জাপানে চুল কাটার বিড়ম্বনা!

জাপানে চুল কাটার বিড়ম্বনা!

জাপানে সবকিছুই ব্যয়বহুল তবে সবচেয়ে বেশী হল চুল কাটার রেট । বাংলাদেশের সেলুনগুলোর সাথে তুলনীয় নয়। আকাশ পাতাল পার্থক্য। তাই আমিসহ অনেক বাংলাদেশীরা চুল বড় করে বাবরী বানীয়ে চলাফেরা করি। হাতে একটা দোতারা এবং  গায়ে গেরুয়া থাকলে নিজেকে বয়াতী বলেও চালানো যেতে পারে। নিজেকে সান্তনা দেই এই বলে যে আমি তো ফ্যাশন করছি। ফ্যাশনটা আপটুডেট কিনা সেটার বিচারক তো আর আমি নই। এটার নাম কিপটামির ফ্যাশন হলেও হতে পারে, সেটা নিয়ে মডেলদের চিন্তা করার কিছু নেই। অর্থনৈতিক কৃচ্ছতার এই ফ্যাশন পারি কিংবা মিলানো কালেকশনে স্থান পেলো কিনা সেটা ফ্যাশন ডিজাইনের দেখার বিষয় হলেও সব ডিজাইনার তো আর ফ্রান্স কিংবা ইতালিতে যেতে পারে না?  তাই আমাদের শো হয় বন্ধের দিনগুলোতে। আমরা ক্যাটওয়াক করি শপিং মলগুলোতে মডার্ন ফ্যাশনের ড্রেসগুলো দেখে দেখে।
haircut

চুল কাঁটার খরচটা ছোট পরিবারগুলোর খুব একটা অর্থনৈতিক সমস্যা না হলেও বড় পরিবারগুলোর জন্য সত্যিই একটা চিন্তার বিষয়। সমস্যা থাকলে সমাধান থাকবে। আমরা বাঙ্গালীরা তড়িৎ সমস্যার সমাধান দিতে ওস্তাদ। তাই চিরুনি ও কাঁচি নিয়ে পার্ট টাইম নাপিত হয়ে যাই অনেকেই। ড্রইং রুমটা বানিয়ে ফেলি অস্থায়ী সেলুন। ময়লা ফেলানোর পলিথিন ব্যাগটাকে বানাই এপ্রোন। কর্তা নাপিত হলে হেলপার হয়ে যায় সহধর্মীনী। সদস্যদের বড় থেকে শুরু করে একে একে বসানো হয় অপারেশনের আসনে। ভাগ্য ভাল থাকলে চুলের কাটিংটা চলনসই হয়। আর খারাপ হলে কিম্ভুতকিমাকার এক ডিজাইনে পরিণত হয়।

আমিও তাই সহধর্মীনীর বুদ্ধিতে নাপিতের যন্ত্রপাতি কিনে ফেললাম। মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতিগুলির পাশাপাশি বিদ্যুৎ  চালিত  ট্রিমার ( চুল ছাটার মেশিন ) কিনতে ভুললাম না। টাকা বাচানোর জন্য একমাত্র ছেলের চুল কাটা নিয়ে আমাদের পতী-পত্নীর সে এক হুলস্থুল ব্যাপার। ড্রইং রুমের কার্পেটকে ময়লার হাত থেকে বাচানোর জন্য বিছানো হল ছেলের খালামনির দেয়া  ওয়ালক্লোথ । পরানো হল পলিথিনের এপ্রোন। ছেলেকে বলা হল চোখ বন্ধ রাখতে। ছেলে যেন ব্যাথা না পায় সেটার ইনসট্রাকশন চলছে মিনিটে মিনিটে। ভালই চলছিল আমাদের চুল কাটার অপারেশন। একটু অন্যমনস্ক হওয়াতে একটা জায়গায় একটু বেশী কাটা পড়ল। লক্ষ্য করলাম সহধর্মীনীর বড় বড় চোখদুটি আরো বড় হয়েছে। ছেলে যাতে বুঝতে না পারে তাই ভাষা ব্যবহার না করে চোখ দিয়েই জানিয়ে দিল রাগ হওয়ার ব্যাপারটি। আমি প্রোফেশনাল নাপিত না তাই ভুলটা শোধরানোর কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। অগত্যা ওটাকে এক ধরনের ফ্যাশন মনে করে রেখে দিলাম। ছেলে টেরও পেলনা কি সর্বনাশই না করেছি তার চুলের ডিজাইনের। চুল কাটার অপারেশন শেষ করেই মনে মনে বললাম “আর না!”  টাকা বাচাতে দরকার হলে আমার চুলকে ঝুটি বাধার মত বড় করব কিন্তু ছেলের মাথার চুল নিয়ে আর কোন রিসার্চ নয়। চুলকাটার যন্ত্রপাতিতে করা ইনভেস্টমেন্টাই জলে গেল।

HairCut1জাপানে পা দিয়েই জেনেছিলাম এখানে সবকিছুই দামী। চুল কাটার দামটা কয়েকদিন পরেই জেনেছিলাম এখানকার সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে। এও জেনেছিলাম যে বিদেশীদের কনশেসন দেয়া হয় একটা নির্দিষ্ট সেলুনে । একটা দরকারি শব্দও মুখস্থ করেছিলাম চুল কাটাতে যাবার আগে। শব্দটা ছিল মিজিকাকু(ছোট করে কাটা) । দাতখানি চাল, মুসুরের ডাল চিনিপাতা দই কবিতার মত মিজিকাকু হয়ে গিয়েছিল মুজুকাশিই(কঠিন ভাবে)। আমার চুল কাটার ইনসট্রাকশন শুনে নাপিত বেটা মনে হয় ভড়কে গিয়েছিল। কিছুক্ষন চুপ থেকে মনের মাধুরী মিশিয়ে কেটে দিয়েছিল চুল। আমিও তুলতুলে চেয়ারে বসে  স্বপ্ন  দেখছিলাম। পাশের গ্রামের নাপিতের কাছে আমি চুল কাটাচ্ছি । আমার মাথাটা নাপিতের দুই হাটুর মাঝখানে। আমি মাথা চুলকাতে চাই কিন্তু পারছি না। আমি অস্বস্তি অনুভব করছি কিন্ত বলার সাহস নাই। জাপানী নাপিতের ধমকে ঘুম ভাঙ্গল। কি যেন বলল আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা সুচক জবাব দিলাম। দেখলাম সে ভুরু চেছা শুরু করেছে । আমি হাত নাড়িয়ে বললাম ওটার দরকার নাই। সে যখন আমার কানের চুল কাটা শুরু করল তখন আর না করিনি। ভেবেছিলাম বার বার না করলে যদি রাগ করে। এমনি কনশেসনে কাটাচ্ছি। পরে জেনেছিলাম নাপিতগুলো ছিল নভিস। ট্রেনিং শেষ করা ফ্রেস নাপিত। আমরা বিদেশীরা ছিলাম ওদের ডামি। আমাদের দিয়েই ওরা হাত পাকা করেছে নাপিত হিসেবে খেটে খাওয়ার জন্য। আমার চুলকাটার এক্সপেরিয়েনস অন্যান্য বাংলাদেশীদের কাছে বর্ননা করতে যেয়েই বুঝতে পেরেছিলাম আমার চুলকাটার ইন্স্ট্রাকশনে ভুলের ব্যাপারটি। মুজুকাশি হল কঠিন আর মিজিকাকু হল ছোট । “ছোট করে কেটে দাও” এর পরিবর্তে “কঠিন করে কেটে দাও”  বললে নাপিত গোষ্ঠীর  আশ্চর্য হবারই কথা।

Mahbub

 

 

 

 

(মোঃ মাহবুবর রহমান  তোত্তরি, জাপান, ,লেখক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার)