জাপানে জিকোশোকাই (自己紹介) কথাটা ভোগায় নবাগতদের । Self-introduction নামক এই বিলেতী কালচারটা বেশ সিভিয়ার এখানে । নিজের ঢোল নিজে পেটানো যে কত কষ্টকর, তা অন্যরা কেমন পারে বলতে পারব না, আমি যে খুব ভাল পারি না সেটার প্রথম প্রমান পেলাম তোকোশিমার পোর্টে পা রেখেই । প্রফেসর ডান হাত খানা এগিয়ে দিয়ে বলনেন ” I am Tatasuo Kanashiro. Welcome! ”
এবার আমার পালা । “I am Mr. Mahbubar Rahman . Nice to meet you ! ” প্রফেসরকে একটু হাসতে দেখলাম । কারন বুঝে উঠতে না পেরে চোখটাকে ভায়রা ভাইয়ের দিকে ঘুরালাম । হাসির শব্দ থামাতে ভায়রা ভাই ততক্ষনে মুখ হাত দিয়ে ঢেকেছেন । কি ভুল করলাম ? নিজের ঢোলটা তো আস্তেই পেটালাম । বুঝতে দেরি হল না মোঃ টা কখন যে মিঃ এ পরিবর্তিত হয়েছে টেরই পায়নি । প্রফেসর কি ভাববে! যে নিজের ঢোলটাও ঠিক মত বাজাতে পারেনা সে রিসার্চ করবে কিভাবে? লজ্জায় মাথাটা পানি না পাওয়া কচি গাছটার মত নুয়ে পড়ল । পিঠে জুলফিকার ভাইয়ের (ভায়রা ভাই) হাতের আলতো টোকায় নরমাল হবার চেষ্টা করলাম । অপর জাপানীর সাথে করমর্দন করতে যেয়ে ফ্যামিলি নামটা শুধু কানে ঢুকলো । সেটা ছিল সাকানো । জাপানে বিভিন্ন কিসিমের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, কিন্তু সাকানো সানের (সান টা জাপানে সন্মানসুচক উপাধি) মত ভাল মানুষের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য আর হয়নি ।
প্রফেসরের গাড়ীতে চড়ে রওনা দিলাম জাপানে আমার বাসস্থানের উদ্দেশ্যে । আশেপাশের সুউচ্চ বিল্ডিংগুলো দেখে মস্তিস্কের কমপেরিজন সফটওয়্যার কিছুতেই মেলাতে পারছে না সংরক্ষিত রাখা তথ্যের সাথে । কাগজের ঘর কোথায় ? রাস্তাঘাট তো ঝকঝকে তকতকে , রাস্তার লাইট ও সিগনাল বাতি রাস্তাগুলোকে আরো ফকফকা বানিয়েছে । গাড়ী অনেকক্ষন দৌড়িয়েছে কিন্তু ভেপুর শব্দ কানে ঢুকছে না কেন? গাড়ীগুলোর হর্ন সিস্টেম কি নষ্ট? পরে জেনেছি নিত্যন্তই দরকার না পরলে এরা হর্ন বাজায় না । বাংলাদেশে যেমন লেখা থাকে সামনে হাসপাতাল, হর্ন বাজানো নিষেধ । জাপানের কিছু কিছু জায়গায় তেমনি লেখা থাকে এখানে ভেপু বাজাবেন ।
রাস্তায় ট্রাফিক লাইটের সংখ্যা এত যে গাড়ী দৌড়ানোর চেয়ে থামছে বেশী । প্রফেসর ড্রাইভ করতে করতে জানতে চাইল কেমন লাগছে জাপান ? সংক্ষেপে উত্তর দিয়েছিলাম । মন বলছিল শর্ট প্রশ্নটা ব্রড বানিয়ে উত্তর দেই । ভাল লাগা নির্ধারনে যদি লিমিট থাকতো তবে সেটা যে অতিক্রম করত তাতে কোন ভুল নেই।
এক ঘন্টার মত লেগেছিল বাসায় পৌছাতে । জাপানের ঘরে প্রথম পদার্পণ । জাপানীরা বাড়ির সাইজ নির্ধারন করে *LDK ( লিভিং , ডাইনিং ও কিচেন ) দিয়ে । * টাতে সংখ্যা বসিয়ে বুঝানো হয় বাড়িটা কত বড় । সংখ্যাটা যত বড় রুমের সংখ্যাও তত বেশী । আমারটা ছিল ২LDK । মানে দুইরুম বিশিষ্ট, সাথে ডাইনিং ও কিচেন । জাপানে বাড়িগুলোর বৈশিষ্ট্য মোটামুটি একই । মেইন এনটারেন্স ঢুকলেই ডানপাশে উদরপূর্তির জায়গা, বাম পাশে উদরকে খালি করার জায়গা । ভাইস ভারসাও হতে পারে । তারপরে অন্য রুমগুলো।
আমি হোস্ট হলেও আমাকে গেস্টের মত মনে হল বাসাটাতে । প্রফেসরকে দেখলাম নামাজের ভঙ্গিতে বসে পরলেন মেঝেতে সাথে অপর জাপানীজ মিঃ সাকানো ও । এটা জাপানিজ ক্যালচার । ভায়রা ভাইকে দেখলাম বাঙ্গালী কায়দায় বসতে । ব্যাপার কি ? জাপানীরা কি মেঝেতে বসে? পরে জেনেছিলাম জাপানী স্টাইলের ঘরগুলোর মেঝে তাতামি নামক সিট বসানো থাকে । তাতামির বর্ননা দিতে বই লিখতে হবে, শুধু এটুকুই বলব মাদুরে (আমাদের গ্রামে শপ বলে) বসে নামাজ পরার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাদের বুঝতে সুবিধা হবে । চার পাচখানা মাদুরকে এক সাথে পাশাপাশি রাখলে যেমন হবে জাপানীদের তাতামিগুলো অনেকটা সেরকম । আমার কাছে মনে হয়েছে খড়ের বড় বড় টাইল । তাতামির সংখ্যা দিয়ে ঘরগুলোর সাইজ নির্ধারিত হয় । এয়ার কন্ডিশনগুলোর rank ও তাতামির সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় । এক ফাকে ভায়রা ভাই জানিয়ে দিলেন তাতামির যেন ক্ষতি না হয়, ক্ষতি হলে বড় আকারের আক্কেল সেলামী গুনতে হবে । কথাটা শোনার পর যতদিন ছিলাম ঘরটিতে, পায়ের চাপ কমই অনভব করেছে তাতামিগুলো। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি, পাতিলের পশ্চাতদেশের গরমে পুড়ে গিয়েছিল কিয়দংশ !
কথাবার্তার ফাকে চোখ পরল ঘরের দেয়ালগুলোর দিকে । ঠিক দেয়ালও না আবার জানালাও না । বুঝে উঠতে পারলাম না ঘরের এই নতুন সিস্টেম দেখে । দেয়ালের কিছু অংশ কাচের আবার কিছু অংশ কাগজের । সবাই চলে গেলে দেয়ালের নতুন এই সিস্টেমটার রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । দু পর্দা বিশিষ্ট এই দেয়ালগুলো আসলে স্লাইডিং ডোর । ঘরের বাহিরের দিকে পুরোটাই কাচের ভিতরের দিকের অংশটুকু কাগজের । জাপানের বাড়িঘর যে কাগজের সেই প্রপাগান্ডাটার রহস্য কিছুটা হলেও উদঘাটন হল । শীত প্রধান দেশ তাই অভিনব টেকনিক ফর ভেনটিলেশন । জাপানে এগুলোকে শোওজি ( 障子 ) বলে । শীতকালে এয়ারটাইট আর গ্রীষ্মকালে কমফোরট্যাবল । বাংলাদেশী জীনবাহক ছেলেমেয়েরা হলে জাপানের জানালাকে ক্যানভাস বানিয়ে সৃষ্টি করত কালজয়ী চিত্র । পরবর্তীতে আমার ছেলে সেটার প্রমান রেখেছে ।
ছোট আপা (সহধর্মীনীর ছোট আপা)একটু দুরেই ইন্টারন্যাশনাল হাউজে থাকেন । উনি একটা সাইকেল কিনে রেখেছিলেন আমার জন্য । চিন্তায় ছিলেন আমার সাইকেল চালানো নিয়ে, কেননা ভায়রা ভাইয়ের নাকি সাইকেল চালানোর হাতেখড়ি জাপানে এসে । শুধু আমার ভায়রা ভাই না । অনেকে এখানে এসেই সাইকেলে চড়া শিখেছে। শাড়ী ছাড়া যে ভদ্র মহিলাটি রাস্তায় বেরুতেন না, তিনিও সাইকেলের সামনে ছেলেকে বসিয়ে পিছনে মেয়েকে নিয়ে ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে আসেন ।
আমার সাইকেল চালানো দেখে উনি মনে হয় আকাশ থেকে পরলেন। সাইকেল চালানোর লাইসেন্স তো ক্লাস থ্রিতেই নিয়েছিলাম । ব্রেকহীন সেই সাইকেলের সাথে জাপানী সাইকেলের তুলনাই হয় না।
বিদেশের মাটিতে হোম সিকনেস হয় প্রথম দিকে । ছোট আপা এবং ওনার বাচ্চাদের উপস্থিতিটা টেরই পেতে দেয়নি হোমসিক নামক ব্যাধিটার । । সেদিন রাতের বেলায় দেখলাম ছোটখাট হাট বসেছে আপার বাসায় । সবাই বাংলাদেশী । একজন আবার শহীদুল্লাহ হলের আমার জুনিয়র । ওয়াদুদ নামের সেই ছেলেটির সাথে ইন্টিমিসি একটু বেশীই হয়েছিল জুনিয়র হলেও । তবে খুব মনে পড়ে ছোট আপার জমজ ছেলে শান্ত এবং সাম্যর কথা । দুজনের বৈশিষ্ট্য নামের ঠিক বিপরীত । দেশে থাকতে খুব একটা সান্নিধ্যে আসেনি । নতুন খালুকে পেয়ে দুইজন দুই কাঁধে চড়ে জাপানীজ টিভি দেখত আর গান গাইত । এখন ওরা পুরোদস্তর lawyer । আইনের কঠিন কঠিন সব মারপ্যাচ দিয়ে মুক্ত করছে ক্লায়েন্টদের । আমার কাছে মনে হয় এইতো সেদিন…
এরই মধ্যে জাপানে ভ্যাট পাচ ইয়েন থেকে বেড়ে আট ইয়েন হয়েছে । চারটা অলিম্পিক দেখেছি জাপানের টিভিতে । বোল্টের মত দ্রুতগতির মানবের উত্থান ও পতন দুটোই দেখলাম ।
আরো পড়ুন :