরজন্যে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক মানুষের কবর নেই। লঞ্চডুবিতে লাশ ভেসে গেছে। কবর হবে কোত্থেকে।
একবার ভোলার লালমোহনগামী একটি লঞ্চ ডুবলো চাঁদপুরে। আমরা রিপোর্টাররা ছুটলাম চাঁদপুরে। কিন্তু চাঁদপুরে স্রোতস্বিনী নদীতে লঞ্চ ডুবলে সেটির আর হদিশ মিলতোনা। ওই অবস্থায় খবর আসে লঞ্চডুবির লাশ ভাসছে লালমোহনে।
তখন আমরা লক্ষীপুর হয়ে সী-ট্রাকে ভোলা হয়ে ছুটলাম লালমোহন। কাকতালীয় বিষয় ছিল মৃতদের লাশ ভাসতে ভাসতে চলে গেছে তাদের লালমোহনের বাড়ির ঘাটে! এরা এত গরিব যে চাঁদপুর থেকে লাশ লালমোহন নেবার আর্থিক সঙ্গতিও তাদের ছিলোনা। এরজন্যেই বুঝি ভাসতে ভাসতে লাশ চলে গেছে তাদের বাড়ির ঘাটে!
কিন্তু অভিযান-দশ এ বারবিকিউ হয়ে যাওয়াদের স্বজনের দূর্ভাগ্য তারা লাশও বাড়ি নিয়ে যেতে পারলেননা! কারন লাশ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় তা চেনার শনাক্ত করার উপায় ছিলোনা। অতঃপর গণজানাজা শেষে বরগুনায় তাদের গনকবর হয়েছে।
অভিযান-দশ’এর ঘটনার পর জানা গেলো সরকারের কাছেও দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মানুষজনের জীবন মানে আল্লাহর ওয়াস্তের জীবন! বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আগে একটি বার্ণ ইউনিট ছিল। কিন্তু সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরজন্যে আগুনে পোড়া মানুষজনকে সেখানে চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছিলোনা। তাদের অনেকে ঢাকা নেবার পথে তারা মারা গেছেন!
বাংলাদেশে প্রায় নিউজ হয় মাথাপিছু আয় এখন অত হাজার ডলার! গৌরবে বলতে বলতে তা এখন প্রায় তিন হাজার ডলার ছুঁই ছুঁই! কিন্তু এসব দূর্ঘটনায় কেউ মরলে তখন ফকিন্নির পুতদের জীবনের দাম জানা যায়! লাশ দাফনের জন্য দেয়া হয় পঁচিশ হাজার টাকা। এবার নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন যারা পুড়ে মরেছে তাদের পরিবারকে দেড়লাখ টাকা করে দেয়া হবে! কিন্তু লাশইতো শনাক্ত হয়নি। টাকা পাবে কে?