সংবাদে পুরস্কার ফুলে কলাগাছ!

সংবাদে পুরস্কার ফুলে কলাগাছ!

অনলাইন ডেস্ক: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বাংলা সিনেমার দিন বদলাচ্ছে। গতানুগতিক ধারা ভেঙে নির্মাণে ভিন্নতা এসেছে। ‘ছেড়ে দে শয়তান’ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছেন নির্মাতারা। কাদামাটির পথটা তৈরী করেছিলেন তারেক মাসুদ। বানিয়ে ছিলেন ‘মাটির ময়না’, রানওয়ের মতো প্রথা ভাঙার সিনেমা। পথদ্রষ্টা তারেক মাসুদ নেই। তবে তার স্বপ্নটা মরেনি। জিইয়ে রেখেছেন তরুণরা।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, কামার আহমেদ সাইমন, আশরাফ শিশির, আবু শাহেদ ইমনরা হাঁটছেন সেই পথে। তাদের নির্মিত ছবিগুলো দেশের বাইরে আলোচিত হয়েছে। স্বীকৃতির খাতাটাও বেশ ভারী। ছবিগুলোকে বলা যায় ‘আন্তর্জাতিক সিনেমা’। আজ ভারত তো কাল আমেরিকা। পরশু আবার ইতালী। বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা সিনেমা। ছোট থেকে বড় সবধরণের উৎসবেই স্বীকৃতি অর্জনে নজির তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই।

সাম্প্রতিক কালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’ চলচ্চিত্রটি বেশ আলোচিত হয়েছে। কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিত হয় এটি। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় এশিয়া-প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড, ইতালি এশিয়াটিকা ফিল্ম মিডিয়া-২০১৩, দুবাই জুরি অ্যাওয়ার্ড, দুবাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘টেলিভিশন’।

আশরাফ শিশিরের অনুদানের সিনেমা, ‘গাড়িওয়ালা’ও ছুটছে দেশে দেশে। ইতালীর ‘দ্যা গলফ অব নেপলস ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভাল, যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ইতালির “দ্য গালফ অব নেপলস্ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, কানাডার ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব সাউথ এশিয়া’, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব রাজস্থান-২০১৪’, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘শারজাহ আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব’, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’, পাকিস্তানের ‘রাফি পীর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’, ইটালিতে ভিত্তেরিও ভেনেতো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, যুক্তরাষ্ট্রের ‘জুলিয়েন ডাবুক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’, শারজাহ্ ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস্ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পেয়েছে।

আবু শাহেদ ইমনের ‘জালালের গল্প’ দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরছে। ১৯তম বুসান চলচ্চিত্র উৎসব, ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত ৪৫তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব,ভারতের রাজস্থানে অনুষ্ঠিত সপ্তম জয়পুর চলচ্চিত্র, ইরানের ৩৩তম ফজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি পুরস্কৃত হয়েছে।

কামার আহমেদ সাইমনের ‘শুনতে কি পাও’ শুনেছে বিশ্ববাসী। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন প্রামাণ্য উৎসব জার্মানীর ডক-লাইপজিগের ৫৫তম আসরের ‘উদ্বোধনী ছবির’ আমন্ত্রণসহ জাপানের ইমায়াগাতায় ‘নিউ এশিয়ান কারেন্ট’, প্রামাণ্য উৎসব সিনেমা দু্য রিলে’, ‘মুম্বাই আন্তর্জাতিক উৎসবে জিতে নেয় শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য সর্ব্বোচ্চ পুরষ্কার।

আলোচিত হয়েছে মুরাদ পারভেজেরে ‘বৃহন্নলা’ও। জয়পুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ইতালিতে অনুষ্ঠিত ‘অ্যা ফিল্ম ফর পিচ ফেস্টিভ্যাল’-এ পুরস্কৃত হয়েছে।

এ ব্যাপারে নন্দিত নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বাংলামেইলকে জানালেন, ‘বাংলাদেশের অনেক ছবিই বিভিন্ন ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হচ্ছে। তবে আমি মনে করি ফেস্টিভালে পুরস্কার পাওয়ায় বড় কথা না। ভালো ছবি নির্মাণই বড় কথা। আমাদের এখনকার ছবিগুলো এখনো প্রথম সারির ফেস্টিভালে যায়নি। তবে আমি আশাবাদি। এটাও সত্য যে পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ছবিই পুরস্কার পায়নি।’

নানা ধরণের পুরষ্কার আমাদের সম্ভাবনার কথা বলছে। কিন্তু সংবাদে কখনো কখনো তার ভুল উপস্থাপন বিভ্রান্ত করছে দর্শকদের। ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করা যাক। ভারতের তামিলনাড়ুর জেলা শহরে ফিল্ম ফেস্টিভাল হচ্ছে। প্রেস্টিজ ইস্যুতে ভারতেরই অনেক নির্মাতাই সেখানে ছবি জমা দেন না। সেইখানে জমা পড়ল বিদেশী (বাংলাদেশী) ছবি। ব্যাপারটা আয়োজকদের জন্য অতীব গর্বের এবং সন্মানের। কারণ যেখানে দিল্লির নির্মাতারাই মুখ ফিরিয়ে নেয় সেখানে বিদেশী ছবি! উল্লেখ করার মতো প্রতিযোগিতা ছাড়াই একরকম ফাঁকা ফিল্ডেই গোল দিচ্ছে ছবিগুলো। কিন্তু পরদিন পত্রিকার শিরোনাম কি হচ্ছে? ‘ভারত জয় করলো অমুক ছবি’ কিংবা ‘তমুক ছবির ভেনিস জয়’- মিডিয়ায় যে কোন পুরস্কারের ক্ষেত্রেই এ ধরণের উপস্থাপন সম্প্রতি সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন এতে বড় অর্জনগুলোকেই ম্লান করা হচ্ছে। দর্শকদের কাছে যাচ্ছে ভুল বার্তা।

তরুণ নির্মাতাদের এক আড্ডায় সম্প্রতি এমনই সমালোচনার দেখা মিলল। কান পেতে যা শোনা গেল তা কিছুটা এমন- একজন শ্লেষ মেখে বললেন, ‘তামিলনাডুর জেলা শহরের ফিল্ম ফেস্টিভালে স্পেশাল মেনশন পুরস্কার পেলেই কি ভারত জয় হয়ে যায়? ভাস্কোদামা আমেরিকা জয়ের পরও এমন মাতামাতি হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে! ’

অন্যজন আবার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘আমরা আবেগপ্রবণ জাতি। কিন্তু একবারও ভেবেছি, আমরা নিজেরাই নিজের পায়ে কুড়াল মারছি। নিজের স্বার্থে ‘কানে যাচ্ছে অমুক সিনেমা’ টাইপের শিরোনামও দেখেছি। কিন্তু পুরো সংবাদ পরে জানা গেল, উৎসবের বাইরে একটা পর্দা ফেলে ছবিটি প্রদর্শন করা হবে। শিরোনামটা পড়েই পাঠকমাত্রই উপলদ্ধি করবে ছবিটি কানে পুরস্কার পেয়েছে। এককে তিন বানাচ্ছি। কিন্তু একবারও ভাবছি না এককে এক বলাই শ্রেয়। উল্টো অর্জনটাকে হাস্যকর পর্যায়ে নামিয়ে ফেলেছি। মুলা ঝুলিয়ে দর্শকদের ভালোবাসা আদায়ের বৃথা চেষ্টা করছি। আর পাঠকদের আবেগ নিয়ে খেলছে মিডিয়াগুলো ।’

এ প্রসঙ্গে জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারকী বাংলামেইলকে বলেন,  ‘ছবি সবাই বাইরে পাঠাতে চায়। কেউ প্রথম সারির ফেস্টিভালে। কেউ মাঝারিতে। না পারলে অনেকে অনুল্লেখ্যযোগ্য ফেস্টিভালেও পাঠায়। ফেস্টিভালে যাওয়াটা কোন বিষয় না। কিন্তু সংবাদপত্রের রিপোর্টিংটা ঠিক রাখা জরুরী। কখনো কখনো ছোট ফেস্টিভালকে বড় করে দেখানো হয়। এতে দর্শকদের জন্য ভুল সিগনাল দেয়া হয়। এই জন্য গণমাধ্যমের সচেতনতা দরকার। আমার তো মনে হয় ফেস্টিভাল সমন্ধে জানতে গুগলই যথেষ্ট। কোনটা বড় আর কোনটা ছোট ফেস্টিভাল সেটা সহজেই জানা যায়।’

স্বীকৃতি যেমনই হোক না কেন দেশি চলচ্চিত্রের এ বিদেশ যাত্রাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন সবাই। তবে স্বীকৃতির সঠিক উপস্থাপনে সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্বশীল আচরণ কামনা করছেন চলচ্চিত্র সংশিষ্টরা। (সুত্রঃ বাংলামেইল২৪)