বিদেশে ঈদ এবং আমরা

বিদেশে ঈদ এবং আমরা

ঈদের স্পেলিং নাকি ‘ইদ’ হয়েছে । ‘ঈদ’ হোক আর ‘ইদ’ হোক আমাদের কাছে সবই সমান । চাঁদ ‘ঈ’ এর বাঁক দিলো কি ‘ই’ এর মত সোজা হলো, সেটা দেখার সময় কোথায় রোবটিক লাইফে ! পারমানেন্ট মিস্ত্রীর গড়া এই দেহখানায় জাপানীরা জাপানী চিপ বসিয়ে মডিফাই করেছে । উপরওয়ালার চাবি তো দেয়া আছেই , সাথে লিথিয়াম ব্যাটারিও বসিয়ে দিয়েছে যাতে জনম ভইরা ঘুরার জন্য পাওয়ার ফেইলর না হয় । ঈদের আনন্দ আমাদের এখন অরোরা দেখার মত । সেই বছরের ঈদের ভাগ্য ভাল থাকলে আনন্দ হয় নতুবা অপেক্ষা করেও অরোরা দেখতে না পারার মত মন খারাপ হয় । ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসে ততই সাদামাটা স্মৃতিগুলো রিমাইন্ডার পাঠায় স্ক্যান করার । নিয়ে যায় সেই সব সময়গুলোতে !

পড়ি তখন ভার্সিটিতে । আমাদের গ্রামে তিনজন ভার্সিটির ছাত্র । তিনজনের দুজনই আবার আব্বার হাতেগড়া ছাত্র । অন্যজন আংশিক । আব্বার গর্বের উৎসটা মনে হয় সেখানেই । তিনজনের একজন ইতোমধ্যে কোকিল কন্ঠি উপাধি পেয়েছেন । কেননা শেষ ঈদে তার বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়েছে গ্রামবাসি । আব্বা আমাদের দুজনকে ডেকে বললেন ” সামনের ঈদে তোমাদের ভাষন চাই ” । মনে হল বজ্রপাতের কেন্দ্রবিন্দু খানা আমার মস্তিষ্কের ঠি ক সেন্টার পয়েন্টে । স্কুল জীবনে আব্বার লিখে দেয়া বক্তৃতা তোতাপাখির মত আওরিয়ে ভাষন অনেক দিয়েছি । সেইসব জায়গায় গ্রামের সহপাঠীদের কেউ থাকতো না । সহপাঠীদের সামনে ভাষন দিতে যেয়ে ভুল করলে হাসির রোল যে পরবে সেটা বলা যায় নির্ধিদায় । বক্তৃতা দিয়েছিলাম, বন্যার কারনে বেড়ীবাধের অস্থায়ী মাঠে । বেড়ীবাধ এমনিতেই উচু তবে ভাষন দেবার সময় আমার অবস্থান মনে হয় আর উচুতে ছিল । এক পোয়া ওজনের মাইক্রোফোন আমার হাতে পাচ সের ওজনের ডাম্বেলের চেয়ে বেশী মনে হয়েছিল । নিজের ওজন প্লাস মাক্রোফোনের ওজন আপেল পতনের সুত্রকে হার মানিয়ে আমাকে শুন্যে ভাসিয়েছিল । আমার সেই বেহাল অবস্থা দুলাভাইদের দুএকজনের চোখকে ফাকি দিতে পারে নি । টি প্পনি কেটেছে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় ।

দেশ ছাড়ার আগেই আব্বাকে হারিয়েছি । আব্বার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মাঠের নামাজের জায়গাখানা এখন নদীগর্ভে । মৎসকুল হয়তোবা মাঠের জায়গাতে একত্রিত হয় আমাদের ঈদের সময়কার মত । চটের বিছানায় বসে পশ্চাতদেশ ভিজে যাবার চিন্তা ওদের নেই । গ্রামের বড় ভাইদের চাদর হাতে নিয়ে কালেকশনের দৃশ্য দেখিনা অনেকদিন । ঈদের দিন মাইকে সকাল থেকে ইসলামি গানের জায়গায় স্থান নিয়েছে জাপানী ভাষার সতর্কবাণী । যেটা কিনা ঋতু ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় । গ্রীষ্মকালে হিট স্ট্রোকের সাবধানতার ঘোষনা থাকলে শীতে থাকে নিউমোনিয়ার হাত থেকে বাচার টি পস ।

চটের জায়গায় স্থান নিয়েছে দামি ইরানি কার্পেট । বাংলা ওয়াজের জায়গায় মাল্টি উচ্চারনের ইংরেজি ভাষন । এখানে মওলানা সাহেবরা পাগড়ি পরেন না । কালারফুল টি শার্ট পরেই খোতবা পরান । খোৎবার বইখানার জায়গা নিয়েছে স্মার্টফোন কিংবা প্রিন্টেড কাগজ । কোলাকুলি করি, তবে আকৃতিতে ভারসাম্যের অভাব পরিলক্ষিত হয় । সুদানিদের জায়ান্ট বডির কাছে নিজেকে লিলিপুট মনে হয় । গালিভার না হলেও মালেশিয়ানদের কাছে নিজেকে একটু লম্বাই মনে হয় ।

কচুর পাতা দিয়ে বানানো সাবানদানির সুগন্ধী সাবান এখন বোতলের লিকুইড সাবানে সেরে ফেলি । পুকুরে ডুব দিয়ে গোসলের কাজখানা এখন বাথটাবে কিংব ঈষৎ গরম পানির শাওয়ারে সেরে নেই । আতরের জায়গা এখন পারফিউমের দখলে । সুরমা আর টানা হয়না চোখে !

বক্তৃতা আর দেই না । মাঝে মাঝে ঈদের নামাজও হার মানে অফিসের চাহিদার কাছে । ওয়াজের জায়গায় বসের ফরমায়েশ শুনি ঈদের দিনে । মাঠে ওয়াজ দেবার পরিবর্তে কাজের প্রোগ্রেস শোনাই অফিসের সিনিয়রদের !

হাল ছাড়িনি ! স্বপ্ন দেখেই চলেছি! ক্ষনের অপেক্ষা করছি যখন আবার বন্ধুদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে নামাজ আদায় করতে পারব !

( মোঃ মাহবুবর রহমান , তোত্তরি, জাপান )
( মোঃ মাহবুবর রহমান ,
তোত্তরি, জাপান )