এত চিৎকার করলাম, সবাইকে এত ডাকলাম, কেউ আগায়া আসেনি

এত চিৎকার করলাম, সবাইকে এত ডাকলাম, কেউ আগায়া আসেনি

অনলাইন ডেস্কঃ ০৮ আগস্ট ২০১৫

নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। কর্মস্থলে ও বন্ধুদের বিষয়টি জানিয়েছিলেন তিনি। পুলিশের সাহায্য চেয়েও পাননি। ঢাকার বাইরে বদলিও হয়েছিলেন। বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টাও ছিল। কিন্তু শেষমেশ নৃশংসভাবে খুন হলেন তিনি।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে ভাড়া বাসায় ঢুকে হত্যা করা হলো নীলাদ্রিকে। এবারও পুলিশ উগ্রপন্থীদের সন্দেহ করছে। গতকাল সন্ধ্যায় এক ই-মেইল বার্তায় হত্যার দায় স্বীকার করেছে আনসার আল ইসলাম নামের একটি সংগঠন। এ নিয়ে চলতি বছরের সাত মাসে চারজন লেখক ও ব্লগার খুন হলেন। এর আগে ২০১৩ সালে খুন করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে।
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (২৭) গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনি ‘নিলয় নীল’ নামে বিভিন্ন গোষ্ঠীবদ্ধ ব্লগে লিখতেন। ফেসবুকেও ছিলেন একই নামে। স্ত্রী আশা মনিকে নিয়ে পূর্ব গোড়ানের একটি বাড়ির পাঁচতলায় দুই কামরার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন তিনি। গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে চার ব্যক্তি এই বাসার ভেতরে ঢুকেই নীলাদ্রিকে কুপিয়ে হত্যা করে। পুলিশ বলেছে, তাঁর মাথা ও ঘাড়ে বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
গোড়ান টেম্পোস্ট্যান্ড থেকে সরু আঁকাবাঁকা গলিপথ ধরে প্রায় এক কিলোমিটার গেলে শেষ মাথায় ওই বাড়িটি। পাঁচতলা পর্যন্ত সিঁড়িতে পুলিশ, সাংবাদিক আর উৎসুক মানুষের ভিড়। ফ্ল্যাটের সামনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ক্রাইম সিন ইউনিটের দুই সদস্য দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে আলামত সংগ্রহের কাজ চলছে। আর ভেতর থেকে ভেসে আসছে নিহতের স্ত্রীর বিলাপ, চিৎকার। তিনি বারবারই বলছেন, ‘এখন এত হাজার হাজার লোক। আর আমি তখন এত চিৎকার করলাম, সবাইকে এত ডাকলাম, কেউ আগায়া আসেনি। এই দেশ কি আমার না? আমি কি অন্য দেশ থেকে এইখানে আসছি?’
আলামত সংগ্রহ শেষে বিকেল পাঁচটার দিকে নীলাদ্রির লাশ ঘর থেকে বের করে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায় পুলিশ।
ফ্ল্যাটটিতে ঢুকতেই হাতের বাঁয়ে শোবার ঘর। ঘরটির মেঝেতে থকথকে রক্ত। দেয়ালেও রক্তের ছিটা। ঘরে তাক তাক করে রাখা দর্শন, বিজ্ঞান আর সাহিত্যের বইগুলোতেও রক্তের দাগ।
নীলাদ্রির লাশ নিয়ে যাওয়ার পর ওই বাড়ির ছাদে তাঁর স্ত্রী আশা মনি সাংবাদিকদের বলেন, গতকাল দুপুরে বাজার থেকে ফেরেন নীলাদ্রি। আশার বোন তন্বী গতকাল বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। তন্বী বাজার থেকে আনা তরিতরকারি কাটছিলেন। এ সময় ১৯-২০ বছর বয়সী এক তরুণ বাসার দরজায় টোকা দেন। দরজা খুললে ওই তরুণ বলেন, তিনি বাসা ভাড়া নিতে চান। আশা বলেন, তাঁরা তো বাড়ি ছাড়ছেন না। ভাড়া নেবেন কীভাবে? কথা বলতে বলতেই ওই তরুণ বাসার ভেতরে ঢুকে পড়েন। কালো টি-শার্ট, জিনস পরা তরুণটির পিঠে একটি ব্যাগ ছিল। বাসায় ঢুকে তরুণটি মুঠোফোন টিপতে থাকেন। তখন আশা তাঁর স্বামী নীলাদ্রিকে ডাক দেন। এর মধ্যেই আরও তিনজন বাসার ভেতরে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই তাঁরা ‘নারায়ে তকবির’ বলে নীলাদ্রিকে কোপাতে শুরু করেন। একজন আশাকে পিস্তলের মুখে বারান্দায় নিয়ে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। আশার বোনকে রান্নাঘরেই আটকে রাখা হয়।
আশা বলেন, ‘আমি সব শক্তি দিয়া চিৎকার করতাছি মাইরা ফালাইলোরে, মাইরা ফালাইলো। কেউ আগায়া আসেনি। কেউ যদি আইসা কলাপসিবল গেটটাও লাগায়া দিত, তাও ওদের ধরা যাইত।’ সব মিলিয়ে দুই থেকে তিন মিনিটের ভেতরেই পুরো ঘটনাটি ঘটে যায় বলে আশা জানান।
তাঁর স্ত্রী বারবার বলছিলেন, গণমাধ্যমে তাঁর চেহারা দেখানোর ফলে এখন তাঁর জীবনও শঙ্কায় পড়ল। হামলাকারীদের একজনের মুখে দাড়ি ছিল।

গণমাধ্যমে পাঠানো ই–মেইল বার্তায় হত্যার দায় স্বীকার আনসার আল ইসলাম নামের এক সংগঠনের

খুনিরা চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরে আশপাশের লোকজন এসে ভেতরের দরজা খুলে দিলে আশা ঘরে ঢুকেই দেখেন, রক্তে ভাসাভাসি মেঝের ওপর পড়ে আছেন তাঁর স্বামী। আশা বলেন, খুনিরা মৃত্যু নিশ্চিত করার পর ঘর থেকে বের হয়েছেন। খুনিরা বড় রামদা ও চাপাতি জাতীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছেন।
পাশের ফ্ল্যাটের মো. শামীম জানান, তিনি নারায়ে তাকবির ও ডাকাত ডাকাত চিৎকার শুনতে পেয়ে বারান্দা থেকে তাকিয়ে তিনজন লোককে ঘর থেকে বের হতে দেখেছেন। এরপর তিনি নিচে গিয়ে তাঁদের বালতিতে কিছু একটা করতে দেখেন। পরে পুলিশ ওই বাড়ির নিচতলায় একটি ময়লা রাখার ছোট বালতি থেকে একটি সাদা-কালো চেক শার্ট ও একটি গামছা জব্দ করে। এসব কাপড়ে রক্তের দাগ লেগে ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তবে চারতলার পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা শাহনাজ আক্তার ও শিরীনা বেগম জানান, দুপুরে বাড়ির পুরুষেরা সবাই জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। তখনই ঘটনাটি ঘটে। তাঁরা শুনতে পান, পুরুষ কণ্ঠে কেউ চিৎকার করছিল, ‘কারেন্ট কারেন্ট’ বলে। ভয় পেয়ে তাঁরা নিজ নিজ ফ্ল্যাটের বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ করে দেন। শাহনাজ বলেন, ‘আমি ভাবছি বোধ হয় কেউ কারেন্ট শট খাইছে। ভয়ে আমি সব লাইন বন্ধ করছি।’
তবে এঁদের কেউই দরজা খুলে দেখেননি, বাইরে কী হচ্ছে। পরে এই দুই গৃহবধূ ধারণা করছেন, খুনিরা নিজেরাই ‘কারেন্ট কারেন্ট’ বলে চিৎকার করে সবাইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন।
ঘটনাস্থলে মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় সাংবাদিকদের বলেন, নিহতের গলা ও ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপের চিহ্ন রয়েছে। এর আগে অন্য ব্লগারদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম। শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য যখন আশপাশের বাসার পুরুষেরা মসজিদে নামাজে গেছেন, তখনই এই হামলা চালানো হয়।
বহুদিন ধরে হুমকির মুখে: নীলাদ্রির বাল্যবন্ধু দীপক শীল জানান, নীলাদ্রির গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর সদরের টোনা ইউনিয়নে। ২০০৭ সালে পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে নীলাদ্রি বড়। দুই বছর আগে আশা মনিকে বিয়ে করে গোড়ানের ওই বাড়িতে ওঠেন।
পরীবাগে একটি গবেষণা সংস্থায় চাকরি করতেন নীলাদ্রি। সংস্থাটির চেয়ারপারসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, এক মাস আগে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন নীলাদ্রি।
মেজবাহ কামাল বলেন, সরকারের কাছে হেফাজতে ইসলামের দেওয়া ৮৪ জন ব্লগারের তালিকায় নীলাদ্রির নাম ছিল। এমনকি পরে ১৬ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করেছিল উগ্রপন্থীরা, সেখানেও নীলাদ্রির নাম ছিল। এসব নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন তিনি। সিলেটে নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন নীলাদ্রি।
মেজবাহ কামাল জানান, অনন্ত হত্যার পর আরও বেশি শঙ্কায় পড়েন নীলাদ্রি। অনন্ত হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে শাহবাগ থেকে ফেরার পথে তাঁকে অনুসরণ করছিলেন দুই তরুণ। বিষয়টি বুঝতে পেরে নীলাদ্রি রাস্তায় নেমে যান। পরে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে বন্ধুদের ফোনে বিষয়টি জানান। বন্ধুরা গিয়ে তাঁকে বাসায় নিয়ে যান। বিষয়টি তিনি অফিসে জানালে অফিস থেকে তাঁকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই ঢাকায় ফিরে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
জিডি নেয়নি পুলিশ: নীলাদ্রি গত ১৫ মে তাঁকে অনুসরণ করার বিষয়টি নিজের ফেসবুক পাতায় প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, ‘এ ঘটনায় জিডি করতে গিয়ে আরও উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখীন হই।… অনুসরণকালে অনেকগুলো থানা এলাকা অতিক্রম করায় ঘটনাস্থলের আওতায় থাকা একটি থানায় জিডি করতে গেলে তারা জিডি নিল না। তারা বলল, এটা আমাদের থানাধীন না, এটা অমুক থানার অধীনে পড়েছে, ওখানে গিয়ে যোগাযোগ করুন, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান।’
আশা মনি বলেন, দুজন ব্যক্তি তাঁকে অনুসরণ করছে বুঝতে পেরে নীলাদ্রি খিলগাঁও থানায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গিয়েছিলেন। খিলগাঁওয়ের পুলিশ ঘটনা শুনে বলেছে, তাঁকে আমতলা থেকে অনুসরণ করা হচ্ছে। আর আমতলা পড়ে শাহজাহানপুর থানায়। এরপর তাঁকে সেই থানায় যেতে বলা হয়। শেষ পর্যন্ত কোনো থানাতেই আর জিডি করতে পারেননি নীলাদ্রি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসীরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হত্যার তদন্তে সব বিষয়েই পর্যালোচনা করা হবে। তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বা অন্য বিষয়ও খতিয়ে দেখা হবে। তখন যদি দেখা যায়, তিনি পুলিশের সেবা চেয়েও পাননি বা পুলিশের কোনো সদস্যের গাফিলতি ছিল, তাহলে অবশ্যই দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আশা আরও বলেন, কিছুদিন ধরে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন নীলাদ্রি। তার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো তাঁকে।
হত্যার দায় স্বীকার: গতকাল সন্ধ্যায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো এক ই-মেইল বার্তায় বাংলায় বলা হয়েছে, ‘আনসার আল ইসলাম (আল কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ, বাংলাদেশ শাখা)-এর মুজাহিদিনরা হামলা চালিয়ে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুলের দুশমন নিলয় চৌধুরীকে হত্যা করেছেন। শুক্রবার দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে ওই অপারেশন সম্পন্ন হয়।’ ওই মেইলের প্রেরক হিসেবে ‘মুফতি আব্দুল্লাহ আশরাফ’ নাম লেখা রয়েছে।
এর আগে অনন্ত বিজয় হত্যার পরে আনসার বাংলা-৮ নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। অভিজিৎ হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আনসার বাংলা-৭ নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে দায় স্বীকার করা হয়।
গ্রামের বাড়িতে মাতম: নীলাদ্রির মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই তাঁর গ্রামের বাড়িতে চলছে মাতম। বাবা তারাপদ চট্টোপাধ্যায় ছেলের হত্যার বিচার দাবি করে বলেন, ‘আমার নিরপরাধ ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, আমি তাদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
নিহতের বোন জয়শ্রী চট্টোপাধ্যায় বলেন, দুই সপ্তাহ আগে বাড়ি এসেছিলেন নীলাদ্রি। মা অপর্ণা চট্টোপাধ্যায় তখন ছেলেকে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন।

একের পর এক ব্লগার হত্যা
৭ আগস্ট ২০১৫
নীলািদ্র চট্টোপাধ্যায়

১২ মে ২০১৫
অনন্ত বিজয় দাশ
৩০ মার্চ ২০১৫
ওয়াশিকুর রহমান
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
অভিজিৎ রায়
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
রাজীব হায়দার

চার তরুণ ঘরে ঢুকেই কোপাতে শুরু করে
নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা সহকর্মী ও বন্ধুদের জানিয়েছিলেন
তাঁকে অনুসরণ করা হচ্ছিল
শঙ্কায় বদলি নিয়ে ঢাকার বাইরেও ছিলেন কিছুদিন
থানায় গিয়েও জিডি করতে পারেননি

( সুত্রঃ প্রথম আলো)