আমার ছোটবেলা কেটেছে অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে। এ নিয়ে আমাদের পরিবারের সবার আক্ষেপের শেষ ছিল না। কিন্তু প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ডাক পিওন এসে মানি অর্ডারের প্রাপ্তি স্বীকার পত্র আমাদের বাসার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে যেত। সেটায় লেখা থাকতো “ ৫০০/ টাকা মাত্র বুঝিয়া পাইলাম”। তারপর নিচে প্রাপকের সাক্ষর এর জায়গায় আমার দাদার দস্তখত “মুতিউর রহমান”। আমাদের চলুক আর নাই বা চলুক আব্বা ঠিকই প্রতি মাসের শেষে দাদাকে মানি অর্ডার করতো। আম্মা এবং আমরা ভাইবোনেরা ওই রিসিট দেখে বুঝতে পারতাম যে আব্বা টাকা পাঠিয়েছে। সেই সময়ে এত অভাব অনটনের মধ্যেও আব্বা গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় গৌরীপুর বাজার থেকে নৌকা বোঝাই করে বাজার করে নিয়ে যেত। আমি যখন ঢাকায় ফুফুর বাসায় থেকে পড়াশুনা করি তখনও গ্রামের বাড়িতে গেলে আব্বার নির্দেশ ছিল ব্যাগ ভর্তি বাজার করে দাদা দাদীর জন্য নিয়ে যেতে। আমার বড় ফুফু মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করে বলতো, ও ছাত্র মানুষ টাকা পাবে কোথায়? তারপর আব্বার নির্দেশকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দেশের বাড়িতে যাবার আগে ফুফু তার সংসার খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে আমার হাতে তুলে দিতো।
এই ফুফু যখন দর্শনা থাকতো তখন তার পক্ষে সংসার সামলে প্রতি বছর কোনভাবেই গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দিতে দাদা-দাদিকে দেখতে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তখন ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা শেষ হলে বছর শেষে আমাদের খুলনার বাসায় এসে আম্মাকে মিষ্টি হেসে বলতো ভাবী, আব্বা আম্মাকে অত দূরে দেখতে যেতে পারবোনা দেখে সুলতান ভাইজুকে (আমার আব্বার ডাক নাম) দেখে মনটা ঠাণ্ডা করতে এসেছি। আমার দুই ফুফুর মতে, আব্বার চাল চলন কথা বার্তা শরীর স্বাস্থ্য সব কিছুই নাকি আমার দাদার মতো।
আমার দাদা দাদি কখনো একসাথে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো না। কারণ তাদের ভাষ্য মতে প্রথমত: দুইজন একসাথে আসলে আব্বার টানাটানির সংসারে আরও কষ্ট হবে আর দ্বিতীয়ত: দুজন আলাদা আলাদা আসলে আমরা সবাই দুইবার আনন্দ করতে পারবো। দাদা আমাদের বাসায় আসার আগে আগে আব্বা তার জন্য তার রুমের বাইরে মূলী বাঁশের তৈরি ক্ষণস্থায়ী ল্যাট্রিন বানিয়ে রাখতো। পাছে অনেকটা পথ ঘুরে দাদার ভেতর বাড়ীর ল্যাট্রিন ব্যবহার করতে কষ্ট হয়।
আমি আব্বার কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে নিজেদের শত অভাব অনটনের মাঝেও বাবা মাকে তাদের প্রাপ্য সেবা যত্ন করতে হয়। আমার স্ত্রী বা ছেলে জানেনা আমি কিভাবে বাবা মাকে কবে কত টাকা পাঠাই। কারণ এ যুগে তোঁ আর মানি অর্ডারের রিসিট ফেরত আসে না।
আমি যখন বছর দুয়েক আগে আব্বা আম্মাকে অস্ট্রেলিয়া আনবার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন প্রথমেই আমার ছেলে আরিকের স্কুল ছুটির দিনগুলো বেছে নিয়েছিলাম। যাতে করে ছেলেটা তার দাদা দাদীর সান্নিধ্য পায়। আমার লেখালেখির ব্যস্ততা নিয়ে মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী মন খারাপ করে। কারণ রুটি আর রুজির ধান্দায় আমাকে সপ্তাহের ছয়দিন সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকতে হয় আর বাকী একদিন যদি আমি লেখালেখি নিয়ে বসে থাকি তাহলে বাজার সদাই ও আনুষঙ্গিক কাজকর্ম চলবে কিভাবে। আমার জোর করে গছিয়ে দেওয়া অখাদ্য লেখালেখি নিয়ে যখন পাঠক ও বন্ধু মহল আলোচনা কিংবা সমালোচনা করে তখন আমার নয় বছরের ছেলে আরিক তার ভাল মন্দ কিছুই বুঝতে পারেনা। কারণ সে বাংলা পড়তে বা লিখতে পারে না। একসময় আমরা অনেক চেষ্টা করেছি ওকে বাংলা পড়া ও লেখা শেখানোর জন্য। কিন্তু আরিক কখনো আগ্রহ দেখায়নি। আমার লেখালেখি পড়তে না পারার কারণে একদিন আরিক তার মাকে বললো আম্মু আমাকে বাংলা স্কুলে ভর্তি করে দাও। আমি তাড়াতাড়ি বাংলা শিখে বাবার লেখা পড়বো। সবাই বাবার লেখা পড়ে আর আমি পড়তে পারিনা।
ওর মা বললো বাংলা স্কুলে সপ্তাহে একদিন দুই তিন ঘণ্টা করে বাংলা শিখলে তোমার অনেক সময় লাগবে। তার চেয়ে তুমি যদি প্রতি সন্ধ্যায় ঘণ্টা-খানিক আমার কাছে পড়তে বসো তাহলে খুব তাড়াতাড়ি শিখতে পারবে।
আমরা নিউজিল্যান্ড থাকতে আমাদের এক আন্টি অনেকগুলি ছোটদের বাংলা শেখার বই আরিকের জন্য দিয়ে রেখেছিলো। আরিকের মা সেগুলো বের করে তাকে প্রতি সন্ধ্যায় বাংলা শেখাতে শুরু করলো। সন্ধ্যায় যখন আমি লিখতে বসি তখন ছেলেটা আমার কিছুটা বাংলা অক্ষর জ্ঞান শিখে ল্যাপটপে আমার লেখার পেজ খুলে আধো ইংরেজি আর আধো বাংলা উচ্চারণে পড়তে শুরু করে; তখন আমার ভেতরে এক ধরনের উপলব্ধি তৈরি হয়। আমি একটা নূতন লেখার জন্য শব্দ সাজিয়ে চলেছি আর ছেলেটা আমার পাশে বসে আমারই লেখাগুলোকে অদম্য উৎসাহে রপ্ত করার চেষ্টা করে চলেছে।
আজ “ফাদারর্স ডে”। কারো কারো জীবনে হয়তো অধির আগ্রহে থেকে ঘুরে ঘুরে বছরে একটিবার এই দিনটি আসে। আমার, আরিকের ও তার দাদার জীবনে এই দিনটি বছরের প্রতিদিনের আর প্রতিমুহূর্তের … …………।
নাইম আবদুল্লাহ, সিডনি প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক