আজ ২৯শে মার্চ- রুমীর জন্মদিন ।
[রুমী সম্পর্কে আমরা যা জানি, যতটুক জানি, সেই জানার মাঝে কিছু কথা সংযোজন করতেই এই লেখার অবতারণা এবং তা করার আগে কিছুটা ভূমিকা প্রয়োজন । শুরুতেই জানিয়ে রাখছি যে – সর্বপরি এটি একটি দীর্ঘ লেখা]|এক|
একটি কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে গেছে, যদিও ঘটনা ঘটার মূহুর্তে তা আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। হয়তো সেই মূহুর্তে আমি অনেকটা ঘোরের মাঝেই ছিলাম, বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যে- এমন কিছুর সাক্ষ্য হতে যাচ্ছি আমি ! হুট করে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটতে থাকলে যেমন হয় আর কি । রুমীর কথায় আসার আগে সেই কাকতালীয় বিষয়টার আলোকপাত না করলেই না । আম্মা (শহীদ জননী জাহানারা ইমাম) আমাদের জন্যে “একাত্তরের দিনগুলি” লিখে রেখে গেছেন । রুমীর কথা, ক্র্যাক-প্লাটুনের গেরিলাদের কথা, অপারেশন সহ নানা ঘটনার কথা উঠে এসেছে “একাত্তরের দিনগুলি”-তে । একাত্তরের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে আম্মা দিনলিপির প্রথম পাতায় লিখেছিলেন ১লা মার্চ, ১৯৭১ এর কথা, আর তিনি সমাপ্তি টেনে ছিলেন ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ এর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে । কাকতালীয় ব্যাপারটার সাথে সমাপ্তির দিনটি সম্পৃক্ত । “একাত্তরের দিনগুলি”-তে বর্ণিত আম্মার স্মৃতিকথার আলোকে নিম্নে ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ এর দৃশ্যপটটি একটু তুলে ধরছি ।
১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রায় প্রথম একটি পূর্নাঙ্গ দিনের শুরু । ভোর হতেই ৩৫৫, এ্যালিফেণ্ট রোড, ‘কনিকা’ নামের দ্বিতল বাড়িটির ছাদে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা । ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে যে পতাকাটা নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলো রুমী-জামিরা, সেটিই আজ ছাদের ফ্ল্যাগপোলটায় শোভা পাচ্ছে । ২৩ শে মার্চ প্রতিরোধ দিবসে পতাকাটি তোলা হয়েছিলো প্রথমবার, তখন স্বাধীনতা ছিলো না, তবে বাড়ির সবাই উপস্থিত ছিলো সেদিন; কিন্তু আজ স্বাধীনতা আছে, কিন্তু নেই বাড়ীর কর্তা শরীফ ইমাম, নেই রুমীও । পাকিস্তানী আর্মিরা রুমীকে ধরে নিয়ে যাবার পর ৭৮ দিন পেড়িয়ে গেছে, রুমী ফেরেনি, কবে ফিরবে, আদৌ ফিরবে কিনা- কেউ জানে না । ‘পাঞ্জাবী মারবে, বিহারী মারবে’ – বলে মাঝেই মাঝেই ছুটে বেড়িয়ে পড়তে চায় জামী, আম্মা ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখে । পাকিস্তানী হায়নাদের কপালে পরাজয়ের তিলক এঁকে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ যখন ফের হাসতে শিখছে, সেই মূহুর্তে কণিকার চার দেয়াল ছেঁয়ে আছে বিষাদের আভায় ।
সন্ধ্যার পর একটা মোমবাতি জ্বেলে ভূতুরে আলোয় জামীকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলেন আম্মা । এইসময় বাসায় সামনে হঠাৎ একটি জীপগাড়ি এসে থামলো, ক্ষণিক পরেই দরাজায় কড়া নাড়লো কেউ । আম্মা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই শাহাদাত, আলম, আনু, জিয়া, ফতে, চুল্লুকে নিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করলো মেজর হায়দার । ওঁরা সবাই রুমীর সহযোদ্ধা আর মেলাঘরে মেজর হায়দারের কাছেই ওরা গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিলো, রুমীও নিয়েছিলো ।
আম্মা সবাইকে নিয়ে ডিভানে বসতে দিলেন, চোখের জলে কিছু কথায় কিছুটা সময় কেটে গেল । তারপর আম্মা মেজর হায়দারের দিকে তাকিয়ে বললেন- “জামী পারিবারিক অসুবিধার কারণে মু্ক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি । ও একেবারে পাগল হয়ে আছে । ওকে কাজে লাগাও ।”
মেজর হায়দার বলল- “ঠিক আছে জামী, এই মূহুর্ত থেকে তুমি আমার বডিগার্ড হলে । এক্ষুণি আমার সঙ্গে আমার অফিসে চল, তোমাকে একটা স্টেন ইস্যু করা হবে । তুমি গাড়ি চালাতে পার ?”
জামী সটান এ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে ঘটাং করে এক স্যালুট দিয়ে বলল, “পারি” ।
“ঠিক আছে, তুমি আমার গাড়িও চালাবে।“
জামীর পাশেই আলী দাঁড়িয়ে ছিল । জামী বলল, “স্যার, আমার বন্ধু আলী-”
মেজর হায়দার গম্ভীর মুখে বলল, “ইনফ্যাক্ট আমার দু’জন বডিগার্ড দরকার- তোমার বন্ধুকেও অ্যাপয়েনমেন্ট দেয়া গেল । কিন্তু ভেবে দেখ, পারবে কি না । এটা খুব টাফ জব । চব্বিশ ঘন্টার ডিউটি” ।
পাঁচদিন পর জামী এই প্রথমবারের মত দাঁত বের করে হাসল, “আটচল্লিশ ঘন্টা হলেও পরোয়া নেই” ।
বিষাদ ঘেরা ক্ষণে জামীর মুখে হাসি ফুঁটে উঠার কথা দিয়েই আম্মা “একাত্তুরের দিনগুলি” শেষ করেছিলেন । “একাত্তুরের দিনগুলি” পড়া শেষ করা মাত্রই ভেতর থেকে যে কথাটার সন্মুখিন হয়েছি, তাহলো – “তারপর” …
রুমী আর ফিরে আসেনি, দু’দশকের বেশি হলো আম্মাও চলে গেছেন । সঙ্গত কারণে ঘুরে ফিরে একটি প্রশ্ন এসেছে মনে – গভঃ ল্যাব. দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া সেই জামী আজ কোথায় ?
____
|দুই|
আমি বিস্ময় আর উত্তেজনা নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠছি, আমার সামনে উঠে যাচ্ছে শাওন আপা আর টিপু ভাইয়া । পুরানা পল্টনের এই বাড়িটির তিন তলার বসার ঘরে প্রবেশদ্বারে যখন এসে দাড়ালাম, তখন আমার হার্ডবিট যে দৌড়াচ্ছে, সেটা ভালই অনুভব করছিলাম । কারণ বহুদিন ঘুরে ফেরা যে প্রশ্নটি মনে ভেতর খোঁচাচ্ছিলো, তার উত্তর সেই মূহুর্তে আমি প্রত্যক্ষ করছি । সাড়ে চার দশক আগে, ১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বরের সন্ধ্যারাতে যে ছেলেটি মেজর হায়দারের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলো – “আটচল্লিশ ঘন্টা হলেও পরোয়া নেই”, সেই জামীকে আমি দেখছি । কিছুক্ষণ আগেও কল্পনায় ছিলো কনিকার বসার ঘরে দাড়িয়ে থাকা সতের বছরের সেই জামী, আর এখন ! বাস্তবে সেই দৃশ্যপট পাল্টে গেছে, অন্য একটি বসার ঘর, অন্যান্য সকলকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে ষাটোর্ধ্ব হাস্যজ্জ্বোল জামী, সাইফ ইমাম জামী, শহীদ রুমীর ছোট ভাই, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছোট ছেলে । সেই মূহুর্তে যা খেয়াল করিনি, তা হলো – এই দিনটিও ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ, সালটা শুধু ১৯৭১ থেকে বদলে ২০১৪ হয়ে গেছে । “ তারপর … জামী কোথায়?” – প্রশ্নটির উৎপত্তি ও নিষ্পত্তি ঘিরে ঐ একই তারিখ- ১৭ই ডিসেম্বর, যখন বিষয়টি লক্ষ্য করেছি, আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি- এমন ঘটনাকেই নিশ্চয়ই কাকতালীয় বলে উল্লেখ করে সবাই !
____
|তিন|
গৃহকর্তী শিমূল ইউসূফ (ছোট্টি বলে ডাকি আমরা) হাসি মুখে এগিয়ে এসে বললেন- “আয় রনিতু, ভেতরে চলে আয়” ।
আমি ভেতরে ঢুকলাম ।
পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য শাওন আপা বললো – “জামী মামা, এই হলো আমার এক ছোট ভাই-রনী ।“ জামী মামা হাত বাড়িয়ে দিলো – হাতের স্পর্শে মনে হলো- কত দিনের চেনা একজনের হাতে হাত রাখলাম ।
২৯-৩০ আগস্ট, ১৯৭১ আলতাফ মাহমুদ, রুমী, আজাদ, বকর, বদি, জুয়েল, হাফিজদের পাকিস্তানী আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়, ওঁরা আর ফিরে আসেনি । সেই সময় থেকেই রুমী আর আলতাফ মাহমুদের পরিবারের মাঝে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে, সময়ের স্রোতে তা আরো অটুট হয়েছে ।
সাইফ ইমাম জামী দীর্ঘদিন ধরেই মিসিসিপি-তে সেট্লড, মাঝে মাঝে দেশে আসেন, নিভৃতে কিছুদিন কাছের মানুষদের মাঝে কাটিয়ে আবার ফিরে যান । এবার দুবছর পর ঢাকায় আসা, আর তাকে কেন্দ্র করেই শিমূল ইউসূফ আজকের রাতে আড্ডার (নৈশ্যভোজের) আয়োজন করেছেন নিজ বাসায় । সেই আড্ডায় স্বভাবতই নাসিরউদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু, সারা আরা মাহমুদ, শাওন মাহমুদ, সাইদ হাসান টিপু থাকবেন, তবে এইবার আরো দুজন ছিলেন- দিনু বিল্লাহ আর তার স্ত্রী মাহবুবা কুঞ্জ (মিস্টি মামী), ওরাও দেশে এসেছে কিছুদিনের জন্যে ।
কিন্তু আমি ! না, কোনভাবেই সেখানে প্রত্যাশিত ছিলাম না আমি । ক্র্যাক-প্লাটুনের গেরিলারা আমাকে ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করে, ওঁদের কথা, সব খুঁটিনাটি, সব কিছু জানার একটা আগ্রহ আমার মাঝে সব সময় কাজ করে, এই কথাটা শাওন আপার জানা ছিলোই বলেই – সেইদিন এই অসাধারণ মানুষগুলোর মাঝে আমাকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন । আর Club Obscure গত কয়েক বছর ধরেই অনলাইনে ক্র্যাক-প্লাটুনের গেরিলাদের বীরত্বগাঁথা তুলে ধরতে কাজ করছে, আমিও ক্লাবের একজন সদস্য, অল্পবিস্তর কাজে আমিও যুক্ত । স্বয়ং সাইফ ইমাম জামীর কাছ থেকে রুমী সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিতেই শাওন আপা তাই আমাকে সেদিন নিয়ে যায় ।
আড্ডার ফাঁকে তারপর সেই সুযোগ আসে, ঘন্টাখানেক আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রুমীর কথা শুনি সাইফ ইমাম জামীর স্মৃতি থেকে । ধারাবাহিক কিছু না, কিন্তু সংক্ষেপে রুমী সম্পর্কিত অনেক কথা উঠে আসে এই বক্তব্যে । কথাগুলো রেকর্ড করেছিলাম, ভেবেছিলাম নিজের মতো করে এই নিয়ে লিখবো । রেকর্ড শোনার পর ভেবে দেখলাম, ছোট ভাইয়ের স্মৃতিতে রুমীর কথাগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা হুবুহু সেভাবে লিখে সকলকে জানানোটাই উত্তম হবে । সেদিন রুমীকে নিয়ে বলা সাইফ ইমাম জামীর পুরো বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক সবটুকুই তুলে ধরলাম, তার জবানিতেই:
|চার|
“#সাইফ_ইমাম_জামীর_স্মৃতিতে_একাত্তরের_দিনগুলি”
“ওর ইনভল্ভমেন্ট, ব্যাপার-স্যাপার বাসাতেই আলাপ আলোচনা হতো, এটা এমন নয় যে- আমি একদিন জানলাম, ও (রুমী) হঠাৎ চলে গেছে । ও যেদিন গেলো- আমিও তো গেছি গাড়িতে ওর সাথে । ওকে নামিয়ে দিয়ে আমরা আবার চলে আসি ।
আমাদের বাসার নিয়ম-কানুন ছিলো যে- বাবা-মা শুধু না বলবেন না, কোন কিছু যদি চাওয়ার থাকে, শুধু হ্যাঁ-না… যদি না বলে, আমাদের অলটারনেটিভ ছিলো যে- আমরা আমাদের যুক্তি দিয়ে বলবো কেন এটা আমরা চাচ্ছি, ইত্যাদি । এমন ছিলো না যে – বাবা-মা “না” বলছে, ব্যস ! আর কোন কিছুই করার নেই ।
তারপর আব্বা-আম্মার সাথে ভাইয়ার এই নিয়ে (যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়ে) অনেক আলোচনা হতো, সবার সামনেই হতো, খাওয়ার টেবিলে, সাধারণত খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আমরা অনেকটা সময় কথাবার্তা বলতাম খাবার টেবিলেই বসে । শেষে একসময় ভাইয়া কনভিন্স করতে পারলো যে – আমেরিকায় পড়াশোনা করতে না যেয়ে যুদ্ধে যাওয়া উচিৎ । আর এসব তো আম্মা বইতেও লিখেছে, তোমরা তা জানো । তবে এর পেছনে অনেক দিনের ডিসকারশন ছিলো, ব্যাক এন্ড ফোর্থ …
আর ২৫শে মার্চের পর যখন ওরা প্রথম কারফিউ দিলো, আমরা বাসা থেকে বেরুলাম ঢাকা শহরের পরিস্থিতি দেখার জন্যে । আমার আব্বা তখন ঢাকা ক্লাবের মেম্বার ছিলেন এবং আম্মা খুব সক্রীয় ছিলেন ক্লাবের সাথে । তো ক্লাবে যারা কাজ করতো, স্পেশালি যারা বাগান দেখাশোনা করতো, টেনিসকোর্ট দেখাশোনা করতো- তারা সবাই হিন্দু ছিলো… হয়তো সকাল এগারোটা সাড়ে এগারোটা হবে তখন, আম্মা বললো যে, ‘এবার ঢাকা ক্লাবের ওদের খোঁজ নেয়া দরকার’ … । চিন্তা করো- এরা যারা, আমাদের কালচারে এদের কথা কেউ ভাববার কথা না, কিন্তু আম্মা ওদের কাছে এমন ছিলেন না, বললেন- চল খোঁজ নিয়ে আসি । যখন ঢাকা ক্লাবে ঢুকলাম, শুধু দেখলাম ডেডবডি পড়ে আছে । ওদের পেছনে একটা কোয়ার্টার ছিলো, ওরা ওখানে থাকতো, থেকে কাজ করতো, একেক জন গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে আছে, সবাইকে মেরে ফেলেছে । এগুলো দেখার পর তো আসলে আমরা যারা এসব দৃশ্য দেখেছি, তাদের কাছে সাথে সাথে একটা স্পন্টেনিয়াস ডিসিশন হয়ে গিয়েছিলো (এসব দৃশ্যই মূলত রুমীদের যুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছিলো) … আমার মনে হয়, আমি যেটা উপলব্দি করেছিলাম যে- //যদি মারবেই, তাহলে কয়টাকে মেরে মরবো//
ভাইয়া আর আমার বয়সের তফাত অলমোস্ট সাড়ে তিন বছরের । ভাইয়ার জন্ম ৫১ এর মার্চে আর আমার ৫৪তে সেপ্টেম্বরে । ছোট বেলা থেকে ক্লাস নাইনে ওঠা পর্যন্ত আমরা খুব একটা অর্থাৎ আমাদের মাঝে খুব একটা একচেঞ্জ হতো না । ঐ পর্যন্ত ওর বন্ধু ওর, আমার বন্ধু আমার … মজার মজার সেসব মেমোরিজ থাকে, তা সব দুষ্টামির মেমোরিজ (বলতেই জামী মামার ঠোঁটের কোণে যেন এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো- দুষ্টামির স্মৃতিগুলো যেন সামনে ভেসে উঠেছে)… সেই সময় আমাদের বাসার লে-আউট এমন ছিলো যে- সিড়ি দিয়ে উঠেই বসার জায়গা ছিলো, আম্মাদের বেডরুম ছিলো এইখানে (বসার ঘরের পাশে), আমার বেডরুম ছিলো এইখানে (আম্মার বেডরুমের পাশে), ভাইয়ার একেবারে কোণারটা । আমাদের দুই বেডরুম পাশাপাশি হওয়াতে আর ভেতর থেকে একটা দরজা ছিলো- যেখান থেকে আম্মাদের বেডরুমে যাওয়া যেতো । উপরে এসে যদি কেউ বসতো, আমরা তিনজন তিন রুমে যাওয়া আসা করতে পারতাম বাইরে বের হয়ে না এসেই । কিন্তু ভাইয়ার বেডরুমে ঢুকতে গেলে আমার বেডরুম দিয়ে ঢুকতে হবে । যখন কিছু নিয়ে ঝগড়া লাগতো, আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিতাম, আমি বলতাম- “যাইতে পারবা না” … (হা হা হা); ও বাইরে থাকলে ভেতরে আসতে পারতো না, ভেতরে থাকলে বাইরে । এই সব অনেক দুষ্টামি, আর ঝগড়া হতো অনেক কিছু নিয়ে, দুই ভাইয়ের ব্যাপার তো, … ঐ রকম স্পেসিফিক কিছু এখন মনে নাই, তবে কখনো কখনো দুজনের মাঝে কমিক বুক নিয়ে খুব লাগতো ।
ও তো বই পড়তো, আমিও পড়তাম, আমরা দুজনেই খুব বই পড়তাম । আমি সেতার শিখতাম আর ভাইয়া তবলা বাজাতো । গান শুনতাম, Beatles এর রেকর্ড প্রথম শুনলাম- সিক্সটি-ফোরে, আম্মা যখন অ্যামেরিকা থেকে ফিরে আসলো, তখন সাথে নিয়ে এসেছিলো । সামথিং নিউ… সেই Beatles শুনলাম, আমাদের রেকর্ড mixed Genres ছিলো; Rock ছিলো- Cliff Richard, Tom Jones, Beatles, Engelbert Humperdinck, এইগুলো সব চলতো ঐ সময় । আর তারপরে তো Classical ছিলো – রবি শঙ্কর, আলী আকবর খান- এঁদের শুনতাম । ও তো… ওর একজন ভাল ঘরনার উস্তাদ ছিলো – তবলার, খুব পছন্দ করতো ভাইয়াকে । আর আমি তখন উস্তাদ খুরশীদ খানের সাথে ক্লাসিকাল শিখতাম- সেতার । তারপর ছায়ানটে … এইসব । তো ঝগড়া মানে কি ! ঐ ভাইয়ে ভাইয়ে যা হয়, যে কোন কারণেই হোক- আর আমার ঐ সবচেয়ে বড় অস্ত্র – কিছু হলেই দরজা বন্ধ করে দিতাম, হয় ওকে ভেতরে আটকে রাখতাম, নয়তো ও ভেতরে ঢুকতে পারতো না (আবারো সেই স্ফীত হাসি ফিরে এলো ঠোঁটের কোণে) …
কোন এক কারণে আমাদের পাড়ার লোকদের আমাদের উপর খুব হিংসা ছিলো । আব্বা প্রফেসনাল, আম্মা তো নিজেই গাড়ি চালাতো, শহর ঘুরে বেড়াতো, চলাফেরার সময় ঐ এক ধরণের টিটকারি ছুড়ে দিতো … ।
এখন সবাই বলে- আপনার খুব সুন্দর চোখ, কিন্তু যখন আমি বড় হচ্ছি- তখন সবাই আমাকে টিজ করতো, বিভিন্ন নাম ধরে ডাকতো, আর “বিলাই চোখ” তো ছিলো নাম্বার ওয়ান । তবে ভাইয়ার চোখ ছিলো কালো । মাঝে মাঝে এগুলো নিয়ে লাগতো (টিজ করা নিয়ে) পাড়া পড়শিদের সাথে । তখন একদিন আম্মা আমাদের বললেন যে- তোমাদের সেল্ফ ডিফেন্স করতে হবে। তখন আমরা বক্সিং শেখা শুরু করলাম । ছাদের ঘরটা ছিলো আমাদের জিন্মেসিয়াম । ভাইয়া ওখানে জুডো শিখতো, কারাতে প্র্যাকটিস করতো । ও তো পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন ছিলো- ফাস্ট জুডো টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন, ওর বেল্টও ছিলো । ঐ জুডোর সময় খুব মজা হতো, আমরা ছাদে একসাথে এক্সারসাইজ করতাম, জুডো প্রাকটিস করতাম একসাথে, ও আবার কারাতে এ্যাড করলো ওর এক্সারসাইজে, সেটা আবার ক্লাসিক্যাল কারাতে, শুধু মারাপিট না, স্পিড … আর সাথে সাথে ফিজিক্যাল পেইন ম্যানেজ করাটাও রপ্ত করতো … (আম্মা কিছু কিছু বইতে লিখেছিলেন) কি করে মেন্টালি ব্যাথাটাকে দমিয়ে রাখা বা ডিস্ট্র্যাক্ট করা যায় ।
ঐ সময় একটা ব্রিটিশ স্পাই মুভি বেরিয়েছিলো- “The Ipcress File” (1965), মুভিতে ছিলো Michael Caine, ও ছিলো ব্রিটিশ স্পাই, ধরা পড়ে । ওকে ধরে ওর কাছ থেকে ইনফর্মেশন জানার চেষ্টা করছিলো । ধরা পরার পর ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়, হাত বেঁধে । বিভিন্ন প্রশ্ন, নানা রকমভাবে টর্চার করছিলো, ইলেকট্রিক শক ইত্যাদি … বন্দী অবস্থায় ও একটা পেড়েক পেয়ে যায়, আর হাতের তালুতে লুকিয়ে ফেলে, যখন টর্চার আরম্ভ করতো, ঐ পেড়েকটা ও হাতের তালুতে চেপে ধরে ফুড়তো, ফুড়ে কচলিয়ে ঐ পেইনটাতে কনসেনট্রেট করতো । নট ওরা কি করছে ওকে কথা বলানোর জন্যে । পেড়েক ফুড়ছে, রক্ত বেরুচ্ছে, আর ও শুধু রিপিট করছে- My Name is Harry Palmer, এটা ছাড়া কিছু বলছিলো না সে । ভাইয়ার মাঝে এইটা খুব লাগছিলো, এই মুভিটা ওকে ভীষণ ইম্প্রেস করেছিলো ।
তারপর থেকে আমরা যখন জুডো প্র্যাকটিস করতাম, ভাইয়া উপুর হয়ে শুতো, জুডোর বেল্ট হাতে দিয়ে বলতো- আমার গলায় চেপে দম বন্ধ করার চেষ্টা কর । আমি চেপে ধরতাম, ও ঘড়ির দিকে চোখ রাখতো, যখন আর পারতো না, তখন ম্যাটের উপর আস্তে করে টোকা দিতো, আমি ফাঁস ঢিলে করে দিতাম । আমার মনে হয়, ওকে (রুমীকে) যখন ধরে নিয়ে যায়, অ্যাই এ্যাম শিওর, কতটা পেরেছিলো জানি না, টু সাম এক্সটেন্ড ও এগুলো এ্যাপ্লাই করেছিলো । ও যে মেন্টাল ক্যাপাসিটি নিজের ভেতর তৈরি করছিলো- আম্মা একটু আধটু লিখেছিলেন বইয়ে ।
ও যে যুদ্ধে গেলো…. আসলে আমরা নাহ বই পড়ে অনেক কিছু বুঝতে পারতাম, দুনিয়াতে কি হচ্ছে – বই পড়ার যে কি ইমপরর্টেন্স, তা বলার অপেক্ষা রাখে না, ইজি লার্ন … তোমরা জানো কিনা, আর্মির ইউনিফর্ম পড়ার একটা কারণ আছে, প্রত্যেক দেশের আর্মির ইউনিফর্ম আইডেন্টিফাইয়েবল । যখন যুদ্ধ হয়, ইউনিফর্ম দেখে বোঝা যায় ওরা স্যোলজার, ওদের দিকে গুলি ছোড়া হয়, তারা যদি ধরা পড়ে, তাদের একটা প্রটেকশন আছে, একবার যদি ওরা সারেন্ডার করে, ইউ ক্যান’ট কিল দেম, তুমি যদি মারো দেন ইটস্ কনসিডারড এ্যজ ক্রাইম, জেনেভা কনভেনশন ওদের এখানে প্রটেকশন দেয় । কিন্তু একজন গেরিলা, তাদের কোন ইউনিফর্ম নাই, তাদের মেইন ফোকাস হলো জনগণের সাথে মিশে যাওয়া, কেউ যেন তাদের আইডেন্টিফাই করতে না পারে । তারপর তারা কাছাকাছি গিয়ে অপারেশন করে । তারা যখন ধরা পড়ে, দে’হ্যাড জিরো প্রটেকশন । ও যখন ধরা পড়লো, আমার ভেতর ভেতর জানা ছিলো যে- ওরা ওকে ছাড়বে না, ও আর ফিরে আসবে না ।
ধরা পরার পর যখন ভিতরে গিয়ে দেখলাম- জুয়েল ভাই ওখানে, আজাদ ভাই ওখানে, বদি ভাইয়ের কথা শুনেছি ওখানে গিয়ে যে- প্রথমে বদি ভাই ধরা পড়েছে । দিনুদের কাউকে তখন আমি চিনতাম না, একচ্যুয়ালি শিমূলদের সাথে আমার পরিচয় হয় ছাড়া পাবার পরে । আমি কি ভেবেছি যে – আমি ফিরে আসবো !!! কান্ট ইমাজিন্ ! আমার ফ্যামিলি ইজ ইনভল্ভড, আমাকে মারবে নাকি আমার বাবাকে মারবে, হু নোজ…আমার চাচাতো ভাই ধরা পড়েছে, হাফিজ ভাই, ভাইয়ার এক বন্ধু … আমি তো পুরোপুরি ঠিক ঠাক করে আছি যে – শেষ আজকে; মন বলছিলো এখান থেকে বেরোনো যাবে না- যখন দেখলাম জুয়েল ভাইকে কিভাবে পেটানো হয়েছে, হাত ভাঙ্গা, একটা চৌবাচ্চাতে বসিয়ে রাখা হয়েছে একসাথে অনেকজনকে (১৫-২০ জন হবে), মুরগির মতো … মুরগির খাঁচার ভেতর যেমন করে ভরে রাখা হয় । ঐ চৌবাচ্চার এক কোনায় একটা পানির কল ছিলো । আমাদের সবাইকে বসিয়ে রাখা হয়েছে, জুয়েল ভাই আসন পেতে বসে আছে । কিছুক্ষণ পর পর কয়েকজন জোয়ান ঢুকে নির্বিশেষে এলোপাথারি কিছুক্ষণ পিটিয়ে চলে যাচ্ছে ।
-“তুমি কি ওখানে গিয়ে বাবাকে দেখছো ?” (শাওন মাহমুদ)
-“আলতাফ ভাইকে আমি দেখিই নাই । ঐ ঘরে ওনাকে নিয়ে আসা হয় নাই । প্রথমে ভাইয়াও ছিলো না ওখানে । আমাকে যখন ঐখানে ভরলো, তখন দেখলাম জুয়েল ভাই আছে, আজাদ ভাই আছে, আর অন্য অনেকে, কাউকে আমি তখন আসলে চিনি না । আমি তখন জানতাম না আলতাফ ভাই ধরা পড়েছে, ইভেন তখন এটাও জানতাম না, আলতাফ ভাই ওয়াজ ইনভল্ভড” ।
আমাদের যখন প্রথম নিয়ে আসা হয়, তখন আমাকে, আব্বাকে আর মাসুম ভাইকে বড় একটা ঘরে রাখা হয় । ভাইয়া জানি না কোথায়, আলাদা কোথাও নিয়ে গেছে । অনেকক্ষণ পর আমি আর মাসুম ভাই বসে আছি ঐ ঘরে, কয়েকজন জাওয়ান ঢুকলো ঐ ঘরে, চিল্লাচিল্লি আর মারা আরম্ভ করলো । আমি আসন পেতে বসে ছিলাম, (হঠাৎ তীব্র ব্যাথা, ঝিমুছিল্লাম মনে হয়) পেছন থেকে এসে একেবারে লোয়ার ব্যাক, মানে স্পাইনাল কর্ডে বন্দুকের বাট দিয়ে মারলো, ভাগ্যিস আমাকে ঐ একটাই মেরেছিলো । কিন্তু এখনো আমার ঐখানে … সকাল হতেই আমাদের নিয়ে গেল ইন্টারোগেট করার জন্যে ।
ইংরেজী E এর মাঝখানের দাগটা বাদ দিলে যেমন, এমপি হোস্টেলের স্ট্রাকচার ছিলো ঐ রকম । কর্ণেল হিরাজির অফিস যেখানে, আমাকে বললো বাইরে এসে দাড়াও ওখানে । উঠানের ঠিক ঐ পাশে তখন ভাইয়া দাড়িয়ে আছে । ঐ প্রথম দেখলাম ওকে আমি, ওখানে নিয়ে যাওয়ার পর । নাইট ড্রেস পরা ছিলো, আমাদের দুজনেরই পরা ছিলো, নীলচে-সবুজ রংয়ের, কিছু বলার নাই, ও ঐখানে দাড়িয়ে ছিলো, আমি এইদিকে … । তারপর আমাকে হিরাজির ওখানে নিয়ে গেল, জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে ।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এরপর আমাকে নিয়ে গেল চৌবাচ্চার ঐখানটায় । জুয়েল ভাই বসে আছে, একজন জাওয়ান এসে বুট নিয়ে জুয়েল ভাইয়ের পিঠে এমন জোড়ে মারলো যে, উনার মাথাটা মেঝেতে গিয়ে ঝাকি খেয়ে আবার উঠে আসলো, আর সাথে সাথে রক্ত !!! জাওয়ান চলে যাওয়ার পর জুয়েল ভাইকে ধরে পানির কলটার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো । এইভাবেই কাটছিলো, সময়ের কোন হদিস নাই, কে জানে কটা বাঁজছে তখন, সারাদিনই ওখানে ছিলাম । আব্বাকে, মাসুম ভাইকে মাঝে মাঝে কয়েকবারে ডেকে নিলে গেলেও আমাকে একবারই ডেকে নিয়েছিলো (ঐ সকালে) ।
রাতে নয়টা বা কোন একসময় ভাইয়াকে নিয়ে আসলো কয়েকজনের সাথে । কিছু বুঝলাম না । ভাইয়া কাছে এসে বললো – তোমরা কাউকে কিছু বলবা না, তোমরা কিছু জানো না, আমি বাজে ধরণের বখাটে ছেলে, নিজের মতো চলে গেছি, আমি এভাবেই বলতেছি ওদেরকে, তোমরা ঘুনাক্ষরেও কোন কিছু এ্যাডমিট করবে না । ও বলছিলো ঠিকই, কিন্তু আমি জানি না – ও আর্মীর সাথে কোন ধরণের Pact করেছিলো কিনা… যে আমার ফ্যামিলীকে তোমরা ছেড়ে দাও, এই ধরণের কিছু ।
অপারেশন সম্পর্কে ওরা জেনে গিয়েছিলো । ওরা (পাকিরা) একদম পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলো, কারণ অনেক ক্যাজুয়াল্টি ছিলো । অপারেশনের পর ভাইয়া বাড়িতে ফিরে আসার পর আব্বা বলেছিলো- তোমরা কেউ বাসায় থেকো না ।
বদি ভাইও যায় নাই, ঢাকাতেই ছিলো, ফরিদের (ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের ছেলে) বাসায় যেতো প্রত্যেকদিন, ঐ বাসা থেকেই ধরিয়ে দিলো … একবার যেহেতু এ্যাডমিট করে ফেলছে, পাকিস্তানী আর্মিরা আর ছাড়ার কথা না.., ছাড়েওনি, কনসিকোয়েন্স অব ওয়ার । অপারেশনের চারদিন পরেই ধরা পড়েছে তো, তখন ইন্টেলিজেন্স ওয়াজ ভেরি স্ট্রং, ওরা সব জেনে গিয়েছিলো । মেইন যারা পার্টিসিপেন্ট ছিলো, কাজী ভাই আর আলম ভাই ছাড়া সবাই তো ধরা পড়েছিলো, আর কাজী ভাই যে কিভাবে পালিয়েছিলো, গড !!! .. সেই ঘটনাতো তোরা জানিসই …
ভাইয়ারও তো চলে যাওয়ার কথা ছিলো । ও চলেও গিয়েছিলো… সব আর্মসগুলো ২৯ তারিখে আমাদের বাসায় ঢুকানো হলো, আম্মা তো সেই রাতে গাড়ি চালিয়েছে, আমাদের গ্রাউন্ডফ্লোরের ট্যাঙ্ক ছিলো, সেটা খালি করা হলো, খালি করে দুটা টুল নেয়া হলো ভেতরে, আর্মসগুলো ছালা আর প্লাস্টিক দিয়ে বেঁধে টুলের উপর রাখা হলো, তারপর আবার পানি দেয়া হলো, ভেতরে কোণায় এমনভাবে টুল রাখা ছিলো যে- শুধু উঁকি দিয়ে দেখার উপায় ছিলো না, কেউ যদি নামে, তাহলেই দেখতে পারবে । একরাতের ব্যাপার ছিলো, পরের দিন সরিয়ে ফেলা হবে …
২৮ তারিখে ও যখন বাসায় ফিরে আসলো, আব্বা এত রেগে গিয়েছিলো সেদিন … “তুমি ফিরে এসেছো কি করতে ? তোমার তো ঢাকায় থাকার কথা না!” … ২৯ তারিখ হাফিজ ভাইয়া আসলেন বাসায়, ভাইয়া বললো- হাফিজ ভাইয়ের সাথে একরাত থেকে কালকে চলে যাবে, ব্যাড ডিসিশন …
ভাইয়ার কোন খবর ছিলো না, কি যে অসহায় একটা অবস্থা তখন … ভেবে দেখো কোন অবস্থায় পড়লে আম্মার মতো একজন পাগলা পীরের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করেন ! পাগলা পীরের ওখানে সকাল সাতটা থেকে গিয়ে বসে থাকতাম- কোন খবর যদি পাওয়া যায়, মিষ্টি নিয়ে যেতে হতো, শিমূলরা, ঝিনু আপারাও গিয়ে বসে থাকতো । সারাদিন বসিয়ে রাখতো, যেতে না বললে- যাওয়া যেত না । পরে জানলাম- সেই পাগলা পীর ছিলো আর্মির ইনফরমার, যারা ধরা পড়তো, তাদের ফ্যামিলীকে অবজার্ভেশনে রাখার জন্যেই ছিলো ঐ কর্মকান্ড ।
৩০ তারিখ রাতে কোন একসময় এমপি হোস্টেলে দরজা খুলে সবাইকে বাইরে উঠানে নিয়ে বসানো হলো, কিছুক্ষণ পর সবাইকে লাইন করানো হলো, একটা ভ্যান আসলো । যখন লাইন করে ভ্যানে তোলা হচ্ছিলো- তখন আমরা ভাবছি যে- এটাই মনে হয় লাস্ট রাইড, কোথাও নিয়ে লাইন করে ব্রাশ ফায়ার করবে । তানাহলে গভীর রাতে কেন বের করে নিয়ে যাচ্ছে ! সব উঠলাম ভ্যানে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানি না, রাতের অন্ধকারে … ফাইনালি নিয়ে গেল রমনা থানায় । রমনা থানাতেই সেইরাতে আমাদের রাখলো । ওখানে নিয়ে যখন আমাদের ঢুকানো হলো, যারা আগে থেকেই ছিলো সবাই এগিয়ে আসলো – কার কি লাগবে, কার কি অবস্থা, পানি লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে আমাদের সেবাযত্ন করতে লাগলো … ওরাও কিন্তু টর্চাড ছিলো …।
সকাল বেলায় (৩১ শে আগস্ট) একই ভ্যানে করে আবার এমপি হোস্টেলে নিয়ে গেল । ঐদিনই আফটার নুন এ আমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হলো । রমনা থানা থেকে নিয়ে আসার সময়ই ভাইয়াকে শেষ দেখি, তারপর আর দেখি নাই ভাইয়াকে ।
তবে ২৫ তারিখের অপারেশন শেষ করে যখন ওঁরা বাসায় ফিরলো- তখন ওঁদের চেহারা দেখলে- একেক জনের মুখ যেন জ্বলজ্বল করছিলো, এতো Adrenaline ! কথা আর বন্ধ করতে পারছিলো না ওঁরা … সেই দৃশ্যটা খুব মনে পড়ে ।
____
সাইফ ইমাম জামীর সাথে সাক্ষাত করার সুযোগ কখনো আসবে- তা আমার দূর কল্পনাতেও কখনো ছিলো না । ক্লাব অবসকিওরের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলাম বলেই অপ্রত্যাশিত সেই দিনটির সাক্ষ্য হতে পেরেছি । নিঃসন্দেহে আমি ভাগ্যবান এই কারণে যে- সারা আরা মাহমুদ, শিমূল ইউসূফ, সাইদ হাসান টিপু, আর বিশেষ করে শাওন মাহমুদ- তাঁদের স্নেহের মাঝে আমাকে ঠাঁই দিয়েছেন ।
[ব্যস্ততার কারণে খুব অল্প সময়ে লেখাটি শেষ করেছি । সাইফ ইমাম জামীর জবানীতে রুমী সম্পর্কিত যা কিছু লিখলাম, তাতে যদি কোন ভুল-ত্রুটি থাকে, তার পুরো দায় আমার, যদি কোন ভুল থেকে থাকে বা ভাষাগত কারণে কোন বাক্য যদি দৃষ্টিকটু লাগে, তা আমার সীমাবদ্ধতা ভেবে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবার জন্যে বিনীত অনুরোধ রইলো](উইকিপিডিয়াতে রুমীর জন্মসাল লেখা- ১৯৫২, তথ্যটি ভুল । রুমীর জন্ম- ২৯শে মার্চ, ১৯৫১ সাল)
— A Tribute from Club Obscure —
লেখাাটি ফেসবুক থেকে Rashed Rony র শেয়ার করা পোস্ট থেকে নেওয়া