জীবনে এতোবার সুচিত্রা সেনের নাম শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। যদিও যতোবার সুচিত্রা সেনের নাম শুনেছি, ততোবারই সাথে উচ্চারিত হয়েছে উত্তম কুমারের নাম! উত্তম সুচিত্রা, বা সুচিত্রা-উত্তম যেনো একে অপরের পরিপূরক। একটি নাম ছাড়া আরেকটি নাম যেনো প্রায় অকেজো, কিংবা একটি নামের সাথে আরেকটি নাম এমনভাবে মিশে আছে যে, উত্তম-সুচিত্রা বললে একটি পূর্ণাঙ্গ নাম বোঝায়। পৃথিবীর আর কোনো সিনেমায় এমন প্রভূত জুটির কথা জানা নেই। যাক, মহা নায়িকা সুচিত্রা সেনকে নিয়ে কথা বলতে এসে জুটি বিষয়ক কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
তখনো কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা কে, কিংবা মহানায়ক উত্তম কে তাদের চিনি না। কিন্তু সাদাকালো টিভির পর্দায় বিটিভির ছায়াছন্দ নামের এক অনুষ্ঠানে প্রায়ই একটা গান দেখি। রোমান্টিকতার প্রাথমিক জ্ঞান না থাকলেও ওই সময়ে গানটা ভেতরে ভেতরে অন্যরকম এক ভালো লাগা তৈরি করে। বাঙালি মাত্রই গানটা তাদের কাছে সুপরিচিত। মফস্বলের এক খোলা মাঠ, আঁকাবাঁকা সড়ো অথচ সুশ্রি এক রাস্তা, তার মাঝখান দিয়ে মন্থর গতিতে গাছপালা পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে একটা বাইক; আর বাইকে বসে বসে এক মায়াবী চেহেরার নারী-পুরুষ গাইছে, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো/ যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলোতো’। এই গান দেখে শিহরিত হয়নি, রোমাঞ্চিত হয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। যার ভেতরে নূন্যতম রোমান্টিসিজম নেই, তিনিও যদি শুধুমাত্র এই গানটি দেখেন, নিশ্চিত করে বলা যায় তার হৃদয় অন্তত একবারের জন্য হলেও মোচড় দিয়ে উঠবে। বহুবার, অসংখ্যবার এই গান শুনলে বা দেখলে সামান্যতম সময়ের জন্যও বিরক্তি আসে না। এ এক অদ্ভুত অসাধারণ আধুনিক বাঙলা গান!
সময় বয়ে যায়, দেশি-বিদেশি, নতুন আর পুরনো সিনেমা দেখি, নায়ক নায়িকাদের চিনতে থাকি; হঠাৎ একদিন ‘সপ্তপদী’ সিনেমাটা পেয়ে যাই। আপ্লুত হই, বিটিভির ছায়াছন্দের অনুষ্ঠানে দেখা সরো রাস্তার সেই মোটর বাইক ওয়ালা আর মায়াবী চেহেরার সেই নায়িকার ঠোঁটে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গাওয়া সিনেমাটা দেখার প্রবল আগ্রহের একটা সুরাহা হয়।
গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জুটি উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘সপ্তপদী’ ছবিটি। ছবিটি দেখার পর মনে হয়, আহা, সম্পুর্ণ সিনেমা বলতে যা বোঝায় তা বুঝি এরকমই হওয়া উচিত। শুধুমাত্র একটা সাইট ভালো হলেই নয়, একটা কমপ্লিট সিনেমা সবদিকেই ভালো করবে, সপ্তপদী’র মতো। কি অভিনয়, গান, সংলাপ, দৃশ্য ধারণ আর ছবির গল্প; সব দিক থেকেই এক অসাধারণ মানের রোমান্টিক ছবি সুচিত্রার ‘সপ্তপদী’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে ষাটের দশকের শুরুর দিকে প্রখ্যাত নির্মাতা অজয় কর নির্মান করেন এই সিনেমা।
ষাটের দশকে নির্মাণ হলেও সপ্তপদী’র প্রেক্ষাপট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার। ভিন্ন ধর্মের দুই প্রেমিক-প্রেমিকার সামাজিক টানাপড়েন, বিবাধ, ধর্ম বিশ্বাস, অতঃপর ধর্মকে ছাপিয়ে প্রেমের জয়জয়কার সবই উঠে আসে সিনেমাতে।
এ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ান রীনা ব্রাউন(সুচিত্রা সেন) আর কৃষ্ণেন্দু(উত্তম কুমার) তারা একই মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করে। দুজন দুই ধর্মের মানুষ। কলেজে একদিন এ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ান ও ভারতীয়দের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেই খেলাকে কেন্দ্র করে রীনা ব্রাউনের সাথে চরম বাদানুবাদ ঘটে কৃষ্ণেন্দুর। দলবল পাকিয়ে যা তা একটা অবস্থা। কিন্তু এই বিরোধপূর্ণ অবস্থা তাদের মধ্যে বেশি দিন আর স্থায়ী হয় না। তারপর তাদের কলেজে আয়োজন করা হয় সেক্সপিয়রের নাটক ‘ওথেলো’ প্রদর্শনীর, আর তাতে কেন্দ্রিয় চরিত্রে অভিনয় করতে হয় কৃষ্ণেন্দু আর রীনা ব্রাউনকে। কলেজে এই নাটক মঞ্চস্থকে কেন্দ্র করে তারা পরস্পর কাছাকাছি আসে। তাদের মধ্যে তৈরি হয় ভালো লাগা। ভালো লাগা থেকে একসময় প্রেমে জড়িয়ে পড়ে ভিন্ন ধর্মের রীনা ব্রাউন আর কৃষ্ণেন্দু। তারা তাদের জাত-ধর্ম ভোলে ভাসতে থাকে প্রেমের হাওয়ায়। অজানা পথে হারিয়ে যেতে চায় তাদের মন। হারিয়ে যেতে যেতে তারা গুনগুনিয়ে উঠে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’।
রীনা ব্রাউন আর যুবক কৃষ্ণেন্দুর অমলিন ও প্রাকৃত প্রেমে নেমে আসে বাধা। কৃষ্ণেন্দু স্কলার পাওয়া মেধাবী যুবক বলে রীনা ব্রাউনের বাবা তাদের প্রেমকে মেনে নেয়, তবে কৃষ্ণেন্দুর উপর শর্ত থাকে যে, রীনাকে বিয়ে করতে হলে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে তাকে খ্রিস্টান হতে হবে। কৃষ্ণেন্দুও এক পায়ে রাজি, রীনাকে পাওয়ার জন্য শুধু ধর্ম কেনো সে নিজেকেও ত্যাগ করতে পারে! কিন্তু ফের তাদের প্রেমে বাধা আসে, এবার বাধা হয় গ্রামে বাস করা হিন্দু গুঁড়া ব্রাহ্মণ কৃষ্ণেন্দুর পিতা। কৃষ্ণেন্দুকে না বোঝাতে পেরে তার ব্রাহ্মণ পিতা চুপিচুপি রীনা ব্রাউনের সাথে দেখা করে, কৃষ্ণেন্দুকে ভিক্ষা চায়; যাতে কৃষ্ণেন্দুকে ধর্মান্তরিত না করে। রীনা ব্রাউন ভেতরে ক্ষতাক্ত হয়, কিন্তু তবুও কৃষ্ণেন্দুর বাবাকে কথা দেয় যে সে কৃষ্ণেন্দুকে বিয়ে করবে না। নিশ্চিত মনে কৃষ্ণেন্দুর বাবা গ্রামে ফিরে যায়। অন্যদিকে কৃষ্ণেন্দুর বাবাকে দেয়া কথামত ভেতরে যন্ত্রণার ক্ষত নিয়ে ঠিকই কৃষ্ণেন্দুকে ত্যাগ করে রীনা। তাকে ফিরিয়ে দেয়, অপমানিত হয়ে কৃষ্ণেন্দুও ফিরে যায়।
কিন্তু এতোসব কিছুর পরেও রীনার বাবাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা রক্ষা করে কৃষ্ণেন্দু, কথামত নিজের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করে সে। এ এক মহা প্যারাডক্স। সিনেমায় এ এক অন্যরকম ঘোর।
কেউ কারো ঠিকানা জানে না, প্রেমের রাজ্য গড়ার স্বপ্ন দেখা কৃষ্ণেন্দৃ-রীনা একে অন্যের থেকে হারিয়ে যায়। স্বপ্নের রাজ্যে নেমে আসে অসীম শূন্যতা। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধাহতদের জন্য প্রয়োজন হয় ডাক্তারের। রীনা যোগ দেয় সেখানে। ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে রীনা ব্রাউনের জীবন। অপ্রাপ্তি, বঞ্ছনা আর গ্লানিতে রীনা ব্রাউনের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। বাজে অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ে সে। ধর্মজ্ঞান ভোলে মদ্যপান করে অসুস্থ হয়ে একদিন আশ্রয় চায় গ্রামের ফাদারের কাছে। আশ্চর্য হয়ে সেই ফাদারকে দেখে রীনা। এটা যে আর কেউ নয়, স্বয়ং সেদিনের সেই মটর বাইক চালানো লোকটা! হ্যাঁ, স্বয়ং কৃষ্ণেন্দুকেই দেখতে পায় রীনা ব্রাউন। ধীরে ধীরে কাহিনীর জট খুলতে থাকে। খোলাসা হয় সব। কৃষ্ণেন্দুর বাবাও বুঝতে পারে ধর্মের চেয়ে প্রেম বড়ো, মানুষ বড়ো। শেষ পর্যন্ত প্রেমের শাশ্বত রূপটিই প্রতিষ্ঠা পায় রীনা-কৃষ্ণেন্দুর মিলনের মাধ্যমে।
সিনেমার মধ্য দিয়ে একটা ঘোরতর প্যারাডক্সও কিন্তু লক্ষ্য করি আমরা। এই যেমন, সিনেমার শুরুতে ধর্ম বিশ্বাসী রীনা ব্রাউনকে সিনেমার শেষে এসে ধর্ম আর ঈশ্বরে অবিশ্বাসী আর অন্যদিকে, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী কৃষ্ণেন্দুকে শেষপর্যন্ত একেবারে আপাদমস্তক আস্তিক হিসেবে পাওয়া! সপ্তপদী সিনেমাটি শুধু কাহিনীর জন্য নয়, বরং অভিনয়ে যে সতস্ফুর্ততা আমরা সুচিত্রা এবং উত্তমের মধ্যে দেখি তা এই কালে এসেও প্রায় অসম্ভব। অভিনয় দিয়ে সুচিত্রা সপ্তপদী’তে এক মহান কীর্তীও গড়েছেন। ভারতীয় প্রথম কোনো অভিনেত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আদায় করেছেন এই সপ্তপদী –তে অভিনয় করে। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার প্রাইজ সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন তিনি।
শুধু সিনেমায় নয়, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে সময়কে জয় করার জন্য প্রতিটি দশকে থাকে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা শিল্পী। তার প্রতিভা আর মেধা দিয়ে তিনি অন্যদের থেকে এগিয়ে যান, সমকালিন সময়কে উতরিয়ে তিনি পৌঁছে যান অদূর ভবিষ্যতের কোনো জৌলুসময় গন্তেব্যে। তিনিই মহৎ শিল্পী। তারপর হয়তো সময়ই তাকে মহা নায়িকা, মহা শিল্পী, কিংবদন্তী ইত্যাদি নামে অবিহিত করে। বাংলার মহা নায়িকা খ্যাত সুচিত্রা সেনও তেমনি একজন। নিজের সৃজনক্ষমতায় অভিনয় দিয়ে তিনি শুধু তার সমকালিন সময়ের গন্ডিই অতিক্রম করেননি, বরং পৌঁছে গেছেন আরো দূর, বহুদূরের পথে। যে পথ সত্যি সত্যিই শেষ হওয়ার নয়…
অনলাইন ডেস্ক, ৬ এপ্রিল (প্রকাশ : ৬ ই এপ্রিল, ২০১৫)