অনলাইন ডেস্ক: ০৪ নভেম্বর ২০১৫
একের পর এক মুক্তমনা মানুষ হত্যা ঠেকাতে না পারায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পদত্যাগের দাবি উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ড এবং শুদ্ধস্বরের প্রকাশনীর মালিকসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখমের প্রতিবাদে মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে এই সমাবেশ হয়।
এই দুটি প্রকাশনীই নিহত অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন, যাকে হত্যার জন্য জঙ্গিদের দায়ী করা হয়। অভিজিৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত আরেক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারববার বলে আসছেন, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা অবনতির কোনো সম্পর্ক নেই। এর ধরনের কথা না বলে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করুন।
“বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষ, অসাম্প্রদায়িক মানুষ ও সাধারণ জনগণের প্রতি সম্মান রেখে সসম্মানে পদ ছেড়ে চলে যান। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারলে আপনার এই পদে থাকার দরকার নাই।”
সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, “প্রতিটি হামলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৃদুভাষায় বলেন, ‘হত্যাকারীরা চিহ্নিত, তাদের ধরে ফেলব।’ কিন্তু হত্যাকারীরা ধরা পড়ে না। ধরতে না পারলে সসম্মানে পদ ছাড়েন।”
অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে কয়েকজন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এক যুগ আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপরও একই কায়দায় হামলা হয়েছিল, পরে তিনি মারা যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, “২০০৪ সালে হুমায়ূন আজাদকে হত্যা করা হলেও এখনও বিচার হয়নি। অন্যদের খুনিদের খুঁজে বের করা হয়নি।
“এক দুজন খুনিকে ধরার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কৃতিত্ব দাবি করেন, আবার ব্লগারদের সংযত হওয়ার কথা বলেন। এমন বক্তব্য হত্যাকারীদের হত্যায় উৎসাহিত করে।”
এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সরকারের ‘নিস্পৃহতার’ সমালোচনাও করেন অধ্যাপক আনোয়ার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক আবদুল আজিজ বলেন, “দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সরকারের কার্যক্রমে মনে হয় না স্বাধীনতার পক্ষের দল ক্ষমতায় আছে।”
আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ভূমিকার সমালোচনা করেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শফিক-উজ-জামান।
তিনি বলেন, “একদিকে ছাত্ররা তিনদিন ধরে বিক্ষোভ করছে, কিন্তু ছাত্রলীগ কোথায়? ছাত্রলীগ টেন্ডার নিয়ে গোলাগুলি করছে। তাদের একজনকেও তো রাস্তায় দেখিনি।”
সমাবেশ থেকে মুক্তমনা মানুষ হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের আহ্বান জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, “যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি এর সঙ্গে জড়িত। যখন সাকার বিচার (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী) শেষ পর্যায়ে রয়েছে, যে মুজাহিদ দম্ভ করে বলেছিল ‘দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই’- তার বিচার হচ্ছে, তখন তাদের সাথীরা বসে থাকবে আমরা কী করে ভাবি?”
দীপন থানায় জিডি করলেও তার নিরাপত্তায় কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় পুলিশের সমালোচনাও করেন তারা।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক গোলাম রব্বানী বলেন, “এরপর কাকে হত্যা করা হচ্ছে, সেই শঙ্কা আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকেছে। এরপর আর কোনো মুক্তমনাকে হত্যা করা হবে না, সেই নিশ্চয়তা আমরা সরকারের কাছে চাই।”
সহকর্মী আবুল কাশেম ফজলুল হকের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান শিক্ষকরা। ক্যাম্পাসে বেড়ে ওঠা দীপনকে নিয়ে স্মৃতিচারণও করেন কেউ কেউ।
রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, “রোকেয়া হলের আবাসিক কোয়ার্টারের তৃতীয় তলায় বেড়ে উঠেছে প্রকাশক দীপন। সদা হাস্যোজ্জ্বল, নম্র-ভদ্র দীপন কারও ক্ষতি করতে পারে এমন কিছু আমাদের মনে পড়ে না।
“তার বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হক আমাদের সহকর্মী। মা ফরিদা প্রধানও রোকেয়া হলে দীর্ঘদিন আবাসিক শিক্ষক ছিলেন। তাদের এই সন্তানকে হত্যা করা হল। কিছুদিন আগে হত্যা করা হয়েছিল আমাদের আরেকজন শিক্ষক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলেকেও।”
“স্যার, আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা আপনার সন্তানকে রক্ষা করতে পারিনি। সন্তান হারানোর পর আপনার বক্তব্যে আপনার আবেগ-অনুভূতি ও রক্তাক্ত হৃদয়ের যে অভিমান ঝরেছে তাও বুঝতে পারিনি,” বলেন এই শিক্ষক।
আওয়ামী লীগ সমর্থক নীল দলের আহ্বায়ক নাজমা শাহীন বলেন, “হত্যাকাণ্ডের পর দীপনের স্ত্রী যখন তার দুই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল, তখন আমাকে নিজের কাছে অসম্ভব রকম অসহায় মনে হয়েছে। অথচ আমিই তো ৭১-এর ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর যুদ্ধে নেমে পড়েছিলাম।”
অধ্যাপক ফরিদ বলেন, “হত্যাকাণ্ডের কারণে আমরা মর্মাহত, ব্যথিত। এর প্রতিবাদ ও সহকর্মীদের সমবেদনা কীভাবে জানাব, তার ভাষা আমাদের নাই।”
‘বিচার চাই না’- অধ্যাপক আবুল কাসেমের একথা নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফের বক্তব্যের সমালোচনাও আসে শিক্ষকদের বক্তব্যে।
টেলিভিশন ও ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এজেএম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, “একজন বাবা কোন পরিস্থিতিতে হত্যার বিচার চান না, তাও দেখতে হবে। তিনি অভিমান থেকে বিচার চান না, আমরা শিক্ষক সমিতি চাই। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে।”
অধ্যাপক শফিক-উজ-জামান বলেন, “মন্ত্রীদের বলব, কথা কম বলুন, কাজ বেশি করুন।”
সমাবেশে ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমানও বক্তব্য দেন।
সমাবেশের আগে মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দিনসহ দুই শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন। (সুত্রঃ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)