গ্রামের উত্তর দিকের পরিত্যক্ত বাড়িটার পাশে একটা লাশ পড়ে আছে। দক্ষিণ পাড়ার শওকত খুব ভোরবেলা মিসওয়াক করতে করতে বাড়িটার পাশ দিয়ে যাবার সময় লাশটা প্রথম আবিষ্কার করে। তারপর সে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে লোক জড়ো করে। সেই জনসমাগম এখন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। কেউই লাশটাকে শনাক্ত করতে পারছে না। কিংবা পরবর্তী করণীয় পদক্ষেপ নিয়েও কেউ এগিয়ে আসছে না। গ্রামের চেয়ারম্যান ফজল মিয়া এসে জনসমাগম দেখে সুযোগ বুঝে একটা ছোট-খাটো ভাষণ দিয়ে ফেলল।
‘মিয়ারা তোমরা কেউ কি লোকটাকে চিনো বা কোথাও দেখেছ?’
সবাই সমস্বরে বলল, ‘না’।
‘তাইলে তো মিয়ারা দেখা যায়, বিরাট সমস্যায় পড়া গেল। থানা পুলিশ হবে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশী করবে। তারপর তো কোর্ট হাজত পর্যন্ত গড়াবে।’
সবশেষে ফজল মিয়া চ্যালা-চামচা নিয়ে লাশের কোনো বিধি ব্যবস্থা না করেই কেটে পড়ল।
শওকত নিজের গায়ের চাদরটা দিয়ে লাশটা ঢেকে দিল। থানায় খবর দিতে বললে সবাই ভয়ে পিছিয়ে গেল। শওকত নিজে থানায় ছোটাছুটি করে অবশেষে সেকেন্ড অফিসারকে আনতে সক্ষম হল।
তখন প্রায় বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। পুলিশ লাশ নিয়ে পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়ে দিল। তারপর শওকত বাদী হয়ে থানায় একটা সাধারণ ডায়েরী এন্ট্রি করল।
শওকত গ্রামের ইন্টার ফেল একজন বেকার যুবক। গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করা ছাড়া তার আর সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। বিধবা মা শিকদার বাড়িতে সারা মাস কাজ করে যা পায় তা দিয়ে দু’জনের সংসার কোনোভাবে চলে যায়।
সে গ্রামের দোকানে দোকানে চাঁদা তুলে আশে পাশের গ্রামে মাইকিং করে লাশের পরিচয় জানার চেষ্টা করে। পোস্টমর্টেম শেষে কোনো দাবীদার না থাকায় লাশ শওকতের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সে আবারও বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাফনের কাপড় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনার টাকা জোগাড় করে। পরিশেষে প্রতিবেশীদের নিয়ে গ্রামের গোরস্থানে লাশের দাফন করল। কবরের সামনে একটা ছোট্ট সাইন বোর্ডে লিখে দিল ‘নাম না জানা অতিথি’।
শওকত সব সময় ভাবে এই বুঝি কেউ লাশের খোঁজে গ্রামে ছুটে আসবে। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরে মাস পেরিয়ে গেলেও কেউ কোনো খোঁজ খবর করে না। সে তার প্রিয় ছাগলটা বিক্রি করে সেই টাকায় ঢাকার দুইটি পত্রিকায় লাশের বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়। তারপরও কেউ যোগাযোগ করে না।
একদিন হঠাৎ একটি মেয়েলী কণ্ঠ শওকতকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ‘আপনি কি শওকত?’
পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিহিত এক অপরিচিতা মেয়ে তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ আর হাতে একটি পত্রিকা ভাজ করা।
শওকত কয়েকজন সম বয়সীদের সঙ্গে আড্ডারত ছিল। সে দোকানের বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘হ্যাঁ আমার নাম শওকত।’ সে সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘আমি ঢাকা থেকে এসেছি।’ এই বলে শওকতের সামনে বছর খানেক আগের একটি পত্রিকা মেলে ধরে। সে বিজ্ঞাপনটি দেখে চিনতে পারে। তারপর উৎসুকতার সঙ্গে মেয়েটিকে বলে, ‘আসেন আমার সঙ্গে’।
মেয়েটি দ্রুত পায়ে তাকে অনুসরণ করতে থাকে। তারা কবরের উপরের কৃষ্ণচূড়া গাছটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গাছটি খুব যে বড় তা নয়। তবে কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুলে পুরো কবরটি ঢেকে আছে। মেয়েটি কবরটি দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শওকত বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার কাছে মনে হয়- হঠাৎ সময় যেন থেমে গেছে।
এক সময় মেয়েটি নিজেকে সামলে নেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার নাম জেবিন। যে ব্যক্তির কবরের পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি তিনি আমার বাবা। ওনার নাম হাসান শাহরিয়ার। পেশায় একজন সাইন্টিস্ট। জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়নের অধ্যাপক।’
মেয়েটি একটু দম নিয়ে ফের বলে, ‘আমি আপনাদের গ্রামে কয়েকটা দিন থাকতে চাই। এখানে কি কোনো হোটেল বা রেস্ট হাউস আছে?’
শওকত বিনীত ভঙ্গিতে বলে, ‘এই অজ-পাড়াগাঁয়ে থাকার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই।’
ফের কিছুটা লজ্জিত গলায় বলে, ‘আপনার কোনো অসুবিধা না হলে আমাদের বাড়িতে থাকতে পারেন।’
শওকত জেবিনের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে তার ব্যাগটা মাটি থেকে তুলে নেয়। জেবিনও বিষয়টাকে সহজভাবে নেয়। এদিকে বাড়িতে পৌঁছালে শওকতের মা জেবিনের পরিচয় জানতে পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে ওরা উঠানে এসে বসে। জেবিন বলতে শুরু করে, ‘বাবা একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিতে জাপান থেকে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে উঠেছিলেন। পরদিন দুপুরে একটি পাঁচ তারা হোটেলে তার সদ্য আবিষ্কৃত একটি ফর্মুলার প্রেজেন্টেশন ছিল। অবশ্য আপনাদের জানানো প্রয়োজন, বাংলাদেশের নিকটবর্তী একটি দেশ ও একটি প্রভাবশালী দেশ- এই দুইটি দেশের গোয়েন্দারা পৃথকভাবে তখন বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছিল ওনার আবিষ্কৃত ফর্মুলা যেন তাদের কাছে বেচে দেয়। কিন্তু তিনি রাজী ছিলেন না। তিনি চাইতেন এই ফর্মুলায় বাংলাদেশ-জাপান যৌথ উদ্যোগে কাজ হোক। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক মানুষ। জাপানে থাকলেও তার মন পড়ে থাকত বাংলাদেশে। অবশ্য তিনিবাংলাদেশের পর জাপানকেই ভালোবাসতেন। তাই তার প্রিয় দুই দেশের সম্প্রীতি ও উপকারে তিনি নিবেদিত ছিলেন।… রাতে শেষ আমাদের সাথে কথা হয়েছিল। ঐদিন সকাল থেকে বাবার আর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি আর মা জাপান থেকে অনেক চেষ্টা করেও বাবার আর কোনো সন্ধান পাইনি। বাবা-মায়ের মাঝে ছিল গভীর প্রেম। ফলে বাবার নিখোঁজের পর মা অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। ডাক্তার কম দেখানো হয়নি- তিনি আর সুস্থ্য হলেন না। একদিন তিনিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।’
‘আর একটা কথা আপনাদের বলা হয়নি। আমার মা জাপানের মেয়ে। বাবা জাপানে পিএইচডি করার সময় ভালোবেসে মাকে বিয়ে করে। এতটুকু বলার পর সে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।’
শওকতের মা পরম মমতায় জেবিনের মাথায় হাত রাখে।
পরের কয়েকটা দিন খুব দ্রুত কেটে যায়। প্রতিদিন জেবিন বেশ কিছু সময়ের জন্য তার বাবার কবরের পাশে নীরবে বসে থাকে। মাঝে মাঝে সে পরম যতনে কবরের মাটিতে হাত বোলায়।
অবশেষে জেবিনের জাপান ফেরার সমায় হয়ে আসে। সে শওকতকে জাপানে একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। অবশ্য মা-ছেলে দু’জনেই বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করে।
শওকত ও তার মা জেবিনকে বড় রাস্তার মোড়ে বাসে তুলে দিতে আসে। বাসে ওঠার আগে তার মা জেবিনের মাথায় হাত রেখে দোয়া করে। বাসের দরজায় পা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে জেবিন চেঁচিয়ে বলে ওঠে- ‘আমি আবার ফিরে আসব মা, আমার কথা মনে রেখো!’
বাস দ্রুতগতিতে বিন্দু থেকে বিন্দুতে মিলিয়ে যায়।
নাইম আবদুল্লাহ, লেখক, সাংবাদিক