অনেক ছোটবেলায় আমাদের বাসার দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলানো ছিল। খুব সুন্দর একটা সরিষা ক্ষেতের ছবি ছিল সেখানে, একটা বাচ্চা ছেলে ঘুড়ি উড়াচ্ছে ক্ষেতের মাঝে। আম্মু দুধওয়ালার হিসাব রাখত ঐ ক্যালেন্ডারে। বছর পার হয়ে গেলেও ক্যালেন্ডারটা ঝুলানো ছিল বহুদিন, মনে হয় সরিষা ক্ষেতের সুন্দর ছবিটার জন্যই।
দেশে থাকাকালীন কোনদিন সরিষা ক্ষেতের আল ধরে হাঁটা হয়নি আমার। গ্রামের সাথে সংযোগহীনতাই এর কারণ। মাঝে মাঝে হয়তো চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখেছি হোলদে সোরষে ক্ষেত, কিন্তু চোখের নিমেষেই হারিয়ে গেছে সেই দৃশ্য। প্রথম সরিষা ক্ষেতের প্রেমে পড়ি দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে হিন্দি সিনেমাটা দেখে। কিশোর বয়স তখন, বিচিত্র সব অনুভূতির সাথে নতুন নতুন পরিচয় হচ্ছে মাত্র। থাকি ক্যাডেট কলেজের মত বন্দী পরিবেশে। সিনেমার দৃশ্যটা অনেকটা এরকম, প্রবাসে বেড়ে ওঠা সিমরানকে জোর করে বিয়ে দেবার জন্য দেশে নিয়ে এসেছে তার বাবা। বাড়িতে বিয়ের শোরগোল, কিন্তু সিমরানের মন নেই এসব কিছুতেই। সে ঠিকমত জানেওনা ইউরোপ ট্যুরে পরিচয় হওয়া রাজ তাকে ভালবাসে কিনা? কানের মাঝে ম্যান্ডালিনের টুংটাং শব্দ দিনরাত পাগল করে দিচ্ছে তাকে। এই দম বন্ধ পরিবেশ থেকে পালিয়ে এক সকালে সে দৌড়ে চলে এল সরিষা ক্ষেতের মাঝে। তারপর সেই বিখ্যাত গান – “তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম!” এই গানের ব্যাপক প্রভাব আছে আমার চেনাজানা অনেকের উপরেই।
আমার সুইট-কিউট টুইংকেল ভাবী গতবছর ইউরোপ ট্যুরে গিয়ে বরফের উপর শাড়ি পরে ছবি তুলেছিলেন এই কারণেই। আর আমার যখন মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস নিতে ইচ্ছে হয়, মনে হয় ঐ রকম কোন সোরষে ক্ষেতের ভিতর পালিয়ে যাই। কিন্তু ক্ষেত পাব কোথায়? গতমাসে জিয়া ভাই তার ফেসবুক পেজে ছবি দিলেন ক্যানোলা ক্ষেতের। আরে! এতো একেবারে সরিষা ক্ষেত! ক্যানোলা হল জেনেটিক্যালি মোডিফাইড বীজ, সরিষার মতই ভোজ্য তেল তৈরী হয় এটা থেকে।
ওয়েস্টার্ণ অস্ট্রেলিয়ার কৃষকরা ব্যাপকহারে চাষ করে এই ক্যানোলা।হোকনা বিদেশী সরিষা, এই ক্ষেত দেখার জন্যই মনটা অস্থির হয়ে গেল। এবার লং উইক এন্ডে আলবেনীর উদ্দেশ্যে যখন রওনা হলাম, দেখা মিলল সেই বহু প্রতীক্ষিত বিদেশী সরিষা ক্ষেতের। রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত! সমতল, পাহাড়ের ঢাল, যত দূর চোখ যায় মাঠের পর মাঠ শুধু হলুদ চাদর বিছানো। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।আমার “রাজ”কে নিয়েই ক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম কয়েকটা।হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম, প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম! স্বপ্ন পূরণের আনন্দ শুধু স্বপ্নবিলাসীরাই জানে! সরিষা ক্ষেত দেখেও মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়? হ্যাঁ হয়! আমার মত আরেক পাগল, ক্যাডেট কলেজেরই ছোট বোন মুনিরা। ক্ষেতের সন্ধান পেয়ে সেও চলে এল পর দিনই, সিমরানের মতই ধবধবে সাদা জামা পড়ে, তার “রাজ”কে নিয়ে সরিষা ক্ষেতের মাঝে ছবি তুলতে।এই না হলে পাগলামী! জীবনের মাধুর্যই তো এসব পাগলামীতে।