অনেকদিন পর সেদিন হাসপাতালে অনেকক্ষন সময় কাটালাম। হাসপাতালে যে যাই না তা নয়। তবে এত লম্বা সময় হাসপাতালে থাকা হয় না। রোগী আমি না আমার সহধর্মীনী। কিছু এবনরমালীটি দেখা দিয়েছে তাই খাজনার চেয়ে বাজনা বেশী অবস্থা। আমার উনি আবার বেশী সচেতন। পেপারে সাস্থ্য পাতার কঠিন পাঠক। তাই কোমরে ব্যাথা হলেই মারাত্মক কিছুর আশঙ্কা মনে করে হাসপাতালে যাবার জন্য ছটফট করে। হাত ঝিমঝিম করে তাই বারডেমে গিয়েছিল চেকআপ করাতে। ডায়াবেটিক সমিতির সদস্য বানিয়ে বই দিয়েছে হাতে। সাথে একগাঁদা ঔষধ। বাসার হেল্পার মেয়েটাকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে সঙ্গী বানিয়েছিল ৪০ মিনিট হাটার জন্য।এখানে এসে একটা ছোট্ট ক্লিনিকে টেষ্ট করালো ব্লাড সুগারের। মাত্রা একটু হাই থাকলেও সেটাতে ডায়াবেটিস নয় বলে জানিয়ে দিল ডাক্তার। বিশ্বাস করল না ছোট ক্লিনিকের ফয়সালাটিকে। ঔষধ খাচ্ছে বলে এমন রেজাল্ট হতে পারে বলে ঔষধ খাওয়া ছেড়ে দিল। গেল বড় হাসপাতালে । ফলাফল একই। রোগের চিন্তায় মুখে পড়া ভাঁজগুলো মেকআপ না করাতেও কোথায় যেন উধাত্ত হয়ে গেল।বাড়ডেমের ডাক্তারদের গোষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ল।হাজার টাকায় কেনা ঔষধগুলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।
সেই ওনার নাকি আবার পেটে চকলেটের ফ্যাক্টরী হয়েছে। আপাতত প্রোডাকসন কম তবে বাড়ার সম্ভাবনা প্রচুর। কিছুদিন আগে সমস্ত শরীরের MRI করিয়েছে। আজ তার ছবি দেখবে । অবৈধ চকলেট উৎপাদনকারীদের খুটির জোরের একটা খসড়া চিত্র দিবেন ডাক্তার সাহেব। উকিল নোটিস ছাড়াই চকলেট উদপাদন কারীদের উচ্ছেদ অভিজানের পরিকল্পনা বাতলাবেন। অবৈধ চকলেট উৎপাদনকারীদের সামর্থ্য দেখার জন্য ECG, X-Ray করানো হবে। চকলেট উৎপাদনকারীরা ব্লাডের রুটটাকেও ব্যবহার করে কিনা, সেটারোও একটা চেক হবে। তাই সকাল থেকেই উপোষ দেয়া হয়েছে পেটটাকে। চকলেট উৎপাদনকারীদের বাই প্রোডাক্ট কি সেটাও দেখতে হবে ইউরিন পরীক্ষা করে। উচ্ছেদ অভিজানকালে আশেপাশের অধিবাসিগণ জাতে নিরাপদ থাকেন সেটা দেখবে অ্যানেসথিসিয়া ডিপার্টমেন্ট। পরিকল্পনাটা আজই ব্যাখ্যা করবেন। এত কিছু তাই আর্লি যেতে বলেছিলেন কর্তৃপক্ষ। ঠিক সময়ে যাওয়া আমাদের মানায় না, তাই একটু লেট করলাম।গেটে কোন দাড়োয়ান নাই তাই বাম হাতের ব্যাপারটির দরকার হল না। করাও নাড়তে হলনা ভিতর ঢোকার জন্য। আমাদেরকে দেখেই দরজা খুলে দিল। মনে হল যেন আমাদেরকে ভিতরে ঢোকানোর জন্য অনেকক্ষন ধরে অপেক্ষা করছেন।ভিতরে ঢুকতেই মনে হল কোন বড় লোকের বিশাল অত্যাধুনিক ড্রইংরুমে এসে পরেছি। নাতিশীতোষ্ণ বাতাসটাই বলে দিল এটা কোন সাধারন জায়গা না। কর্মচারিগণ মহাব্যস্ত। অতিথিদের আগমন এখনো চরমে পৌছে নাই। যে কয়জন এসেছেন তারা সবাই আসন নিয়েই অপেক্ষা করছেন। আমাদের দেখামাত্রই কর্মচারিগণের দুএকজন মাথা নামিয়ে কুর্নিশ করল। আগমনের ফরমায়েশ দাখিল করামাত্রই সংশ্লিষ্টরা ব্যাতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আগে থেকেই আসার কথা ছিল বলে খুব একটা সময় লাগল না করনীয় বিষয়বস্তুর লিস্ট পেতে।
চেকলিস্ট হাতে পেয়ে অভিযানে নেমে পড়লাম।বড় হাসপাতাল হলেও সাইনবোর্ড, নেমপ্লেট,ইনস্ট্রাকশন সবকিছুই জাপানীতে। Exit, MRI, CT ছাড়া প্রায় সবকিছুই জাপানী অক্ষরে লেখা। শিশু বিভাগ, প্রশুতি বিভাগের অক্ষরগুলোর সাথে বেশ পরিচিত। বাঙ্গালীদের কাছে কানজি ভাই (জাপানীজ ক্যারেকটার গুলোকে কানজি বলে, জাপানী ক্যারেকটারগলোতে ইনটারেস্ট ছিল বলেই, ব্যঙ্গ করেই হক আর রিসপেক্ট করেই হক আমি ঔ উপাধি পেয়েছিলাম) হিসাবে পরিচিত আমার জন্যও মুসকিল হচ্ছিল চেকলিস্টটাকে ফলে করে সেটাতে চেক মার্ক দেয়া। শুধু আমি কেন এখানকার ইন্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির কোন তুখোড় ছাত্রও হিমসিম খায় মেডিকেলের কঠিন সব টার্মগুলোক উচ্চারন করতে। তেমনি মেডিকেল ফ্যাকাল্টির ভাল স্টুডেন্টির দাত ভেঙ্গে যাবে ইন্জিনিয়ারিংয়ের টার্মগুলোকে পড়তে। আমাদের দেশের ওয়ান পাশ দেয়া ছাত্রের মত সবকিছুই গড়গড় করে পড়তে পারে না। অন্ধের হাতী দর্শনের মত হাতরিয়ে হাতরিয়ে খুজতে লাগলাম আমাদের গন্তব্যস্থল। বাসার লেখাপড়া করতে নাপারা হেলপার মেয়েটি যেমন মনিবকে আজকের পত্রিকাটি ঠিকই এনে দেয় তেমনি আমিও চেকলিস্টের একদুইটা শব্দকে মিলিয়ে মিলিয়ে ১ম গন্তব্যে পৌছে গেলাম। খালি পেটে করনীয় টেস্টটাই ছিল সর্বপ্রথম। কাউন্টারে দেখলাম বেশ ভীড়। ভীড় হলেও দেখলাম কারও ” আমি আগে ” করার ইচ্চা নেই। সামনে রাখা হাতলবিহীন চেয়ারগুলোতে বসে অপেক্ষা করছে সবাই।
১০০ বছরের ভারে কুজো হয়ে যাওয়া সিনিয়র লোক থেকে শুরু করে , ২০ বছরের টগবগে যুবক, পৃথিবীর আলোবাতাস দেখার সময় এক সপ্তাহ হয়নি ফুটফুটে বাচাটিও মায়ের কোলে ঘুমিয়ে অপেক্ষা করছে তার সিরিয়াল নাম্বারটির। কারো কোন তাড়া নেই। অপেক্ষার পালা শেষ হল যখন শুনলাম আমার সহধর্মিণীর নামটি উচ্চারন করতে কষ্ট হচ্ছিল ঘোষকের। সিস্টেম ইংরেজি শব্দ হলেও ওটার পুর্ণতা দিয়েছে জাপানীরা। ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম ৬-৭টা রক্ত নেবার আসন। ১-২টা বেডও আছে, আমার মত যাদের চেয়ারে বসে রক্ত দিতে অসুবিধা হয়, তাদের জন্য। নার্সগুলো রক্ত সংগ্রহের আগে রক্ত রাখার টেস্ট টিউবগুলোতে নামের লেবেলটা ভালভাবেই পরখ করছেন। গাইককুজিন ( বিদেশী ) বলে মনে হয় আমাদেরকে ডাকার আগেই চোখ দিয়ে চেক করে নিলেন আমাদের অবস্থান। চেয়ারে বসতেই নামটা জিঙ্গেস করে কনফার্ম করলেন টেস্ট টিউবে লাগানো লেবেলের নামটির সাথে। ভুল মানুষই করে তাই ভুল হওয়ার পারসেনটেজটা যাতে কম থাকে তারই প্রচেষ্টা আরকি। কোথা থেকে রক্ত সংগ্রহ করবে সেটাও জেনে নিলেন। পেট খালিই আছে কিনা সেটাও জেনে নিলেন। কতটুকু রক্ত নেয়া হবে তারও একটা ছোট্ট লেকচার দিলেন। অনেকবার পরখ করলেন কোন রক্তনালীটা থেকে রক্ত নিলে রোগীর কম কষ্ট হবে। রক্ত নেয়ার সময় একটু যে ব্যাথা হবে সেটাও বলতে ভুললেন না। মনে হল কোন রোবটকে সুইচ অনকরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে কাজের লিষ্ঠটা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ফলো করে সেগুলোতে টিক দেয়া। আমরা শুধু টিক দেয়ার ব্যাপারটা দেখছি না। সেটা নার্সগুলো ব্রেনের কোন একটা চেম্বারে সেভ করছে। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে আমার রক্ত পরীক্ষার অভিজ্ঞতা নাই, তাই বলতে পারব না একই নিয়ম ফলো করে কিনা। সহধর্মিণী দেশে রক্ত দিয়ে অভ্যেস্ত তাই তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা পরে শুনেছিলাম। সবকিছুতেই গড়মিল আমাদের সিস্টেমের সাথে এখানকার সিস্টেমের। আমাদের দেশের সরকারী হাসপাতালের নার্সগুলোর একটা কমন ডায়ালগ আছে আর সেটা হল ” ব্যাথা না পেয়ে রক্ত পরীক্ষা করাতে চান, এখানে এসেছেন কেন? প্রাইভেট ক্লিনিকে যেতে পারেন না! ” ভাবখানা এমন যে কাজকর্ম না করেই শুধু বেতন উঠাতে চান।
রক্ত দেয়া শেষ হলে আমাদের লিস্টের একটা আইটেম কমে গেল । বাকিগুলোও সেদিনেই সমস্যা ছাড়াই শেষ করলাম। সবকিছু চেক করে ডাক্তার অবৈধ চকলেট উৎপাদনকারীদের উচ্ছেদ অভিজানের তারিখ নির্ধারণ করলেন।
বিঃ দ্রঃ কয়েকদিন পূর্বে ডাক্তার,নার্সদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে চকলেট cyst গুলোর অপসারণ সফল হয়েছে। আল্লাহর রহমতে রোগী এখন ভাল ফিল করছে।
(মোঃ মাহবুবর রহমান তোত্তরি, জাপান, ,লেখক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার)