প্রেক্ষাপটঃ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এবং “একুশে’র বিশ্বায়ন” -(চতুর্থ পর্ব)

প্রেক্ষাপটঃ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এবং “একুশে’র বিশ্বায়ন” -(চতুর্থ পর্ব)

টুয়েন্টি ফাস্ট (একুশে) ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”। বিশ্বসমাজ কর্তৃক অন্যান্য আন্তর্জাতিক দিবসগুলির মতই একটি পালনীয় দিন। আন্তর্জাতিকভাবে পালিত অন্যান্য দিবসগুলির মতই এই দিবসটি একটি দিবস হলেও এর তাৎপর্য গুরুত্ব অন্যান্য দিবসের থেকে আলাদা এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এই দিবসটি একমাত্র আন্তর্জাতিক দিবস, যার গুরুত্ব এবং অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে বিশ্বের প্রতিটি সভ্য সামাজিক মানুষের কাছেই সমান ও মর্যাদাপূর্ণ, এবং নিজ নিজ সত্ত্বা-অস্তিত্বের ধারাকে আগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে বহনের অনুপ্রেরণার ভিত্তি। অন্যকোন আন্তর্জাতিক দিবসের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি সভ্য মানুষেরই স্বার্থ-সত্ত্বা এবং অস্তিত্ব এভাবে প্রত্যক্ষ এবং নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত নয়, যেমনটি রয়েছে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” এর ক্ষেত্রে। আধুনিক সমাজে বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির ক্রমোত্থানের সাথে একমাত্র এই দিবসটি পালনের মাধ্যমেই বিশ্বের প্রতিটি সভ্য-সামাজিক মানুষ তার নিজ নিজ পূর্বপুরুষদের সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যোগসূত্র স্থাপন এবং সংরক্ষণের সেতুবন্ধন নিশ্চিত করতে পারে, এবং এই দিবসটি পালন বা উদযাপনের মধ্য দিয়েই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আদি সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ক্রমবিকাশের ধারার সাথে আধুনিক সভ্যতা ও প্রযুক্তির সংযোগ সুসংহত করার সুযোগ চিত্রিত। মানুষ প্রজাতির তথা মানব সমাজ-সভ্যতা-শিক্ষার প্রচার, প্রসার, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং আধুনিক বিশ্বায়নের সবকিছুই কোন না কোন একটি ভাষার মাধ্যমেই কালের ক্রমধারায় বিকশিত-বিবর্তনের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েই বর্তমান সভ্যতায় উন্নীত। সভ্যতার শুরু থেকে প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা সমৃদ্ধির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদানের সমন্বিত ফসল আজকের সুন্দর ডিজিটাল এই পৃথিবী, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ-সভ্যতা। এতদসত্বেও ‘জীবন মানেই এগিয়ে চলা’ এই জৈবনিক বৈশিষ্টে নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত মানুষ দ্রুত অবক্ষয়মান ভাষা সমূহের অবলুপ্তির ভয়াবহ ধারা রোধে ইউনেস্কো ঘোষিত এই দিবসটি যেভাবে পালিত হওয়া প্রয়োজন বা জরুরী, সেভাবে বাংলাদেশ ব্যাতিত অন্যভাষাভিত্তিক কোনজাতি বা দেশে দিবসটি উদযাপন হচ্ছে না। এমনকি বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া অবলুপ্তির করাল গ্রাসে নিমজ্জিত ভাষার মানুষের কাছেও দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় পরও “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” উদযাপনে ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তের বার্তা পৌঁছায়নি। বিশ্বব্যাপী ভাষা অবক্ষয়ের ভয়াবহ অধগতির সাথে তুলনা করলে বলা যায় “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” পালনের সিদ্ধান্তের আলোকে ঢাকায় “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিউট” প্রতিষ্ঠা এবং কার্যক্রম হিসেবে অবলুপ্তি বিষয়ক গবেষণার সীমিত গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ; তাছাড়া অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্র সকল ভাষাভাষীদের কাছে পৌঁছে দেয়াসহ তাদেরকে সম্পৃক্ত করার মত বাস্তবভিত্তিক কার্যকরী কোন ব্যবস্থাই অদ্যাবধি গৃহীত হয়নি।  এমনকি বাংলাদেশ ব্যতীত অন্য কোন জাতিসংঘের সদস্যদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি উদযাপন করা বা এই দিবসের প্রেক্ষাপটে মাতৃভাষা রক্ষার প্রয়োজনে বিশেষ কোন ব্যাবস্থা গ্রহণের উল্লেখযোগ্য নজির নেই। আরও বিস্ময়কর হল যে, অবক্ষয়ের এই চলমান ধারায় প্রতি পক্ষে(১৫ দিনে) পৃথিবী থেকে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাওয়ার ফলে এই শতাব্দীর শেষে বিশ্বে বর্তমানে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা অর্ধেকে দাঁড়ানোর মত ইউনেস্কোর সুনির্দিষ্ট গবেষণা ভিত্তিক পূর্বাভাষ থাকা সত্বেও ভাষা সুরক্ষাকারী সাধারন ভাষাভাষীদের কাছে বিষয়টি জ্ঞাত নয়।

সাধারণ গবেষণা এবং বিশ্লেষণে দেখা যায়, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে ইউনেস্কো কিভাবে, কেন অথবা কিসের ভিত্তিতে ‘টুয়েন্টি ফাস্ট(একুশে)ফেব্রুয়ারি’কে গ্রহন করেছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য বা ব্যখ্যা বাস্তবক্ষেত্রে ইউনেস্কোর কোথাও দৃশ্যমান নয়। ইউনেস্কোর ত্রিশতম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে (১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯)এই বিষয়ে গৃহীত মূল প্রক্লেমেশনে (#30C/DR.35; page35) প্রস্তাবক রাষ্ট্র হিসেবে যৌথভাবে বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবের নাম, এবং সমর্থক ২৪টি রাষ্ট্রের নাম উল্লেখ রয়েছে যার মধ্যে পাকিস্থানের নামও রয়েছে।  রেফারেন্স হিসেবে #০৫২০৪ প্যারার কথা উল্লেখ করা (তথ্যাদি অপ্রকাশ্য)ছাড়া বাংলা’র ‘মহান একুশ’ তথা ‘টুয়েন্টি ফাস্ট(একুশে)ফেব্রুয়ারি’ এর ঐতিহাসিক ভিত্তি বা চেতনাদীপ্ত তথা উৎসাহব্যঞ্জক কোণ যোগসূত্রের তথ্যাদির ইংগিত কোথাও দেখা যায় না। যার ফলে ইউনেস্কোর দলিল দস্তাবেধ মোতাবেক বাংলার “মহান একুশ”ই যে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে ‘টুয়েন্টি ফাস্ট ফেব্রুয়ারি’র মূলভিত্তি তা অন্যান্য ভাষাভাষী সাধারন পাঠক তথা তাবৎ বিশ্ববাসী বুঝতে পারা বা দাবী করে প্রতিষ্ঠা করা অনেকটা অসম্ভবই বলা যেতে পারে। অথচ ‘টুয়েন্টি ফাস্ট(একুশে)ফেব্রুয়ারি’ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে মর্যাদা লাভের মূলভিত্তি- আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদায় একটি দিবস “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে উদযাপনের প্রয়োজনীয়তার বিষয় এবং সেই “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে টুয়েন্টি ফাস্ট ফেব্রুয়ারি কেই গ্রহণ করার অনুরোধ সম্বলিত প্রয়াত কানাডা অভিবাসী রফিকুল ইসলামের ৮ই জানুয়ারি ১৯৯৮ তারিখে ইউএন মহাসচিব জনাব কফি আন্নানের বরাবরে প্রেরিত প্রথম এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তদুপরি তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে দিবসটি’র প্রক্লেমেশন পর্যায়ে আসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৎকালীন   প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আন্তরিকতাসহ সরকারের দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতা এবং নেতৃত্ব মুখ্য ভুমিকা পালন করে। যার সুত্রধরেই পরবর্তীতে ইউনেস্কোর প্রতিষ্ঠান ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিউট’ বাংলাদেশের ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পর্যায়ক্রমে সম্প্রতি ইউনেস্কোর দ্বিতীয় ক্যাটাগরি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলেও ‘দিবস’টি গ্রহণের প্রেক্ষাপট চিত্রায়নে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাভাষা আন্দোলন বা মহান একুশের চেতনার উজ্জিবনের কথা অনুপস্থিত।

ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাসমূহ সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তায় “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” উদযাপনের পক্ষ্যে গবেষণা নির্ভর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, প্রয়াত রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত উদ্যোগী প্রস্তাব, বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনপুষ্ট জোর কূটনৈতিক তৎপরতা এবং এতদবিষয়ে পর্যায়ক্রমে ইউনেস্কো-বাংলাদেশ নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় উত্তরণ আন্তর্জাতিক সমাজ এবং বাংলাদেশ-ইউনেস্কো পারস্পরিক পর্যায়ে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এতদসত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক ক্রমোন্নয়নের সুফল এবং সকলের সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজনীয়তার কথা অন্যান্য ভাষাভাষীদের কাছে তথা ইউনেস্কো-বাংলাদেশের বলয়ের বাইরের ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাভাষী এবং সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীদের কাছে আদৌ পৌঁছেছে কিনা সেই প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে বহির্বিশ্বে বসবাসকারী বাংগালিদের অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রশ্নের জবাব, “না”; অন্যান্য ভাষাভাষীদের কাছে এই দিবসটি, এবং দিবসের সাথে বাংলা বা বাংগালিদের অবদান বা সংশ্লিষ্টতার কথা দূরে থাক যেসকল ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাভাষীর জন্য দিবসটি উদযাপন প্রয়োজনীয়, অর্থাৎ প্রায় অবলুপ্তির মুখে পতিত ভাষার ভাষাভাষীদের মধ্যেও আন্তর্জাতিক এই দিবসটির অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত এমন ব্যাক্তি খুঁজে পাওয়াও কষ্টকর। ভাষা-সাহিত্য বিষয়ে বিশারদ, পেশাজীবী, একাডেমিক, গবেষক বা সমাজসেবীদের কাছেও এই দিবসটি পরিচিত নয় বললে ভুল বলা হবে না। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ইউনেস্কোর স্বদেশীয় শাখা খোদ NatCOM অফিসসমূহ কর্তৃক এই গুরুত্বপূর্ণ দিবসটি উদযাপন অথবা সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীদের দিয়ে দিবসটি উদযাপনে উৎসাহিত করার কোন নজীর স্পষ্টতই অদৃশ্য।

অপরদিকে টুয়েন্টি ফাস্ট(একুশে)ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে উদযাপনে ইউনেস্কোর গৃহীত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বাঙালিদের বিশেষ করে বাংলাদেশীদের আবেগাপ্লুত করে তোলে। প্রয়াত রফিকুল ইসলামের প্রস্তাব, এবং প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের সফলতম জোর কূটনৈতিক তৎপরতার বিশেষ ভুমিকা বাংলাভাষা আন্দোলন, মহান একুশ, স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা অর্জনের ধারাবাহিকতার অভিজ্ঞতার সাথে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অর্জিত এই বৈশ্বিক বহুমাত্রিক অর্জনকে একই মাত্রায় গুলিয়ে ফেলে। অধিকাংশ বাংলাদেশি বা বাঙালিরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশের মত একই মর্যাদায় পৃথিবীর সর্বত্র একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে, যদিও প্রতিবেশী ভারতের বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও এই বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা যায় না; অনেকের আবার বিশ্বাস, ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্ত বাংলাভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় উন্নীত করেছে, যা শুধুই আবেগতাড়িত বটে তবে এর পেছনে বাস্তবসংগত কোন যুক্তি বা ভিত্তি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব; কেউ কেউ আবার মনে করেন বাংলাভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী শহীদদের সম্মানেই ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের ঘোষণা এসেছে, যা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মাতৃভাষা রক্ষায় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিরল দৃষ্টান্ত হলেও তাবৎ বিশ্বের ভাষা অবক্ষয়ের পেছনে বহুবিধ প্রাকৃতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক কারনরোধের একমাত্র কৌশল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। তারপরও বাংলাভাষা আন্দোলনের মহান একুশ, তথা ‘টুয়েন্টি ফাস্ট(একুশে)ফেব্রুয়ারি’ কে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে উদযাপনে ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ভাষা অবক্ষয়ের অন্তস্থিত বহুমাত্রিক কারণিক উপাদানগুলি বিশেষভাবে বিবেচিত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছেঃ সভ্য সামাজিক স্বাভাবিক জীবনব্যাবস্থায় মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব অনুধাবনের দৃষ্টান্ত; মাতৃভাষা রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রত্যয় এবং আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন; মাতৃভাষাকে ধর্ম, বর্ণ, রাজনীতিসহ সকল মতভেদের উরধে স্থান দেয়া; ভাষাভিত্তিক জাতীয় দৃঢ়ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে  স্বাধীনতা, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনের বিরল দৃষ্টান্ত। বিশ্বব্যাপী ভাষা অবক্ষয়ের ভয়াবহ গতিরোধে যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাভাষী গুষ্টিকে অনুপ্রেরনা জোগাতে এবং সম্মিলিত ও সকল ভাষাভাষীর সমন্বিত প্রচেষ্টায় উজ্জীবিত করার জন্য মহান একুশের চেতনার উদাহরণ, ইতিহাস, ঐক্য এবং সফলতা অত্যন্ত উপযোগী বলেই টুয়েন্টি ফাস্ট(একুশে)ফেব্রুয়ারি “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” এর সম্মানে অধিষ্ঠিত। যা বিশ্বায়নের জটিল ডিজিটালমুখী বিশ্বসমাজে আপনা থেকেই পরিচিতি পাওয়া বা উদযাপন করার কথা ভাবাটা বাস্তবসম্মত নয়, এবং বাস্তবক্ষেত্রেও তার নজীর অনুপস্থিত, প্রয়োজন বিশ্বায়নের পাশাপাশি সহনশীলভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্টপোষকতায় মাতৃভাষা চর্চা অব্যাহত রাখার বাস্তবসম্মত কৌশলী পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ, এবং সার্বজনীন, সর্বত্র ও সর্বাধিক সম্প্রচারের মাধ্যমে সকল ভাষাভাষীর জন্য উপযোগ্য এবং অনুকরণীয় যথার্থ প্রয়োগ ব্যাবস্থার বাস্তবায়ন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা অবক্ষয়ের চিত্রায়িত তথ্যাদি এবং ভয়াবহ এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ‘টুয়েন্টি-ফাস্ট(একুশে)ফেব্রুয়ারি’ কে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাবের পক্ষে ইউনেস্কো সাধারন পরিষদের সিদ্ধান্ত পৃথিবীর সকল ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাসমূহ রক্ষার প্রয়োজনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী, যা মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারাকে দীর্ঘায়িত করে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। মাতৃভাষা অবক্ষয়ের এই অদৃশ্য ভয়াবহ ধারা রোধে অবক্ষয়মান সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষী, গবেষক, পেশাজীবী, সামাজিক সংগঠন এবং প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করা সবচাইতে জরুরী, কারন যেকোণ ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভাষা ব্যবহার কারীদের সরাসরি সম্পৃক্ততার কোন বিকল্প নাই। বিশ্বায়নের উত্তাল অগ্রগতির পাশাপাশি বিশ্বের সকল ভাষাভাষী কর্তৃক ‘টুয়েন্টি-ফাস্ট(একুশে)ফেব্রুয়ারি’তে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” উদযাপনের সুযোগ বা সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে উদ্ভাবিত কতিপয় বৈশ্বিক কৌশলের মধ্যে বাংলাভাষা আন্দোলন এবং একুশের চেতনার উজ্জিবনি প্রতীক ‘শহীদ মিনার’এর আদলে বিশ্বের সকল প্রধান প্রধান শহরে স্থানীয় মাতৃভাষা সংরক্ষণ, বহুজাতিক সামাজিক ব্যবস্থা, বিশ্বায়ন এবং একুশের চেতনা বিধৃত তথ্যের পরিস্ফুটনে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” প্রতিষ্ঠার কৌশল গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের সর্বত্র শহীদ মিনারের মত বিশ্বের শহরে শহরে “কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” বার্তা উদ্ধৃত “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”-এর উপস্থিতি একদিকে যেমন মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদের মাধ্যমে ইউনেস্কোর মাতৃভাষা সংরক্ষণ মিশন বাস্তবায়নে সকল ভাষাভাষীকে সার্বক্ষণিক উৎসাহ যোগাবে, অন্যদিকে অন্যান্য ভাষাভাষীরা মহান একুশের চেতনার সাথে পরিচিতির মাধ্যমে উজ্জীবিত হয়ে নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা, সংরক্ষণে উদ্ভুদ্ধ হবে। উদ্ভাবিত অন্যান্য বৈশ্বিক কৌশল যেমনঃ লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার প্রতিষ্ঠা এবং ইউনেস্কোর সদস্যভুক্ত সকল সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক এবিষয়ক সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে মহান একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন নিশ্চিত হবে, বিশ্বের সকল ঝুঁকিপূর্ণভাষা চর্চা, সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীরা সারা বছরব্যাপী সম্পৃক্ততার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের যথার্থ সুফল অর্জন করবে। (চলবে)

 

লেখক পরিচিতিঃ নির্মল পাল; ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au

প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ             এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক

প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ      পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”

প্রকাশিত গ্রন্থঃ                           “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”

বৈশ্বিক দর্শনঃ                            “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)