অনলাইন ডেস্ক: ১৬ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬
প্রায় দেড় হাজার গানের স্রষ্টা আবদুল করিম ১৯১৬ সালে সিলেটে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকসহ অসংখ্য পদকে ভূষিত হয়েছেন।
তাঁর গান বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের আঙিনা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে দেশের বাইরেও।
নাটক, চলচ্চিত্র এবং হালের জনপ্রিয় ব্যান্ড শিল্পীদের কণ্ঠে তার গান পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা।
কিশোর বয়স থেকেই গানের চর্চা শুরু হলেও, বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে শাহ আব্দুল করিমের গানের বিস্তার ঘটে মূলত গত শতকের শেষদিকে।
শাহ আব্দুল করিম বেড়ে ওঠেন সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায়।
শুরুর দিকে সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় মালজোড়া গান গাইতেন।
তাকে নিয়ে তৈরি একটি প্রামাণ্য চিত্রে তিনি বলেছেন, “আগে তো রেডিও টিভি ছিল না। আমরা মালজোড়া গান গাইতাম। দুইজনে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে গান গাইতাম”।
শুরুর দিকে ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছে আব্দুল করিমের গান বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও, সিলেটের বাইরে সারাদেশের মানুষের কাছে তা পৌছায় আরও পরে।
বেশ কয়েকজন শিল্পী শাহ আব্দুল করিমের গান নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
আর দেশব্যাপী পরিচিতি পান সিলেটের এই বাউল শিল্পী।
যেকজন শিল্পী তার গান ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন সেলিম চৌধুরী, প্রবাসী শিল্পী কায়া, হাবিব ওয়াহিদ, মমতাজ, শাহনাজ বেলী তাদের মধ্যে অন্যতম।
সিলেটে অঞ্চলের মৌলভীবাজারে বেড়ে ওঠা শিল্পী সেলিম চৌধুরী দীর্ঘদিন লোকসঙ্গীতের চর্চা করছেন।
তিনি বলছিলেন, তিনি শাহ আব্দুল করিমের গান অল্প বয়স থেকেই শুনে আসছিলেন বেতারে।
তবে তিনি নিজে তার গান প্রথম গান ১৯৯৪ সালে।
তার রূপসাগর অ্যালবামে “কুঞ্জ সাজাও গো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে” এই গানটি তার গলায় শাহ আব্দুল করিমের প্রথম গান।
এরপর ব্যাপক সাড়া মেলে বলে জানান তিনি।
আব্দুল করিম নিজেও তাকে সে বিষয়ে জানিয়েছিলেন বলে সেলিম চৌধুরী জানান।
শাহ আব্দুল করিমের গান ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অবদান ছিল।
তিনি এই শিল্পীকে নিয়ে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন।
এছাড়া তার নাটকেও এই বাউল শিল্পীর গান স্থান পায়।
এ বছর শাহ আব্দুল করিমের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে এ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি।
এই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক লেখক ও স্থপতি শাকুর মজিদ। তিনি বাউল শাহ আব্দুল করিমের জীবন ও সঙ্গীত নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন।
ভাটির পুরুষ নামে সেই চিত্রে উঠে এসেছে এই বাউল শিল্পীর জীবনের নানা দিক।
এই তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে এই বাউল শিল্পীকে টানা সাতটি বছর সরাসরি কাছ থেকে দেখেছেন নির্মাতা শাকুর মজিদ।
তিনি বলেন, শাহ আব্দুল করিম তার কাছে একজন রহস্যময় চরিত্র।
অভাব-অনটনের সংসার ছিল।
অল্পবয়সেই মুদি দোকানে কাজ, রাখালের কাজ করেছেন।
পরে গলায় সুর ছিল। গান শুরু করেন। তিনি লেখাপড়া করতে পারেননি।
একবার তাকে গান গাওয়ার কারণে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়।
একটা বড় সময় পালাগান গেয়েছেন।
বড় বড় রাজনৈতিক সমাবেশেও তিনি গান গাইতেন।
সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীরে বেড়ে উঠা আব্দুল করিমের গানে ভাটি অঞ্চলের মানুষের সুখ দু:খ প্রেম-ভালোবাসার সাথে সাথে দেহতত্ত্ব ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা উঠে আসে।
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছ’, তার এরকম অসংখ্য গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার গান বেছে নিয়েছে জনপ্রিয় অনেক ব্যান্ডের শিল্পীরাও।
তার প্রথম স্ত্রী আফতাবুন্নেসার নামে আফতাব সঙ্গীত রচনা করেন তিনি।
তার লেখা গান ইংরেজি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে।
বেশকিছু গানের বইও প্রকাশিত হয়েছে।
দারিদ্রের কারণে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেননি।
স্কুলে গিয়েছিলেন কয়েক দিন মাত্র।
পরিবেশ ও সমাজ থেকেই শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন।
তবে গানের দীক্ষা নিয়েছেন পূর্ববর্তী বাউল গুরুদের কাছে।
শাহ আব্দুল করিমকে নিয়ে একটি মঞ্চনাটকও রচনা করেছেন শাকুর মজিদ।
এখন তার গানের সাথে আধুনিক যন্ত্রানুসঙ্গের ব্যবহারের মাধ্যমে ভিন্ন রূপ দিচ্ছেন আধুনিক কালের শিল্পীরা।
বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে তা পৌঁছে গেছে আরও দূরে।
২০০৯ সালের মারা যান শাহ আব্দুল করিম।
তার গান নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা মনে করেন, বাউল গানের ইতিহাসে হাসন রাজা কিংবা লালন শাহের পরবর্তী প্রতিনিধি হিসেবে বাউল শাহ আব্দুল করিমের নামটিই এখন উঠে আসে। (সুত্রঃ বিবিসি)