অরুণ থেকে উত্তম, এক মহানায়কের গল্প

অরুণ থেকে উত্তম, এক মহানায়কের গল্প

অনলাইন ডেস্কঃ ২৫ জুলাই ২০১৫

নিরন্তর সাধনা ছিল তাঁর। ছিল অসাধারণ প্রতিভা, কর্মদক্ষতা আর চেষ্টা। পথ ছিল বন্ধুর। তিনি পরোয়া করেননি। সুদর্শন চেহারা, অভিনয়ের সৃজনক্ষমতা আর কঠোর শ্রমের গুণে পৌঁছে গেছেন লক্ষ্যে। তিনি উত্তম কুমার। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তির অভিনেতা। মহানায়ক হিসেবে যাঁর খ্যাতি আকাশছোঁয়া। আজ ২৪ জুলাই এই মহানায়কের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮০ সালের এই দিনে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
উত্তম কুমারের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। উত্তর কলকাতার আহিরিটোলায়, মামাবাড়িতে ভূমিষ্ঠ হন তিনি। তখন অবশ্য তিনি উত্তম কুমার নন। অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার গিরিশ মুখার্জি রোডের বাসিন্দা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের বড় ছেলে।
১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করলেন। ১৯৪৫ সালে বিকম স্ট্যান্ডার্ড পাস করে ভর্তি হলেন কলেজে। কিন্তু কলেজে পড়া আর বেশি দূর এগোল না। টানাপোড়েনের সংসার। চলল চাকরির সন্ধান। যে করেই হোক, একটা চাকরি চাই তাঁর। অবশেষে মিলল চাকরি। পোর্ট কমিশনার্স অফিসের খিদিরপুর ডকে। সাধারণ কেরানির পদে। বেতন মাসে মাত্র ২৭৫ টাকা। দুই হাজার টাকা জামানাত দিয়ে চাকরিতে যোগ দিলেন। এরই মধ্যে চলছিল তাঁর অভিনেতা হওয়ার নিরলস চেষ্টা। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড থিয়েটার অনুরাগী। সেই ছোটবেলা থেকেই। ছিলেন যাত্রার ভক্ত। পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে চুরি করে দেখতেন থিয়েটারের মহড়া। যাত্রার মহড়াও দেখতেন। স্কুলের বার্ষিক উৎসবে ‘গয়াসুর’ নাটকে ছোট গয়াসুরের ভূমিকায় অভিনয় করে হইচই ফেলে দিলেন।
অভিনয়ের প্রতি ঝোঁকটা বেড়েই চলল ক্রমে। মনের গহিনে চলল রুপালি পর্দায় অভিনয় করার সোনালি স্বপ্ন বোনা। লালিত স্বপ্ন দেখা দিল বাস্তব হয়ে। সুযোগ মিলল ১৯৪৭ সালে। বাড়ির ভাড়াটে গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে ভোলানাথ আঢ্যের ‘মায়াডোর’ নামের একটি হিন্দি ছবিতে ছোট্ট একটা চরিত্র পেলেন অরুণ। দৈনিক পাঁচ সিকি পারিশ্রমিকে পাঁচ দিন অভিনয় করলেন। কিন্তু ‘মায়াডোর’ মুক্তি পায়নি। দ্বিতীয় সুযোগটি এল ঠিক পরের বছরই। ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে অভিনয় করলেন নায়কের ছোটবেলার ভূমিকায়। কমিশন বাদ দিয়ে এ ছবিতে তাঁর পারিশ্রমিক দাঁড়াল সাড়ে ১৩ টাকা। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কাজ শুরু করলেন নবেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কামনা’ ছবিতে। নায়কের ভূমিকায়। পারিশ্রমিক এক হাজার ৫০০ টাকা।
১৯৪৯ সালে মুক্তি পেল ‘কামনা’। কিন্তু সুপার ফ্লপ। ভীষণ মুষড়ে পড়লেন তিনি। এরপর সরোজ মুখার্জির ‘মর্যাদা’ ছবিতে অভিনয় করলেন নায়ক হিসেবে। তবে পরিচালকের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাম পাল্টে অরুণ কুমার হয়ে গেলেন অরূপ কুমার। কাজ হলো না। দর্শকপ্রিয়তা পেল না ছবিটি। আবার নাম পরিবর্তন করা হলো। উত্তম কুমার। ‘সহযাত্রী’ ছবিতে উত্তম কুমার নামে অভিনয় করলেন। অসফল হলো ছবিটি। অসফলতার ধারাবাহিকতায় যোগ হলো আরও একটি ছবি ‘নষ্টনীড়’। এরপর ‘সঞ্জীবনী’, ‘কার পাপে’, ‘বসু পরিবার’। সেটা ১৯৫২ সাল। আশাতীত সাফল্য পেল ‘বসু পরিবার’। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। এল ১৯৫৩। মুক্তি পেল তাঁর অভিনীত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ছবির নায়িকা সুচিত্রা সেন। সুপারহিট। এরপর শুধুই সাফল্য। ইতিহাস। নায়ক উত্তম কুমার হয়ে উঠলেন মহানায়ক উত্তম কুমার।
উত্তম কুমার ছিলেন একাধারে অভিনেতা, সুরকার, প্রযোজক ও পরিচালক। তাঁর চলচ্চিত্র জীবন ৩০ বছরের। এই সময়টাতে তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর বিপরীতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ৩৫ জন অভিনেত্রী। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ২৯টি ছবিতে। সর্বাধিক ৩২টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে।
চলচ্চিত্র ছাড়াও অভিনয় করেছেন মঞ্চে ও যাত্রায়। এ ছাড়া পরিচালনা করেছেন পাঁচটি ছবি, সুরারোপ করেছেন দুটিতে, প্রযোজনা করেছেন সাতটি ছবি।
‘হ্রদ’, ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘নায়ক’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘গৃহদাহ’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘স্ত্রী’, ‘অমানুষ’, ‘ব‌হ্নিশিখা’, ‘আনন্দ আশ্রম’সহ অনেক ছবিতে অসাধারণ অভিনয় উপহার দিয়ে জয় করেছেন অগণিত দর্শকের হৃদয়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়া বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস’ অ্যাসোসিয়েশন, সার্টিফিকেট অব মেরিট, সাংস্কৃতিক সাংবাদিক সংস্থা, ফিল্মফেয়ারসহ আরও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
উত্তম কুমারের অভিনয়ের মূল্যায়ন করেছেন তাঁর সহকর্মীরা। নানাভাবে, নানা বিশেষণে। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম দিকপাল সত্যজিৎ রায় তাঁকে মূল্যায়ন করেছেন ঠিক এভাবে—‘ওঁর মতো স্টার আর হবে না। বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের দিকপাল। ওঁর সঙ্গে আমি কাজ করেছি। আশ্চর্য অভিনয়-দক্ষতা। উত্তমের মতো কোনো নায়ক নেই, কেউ হবে না।’
অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের ভাষায়, ‘এককথায় গ্রেট, গ্রেট আর্টিস্ট। তবু যেন মনে হয় ওঁকে ঠিকমতো এক্সপ্লয়েট করা হয়নি।’
নিজের অভিনয় সম্পর্কে উত্তম কুমারের মন্তব্য, ‘ধরাবাঁধা ছকে অথবা সাজানো কণ্ঠে অভিনয় করার ইচ্ছা আমার কোনোদিনই ছিল না। আমি তাই নিজস্ব ধারায় সহজ অভিনয় করতাম। আমরা যেমন করে কথা বলি, রাগ করি, ঠিক তেমনি সহজ অভিনয়। অভিনয় নয়, ভাবেই চরিত্র রূপায়ণ।’ ( সুত্রঃ প্রথম আলো)