তোত্তরি ইন্টারন্যাশনাল টাইম ফেস্টিভ্যালে অনেকদিন পর ভাত ও তরকারী বিক্রি করলাম । না, আমার কোন বাঙ্গালী হোটেল নাই এখানে । আমি কোন ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টেও চাকুরি করি না। অনেকদিন পর বলছি এই কারনে যে তিন চার বছর আগে একই ভাবে বিক্রি করেছিলাম বাংলাদেশী ভাত তরকারী। বাংলাদেশী মেনু বললেও চাল থেকে শুরু করে সব আনাজপাতি এখানকার। অবশ্য মুরগীর মাংস ব্রাজিলের।
জাপানীজ টাটকা মাংস ব্যবহার না করার কারন আছে, এক. হালাল না, যেটা ব্রাজিলের মাংসের প্যাকেটে ছুরির ছবি ও আরবি এবং ইংরেজিতে লেখা আছে হালাল ( আরবি পড়তে পারি না, মনে মনে ধরে নিয়েছে ) । যারা পড়ালেখা জানে না তারা চাকুর ছবি দেখেই বুঝে নেয় । দুই. জাপানের দামী মাংস ব্যবহার করলে ব্যবসা লাটে উঠবে! বাংলাদেশের চাল ব্যবহার না করার কারন অনেকটা সেরকমই। লাভ তো দুরের কথা পুজিও ফেরত পাবার জো থাকবে না! বিশ্ব যখন আই এস কে রুখতে বদ্ধ পরিকর, বাংলাদেশে যখন ওয়ার ক্রিমিনালদের বিচারে জাতিটাকে দুভাগে ভাগ করেছে, তখন আমার এই ভাত তরকারির বেচায় লাভ হল নাকি লোকসান হল এই খবর পড়বার মানুষ কই? তবু লিখব! কেননা এই কাজগুলো করলেই নিজেকে বাঙ্গালী বাঙ্গালী মনে হয়। সারা বছর তো নকল জাপানীজ সেজে কাটাতে হয়।
বাংলাদেশে থাকতে আমির খানের একটা ছবি দেখেছিলাম । হাম হে রেহি পেয়ার কি । সেটাতে একটা জাপানীজ ক্যারেকটার ছিল। নিজেকে ঐ চরিত্রটার সাথে কোন পার্থক্য খুজে পাই না। তখন খুব হেসেছিলাম চরিত্রটা নিয়ে, এখন আমার দৈনন্দিন কার্যকলাপে যে কোন বাঙ্গালী হাসবে । আনাজপাতি বলতে আলু আর গাজর। খেয়াল করিনি কোথাকার প্রোডাক্ট । মনে হয় জাপানীজ । হোক্কাইডোতে নাকি প্রচুর গোলআলু হয়। মসলা অবশ্য বাংলাদেশ থেকে আমার উনি এনেছেন। নিজে দাড়িয়ে থেকে গুড়ো করে এনেছেন বলে দাবি করলেন অনেকবার। মরিচের গুড়ো বাংলাদেশের প্রোডাক্ট কোন সন্দেহ নাই ! তবে ধনিয়া ও জিরা কোথাকার তা বলতে পারব না। আর গরম মসলা সেটা তো চোখ বন্ধ করে বলা যায় ওগুলো বাংলাদেশের না। আমরা জিহ্বার স্বাদ ভাল বুঝলেও গরম মসলার চাষাবাদের বেলায় বুঝি কম। আমদানীর উপরেই নির্ভর করতে হয় আমাদের জিহ্বার স্বাদকে লালনপালন করতে । টুনা মাছের চপ ছিল সাইড মেনু হিসেবে, টুনা মাছের ডিব্বা চিলির প্রোডাক্ট ছিল। বাঙ্গালী মেনু না বলে ইন্টারন্যাশনাল মেনু বলাই ভাল। দোকান দিয়েছিলাম এখানকার এক ইন্টারন্যাশনাল টাইম ফেস্টিভেলে। গত তিন বছর দেয়নি, শেফের অভাব ছিল। উদ্যোগ এবার শেফের উদ্যোগটাই প্রখর ছিল । আমারো না ছিল না। একই ধরনের রুটিন কাজ করতে করতে হাফিয়ে উঠেছি। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশী এখানকার প্রোগ্রামগুলোতে। আবেদন কর, প্রোগ্রামের আগে হাজিরা দাও, মানে নিয়ম কানুন জেনে নাও, ইনগ্রেডিয়েন্টস কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তার বিবরন দাও, কত কিছু! প্রোগ্রামের আগের দিন সকাল থেকেই বিয়ে বাড়ীর মত আয়োজন চললো। তন্দুরীর মাংসগুলোকে একদিন আগে থেকে মেরিনেট না করলে নাকি মজা হয় না । বাসার ওভেনে রান্না করলে রান্না শেষ হবার আগেই প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যাবে। আয়োজক কমিটিকে জানাতেই বড় ওভেনের ব্যবস্থা করে দিল। রাত একটা পর্যন্ত খেটে কিছুটা গোছানো হয়েছে বলে মনে হল। বাকি রইল মুরগির তরকারী । অনুষ্ঠানের দিন সেটাও রান্না হল। রান্না শেষে দেখা গেল ঝাল একটু বেশীই হয়েছে। কি আর করা চিনির কিছুটা ব্যবহার হল। কর্মঠ শুধু আমরা স্বামী-স্ত্রী। ছেলেকে পার্টটাইমার হিসেবে নিয়োগ দিলাম। টাকা পয়সার মুল্য বোঝার বয়স হয়েছে তাই সহজেই রাজি হয়ে গেল ( বাসায় নিজের থালাটাও পরিষ্কার করে না )।
বাংলাদেশকে উপস্থাপন করছি বাংলাদেশের পতাকা ছাড়া হয় নাকি। একখানা কালেকশনে ছিল কিন্তু সময়মত সেটাকে আর পাওয়া যাচ্ছিল না । বিষন্নমনে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলাম । উপরওয়ালা মনে হয় আমার কষ্টটা বুজেছিলেন, স্টলে ঢুকেই দেখি বিশাল আকৃতির একখানা লাল সবুজ পতাকা সাজিয়ে রেখেছেন আয়োজকরা। মনে স্বস্তি আসাতে পূর্নউদ্দমে বেচাবিক্রিতে মন দিলাম। আমাদের স্টলের ডানপাশে চায়নিজদের কিচির মিচির বামপাশে তাইওয়ানীদের চুং চাং এর সাথে সাথে বাহিরে ওপেন স্টেজ থেকে বাদ্যযন্ত্র ও গানের শব্দ কানে আসছিল। বৌ এবং বেটা গলা ফাটিয়ে বলছিল ” ইরাশশাইমাসে ইরাশশাইমাসে ” ( আসেন ভাই ! আসেন ) ।
আমি প্যাকেট করছি কারি-রাইস কিন্তু আমার কানে আসছে ” হাই রাজশাই রাজশাই “। ছেলে এমনিতেই একটু লাজুক স্বভাবের , আজ টাকার গন্ধে লাজ ভেঙ্গে পরিষ্কার জাপানী ভাষায় আহ্ববান জানাচ্ছে ক্রেতাদের। বৌ তার আধো ভাঙ্গা জাপানিজে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছিল । ছেলে মাঝে মাঝে টাকা গুনছে আর জানতে চাচ্ছে লাভ হল কিনা? আমি টিসু দিয়ে কপালের ঘাম দুর করছি আর সাহস দিচ্ছি ” লাভ হবে! ” ঘাম বেশীক্ষন মোছা লাগল না, ভাত তরকারি শেষ হল খুব দ্রুত। প্লাস্টিকের ক্যাশ বাক্স দেখে বৌ মুচকি হাসি দিল এবং জাহির করতে লাগল তার ইরাশশাইমাসের কারনে লোকজন বেশী এসেছে। ছেলে জানতে চাইল তার মজুরি কত। আমার মাথায় শুধু ইনভেসমেন্টের টাকার পরিমানটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। লাভ ভালই হয়েছিল । বেচাবিক্রি শেষ হওয়ায় অন্য স্টলগুলো দেখতে বের হলাম। মোটামুটি সবাই ক্যাশবাক্স গোছানোয় ব্যস্ত।
মালয়েশিয়ান স্টলে দেখলাম জিলাপীর আকৃতির পিঠা বানাচ্ছে। অনেকটা ছিটারুটির মত! সময় লাগবে জেনে টেস্ট আর করা হয়নি। তিনটার দিকে ক্লোজিং শেরেমনির জন্য ডাকা হল সবাইকে। আয়োজকদের একজন ব্যাখ্যা করলেন war এবং peace শব্দ দুটো । war এর ব্যাখ্যা করলেন এভাবে weapon, anger এবং rape থাকবে এবং থাকে যুদ্ধ গুলিতে। আমি একটু খটকায় পরে গেলাম। অর্থনৈতিক ব্যাপার মানে লাভ লোকসান থাকবে না যুদ্ধে সেটা আবার কেমন কথা। মনে মনে নিজেকে সান্তনা দিলাম এই বলে যে, এখন মডার্ন যুগ। মডার্ন যুগে money টা যোগ করেছে যুদ্ধে। peace এর ব্যাখ্যা দিলেন ” People Everywhere Acting for Cultural Exchange ” বলে। পৃথিবীর মানুষ আজ exchange এর চেয়ে লাভ খোঁজে। এখানকার আয়োজকরা হয়ত এইসব ছোটখাট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি আসুক এই কামনাই করছেন। আমরাও চাই মানুষ ধর্ম,বর্ণের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে শান্তিতে বসবাস করুক।
(মোঃ মাহবুবর রহমান তোত্তরি, জাপান, ,লেখক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার)