সাইমন জন ড্রিং। যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে সাইমন ঘুরে বেড়িয়েছেন ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার জনপদে, আফ্রিকার জঙ্গলে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনী যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায়; তার প্রতিবেদনেই বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে। ১৯৭১ সালে সাইমন দ্য টেলিগ্রাফের যুদ্ধ প্রতিবেদক হিসেবে কম্বোডিয়ায় সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে টেলিগ্রাফের সম্পাদক তাকে লন্ডন থেকে ফোন করে ঢাকায় চলে আসতে বলেন। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই ঢাকায় পেঁৗছান। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক রাহাত মিনহাজের সঙ্গে
সমকাল :২৫ মার্চ বিকেলে ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল? কী জানতে পারছিলেন আপনারা?
সাইমন ড্রিং :২৫ মার্চ বিকেলেই জানতে পারি_ ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তখন প্রায় ২শ’ সাংবাদিক ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে (এখন রূপসী বাংলা) অবস্থান করছিলেন। তাদের সবার মধ্যেই গুঞ্জন ছিল_ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হবে। ইয়াহিয়া খান হয়তো সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেবেন। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ‘চিপস আর ডাউন’ (খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে)।
সমকাল :সন্ধ্যার দিকে কী ঘটল?
সাইমন ড্রিং :বিকেল থেকেই সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত। আমরা হোটেলের পাশে সৈন্য দেখতে পাই। এক সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাদের একটা বহর বের হতে দেখি। আমাদের হোটেল থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছিল না। হোটেলে প্রচুর পুলিশ ও সেনা ছিল। এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আমরা বের হতে পারব না। আমরা গুলির শব্দ শুনি।
সমকাল :ক্র্যাকডাউন বা মূল আক্রমণ কখন শুরু হলো?
সাইমন ড্রিং :তখন আনুমানিক রাত ১১টা। আমরা গুলির প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পাই। শেলিংয়ের আওয়াজ। এই শব্দ আসছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে। এর কিছুক্ষণ পরই আমরা মর্টারের গর্জন শুনতে পাই রাজারবাগ এলাকা থেকে। ঢাকার সড়কগুলো তখন ফাঁকা। চারদিকে শুধু গুলির শব্দ। পাকিস্তানি সেনারা কোথাও কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। মনে হচ্ছিল, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছিল, পাঞ্জাবি সেনারা এখানে এসেছে বাঙালি জাতিকে এক শিক্ষা দিতে। রক্তাক্ত-ভীতিকর শিক্ষা।
সমকাল : রাতে আপনারা কী করলেন?
সাইমন ড্রিং :আমরা সারারাত হোটেলের ছাদ থেকে ছবি তুলছিলাম। ভিডিওগ্রাফাররা শুটিং করছিলেন। আর যারা কক্ষে ছিলেন তারাও জানালা দিয়ে সবকিছু দেখছিলেন। আমি ওই দিন সন্ধ্যার পরপরই শেখ মুজিবের বাসায় ফোন করি। জানার চেষ্টা করি_ তিনি আসলে কী করতে যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে মুজিবের প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশার কথা হয়। তিনি জানান, শেখ মুজিব তার বাড়িতেই থাকবেন। কোথাও যাবেন না। তার মতো নেতার আত্মগোপনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বাদশা জানান, শেখ মুজিব বলেছেন_ তিনি আত্মগোপনে গেলে পাকিস্তানিরা পুরো ঢাকা শহর জ্বালিয়ে দেবে। তাই তিনি ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। মধ্যরাতে আমি আবার শেখ মুজিবের বাসায় ফোন করি। তখন ফোনটি বিকল (ডেড) ছিল।
সমকাল :পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ আপনারা কী করলেন?
সাইমন ড্রিং :আমরা সবাই হোটেলেই ছিলাম। কেউ বের হতে পারিনি। হোটেলে থেকেই যে যার মতো সংবাদ পাঠানোর চেষ্টা করছিলাম। সকাল ১১টার দিকে আবার গুলি শুরু হলো। মনে হচ্ছিল, পুরান ঢাকার দিক থেকে শব্দ আসছে। খুবই তীব্র গোলাগুলি আর শেলিংয়ের শব্দ। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে। আমরা হোটেলে বসে ছিলাম। অন্যদিকে ঢাকা পুড়ছিল।
সমকাল : ওই হোটেলে সে সময় জুলফিকার আলী ভুট্টোও ছিলেন। তার সঙ্গে কি কোনো কথা হয়েছে?
সাইমন ড্রিং : ২৫ মার্চ রাত ১টার দিকে আমি ভুট্টোর কক্ষে যাই। তিনি সহযোগীদের নিয়ে বসেছিলেন। তার কক্ষটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল। তিনি শোফায় বসে ছিলেন। তার সামনে অ্যাস্ট্রে ছিল, যা সিগারেটের ছাইয়ে ভরা। আমি পরিষ্কার বলতে পারি, তিনি খুবই ভীত ছিলেন। তিনি খুবই বিবর্ণ ছিলেন। প্রচুর সিগারেট খাচ্ছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, তিনি আসলে ঠিক জানেন না_ কী ঘটতে যাচ্ছে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন। পরদিন সকালে আমি তাকে হোটেল লবিতে দেখি। তিনি লিফটে নামছিলেন। তার সঙ্গে পুলিশ ছিল। সেখান থেকে তাকে একটা গাড়িতে তোলা হয়। এর পর সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে করাচিগামী বিমানে তুলে দেওয়া হয়।
সমকাল :ওই দিন পরের দিকে কী ঘটল?
সাইমন ড্রিং :বিকেল ৩-৪টার দিকে মেজর সিদ্দিক সালিক হোটেলে আসেন। তিনি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার। সামরিক সরকারের প্রেস লিয়াজোঁ অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। আমি লবিতে এসে দেখলাম, সব বিদেশি সাংবাদিক জড়ো হয়েছেন। সিদ্দিক সালিকের কথা শুনছেন তারা। আমার এক বন্ধু জানান, আমাদের চলে যেতে বলা হচ্ছে। ব্যাগ গোছাতে বলা হয়েছে। কাল কারফিউ তুলে নেওয়া হবে। তখন আমাদের ঢাকা ত্যাগ করতে হবে। এতে আমি খুবই রাগান্বি্বত হই। ঢাকায় আমার প্রচুর বাঙালি বন্ধু আছে। আমি তাদের খোঁজখবর করতে চেয়েছিলাম। ২৫ মার্চ রাতে তাদের কী পরিণতি ঘটেছে তা নিয়ে আমি শঙ্কিত ছিলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি_ মেজর, কী হচ্ছে? আমাদের কি চলে যেতে হবে? তিনি তখন বললেন_ না না, তোমাদের যেতে হবে না। যাদের ইচ্ছা তারা যাবে। আর যারা থাকতে চায় তারা থাকবে। কিন্তু ধুরন্ধর সিদ্দিক আরও বলেন, এটা একটা গৃহযুদ্ধ। এখানে থাকা এখন খুবই বিপজ্জনক। আমরা তোমাদের নিরাপত্তার কথাই ভাবছি!
সমকাল : আপনি তো হোটেলে থেকে গিয়েছিলেন। আপনি কী করলেন ২৭ মার্চ সকালে?
সাইমন ড্রিং :হোটেলের স্টাফরা আমাদের জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করল। আমি আর মিশেল (এপির ফরাসি ফটোগ্রাফার) সেটায় চেপে ভ্যানে চড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা হলাম। আমি একটা সাদা পাঞ্জাবি পরেছিলাম। মিশেলও পাঞ্জাবি পরেছিল। আমরা রাজারবাগ, ধানমণ্ডি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গেলাম। এর পর পুরান ঢাকা।
সমকাল :আপনারা কী দেখলেন?
সাইমন ড্রিং : বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে আমরা জগন্নাথ হলে যাই। আমি হলের একটি ভবনের একতলায় চলে যাই। সেখানে বেশকিছু মরদেহ দেখতে পাই। সেগুলোর মধ্যে একজন যুবকের মরদেহের প্রতি আমার দৃষ্টি আটকে যায়। সে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। শরীরের নিচ দিয়ে শুকনো রক্তের ধারা। একটা পেইন্টিংয়ের মতো মনে হচ্ছিল। আমি সাতটি মরদেহ গুনেছিলাম। তবে সেখানে যে পরিমাণ শুকনো রক্ত, গুলি আর শেলিংয়ের ক্ষতচিহ্ন ছিল, তাতে এটা নিশ্চিত ছিল_ সেখানে আরও অনেক বেশি মানুষ মারা গেছে। এর পর ওখান থেকে বের হয়ে যাই ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে। আমরা বুঝতে পারি, ওই জায়গা থেকে জগন্নাথ হলে শেলিং করা হয়েছিল। সেখানে একটা কোয়ার্টারে এক শিক্ষক দম্পতিকেও হত্যা করা হয়। সবকিছু দেখে আমার যা মনে হয়েছিল তা হলো, ঠাণ্ডা মাথায় এক ধরনের ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালানো হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মূল কেন্দ্র ছিল। তাই পাকিস্তানি বাহিনীর মূল টার্গেট ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। সেখান থেকে আমরা ইকবাল হল হয়ে (এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) হোটেলের দিকে ফিরছিলাম। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক টহল দল ওই এলাকা অতিক্রম করে। তাদের গাড়ি বহরটি বেশ দূর এগিয়েছিল। তবে সে সময় আমার মনে হয়েছিল, তারা দূরে থাকলেও আমাদের দেখতে পেয়েছিল। তারা থামেনি। কিন্তু তাদের অবস্থান আমাদের ভীত করেছিল। তখন থেকেই আমাদের সমস্যার শুরু হলো। এর পর আমরা কয়েক ঘণ্টায় আরও এলাকা ঘুরে ফিরে
গেলাম হোটেলে।
সমকাল :কী ধরনের সমস্যা হলো?
সাইমন ড্রিং :হোটেলে ফিরেই জানতে পারি, সেনাবাহিনী হোটেলে এসেছিল। তারা পুরো হোটেল তল্লাশি করেছে। আমার ধারণা, ওই দল সেনা কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করে_ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক দল বিদেশিকে দেখা গেছে। তারপরই সিদ্দিক সালিকের নির্দেশে তারা হোটেলে আসে। এর পর আমরা সেখানে থাকা অবস্থাতেই সেনারা তিনবার আসে। আর ওই তিনবারই বাঙালি কর্মচারী আর বিদেশি কিছু বন্ধু আমাদের লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। একবার তারা আমাদের পানশালার একটা টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখেন। ওই টেবিলে বসে জার্মান কিছু লোক পান করছিলেন। পরের বার আমাদের লুকিয়ে রাখা হয় রান্নাঘরে। তৃতীয়বার একটা স্টোর রুমে লুকিয়ে রাখা হয়।
সমকাল :এরপর আপনারা কী করলেন?
সাইমন ড্রিং :তখন আমরা ঢাকা থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছিলাম। আমাদের কাছে প্রচুর স্টোরি আর ছবি ছিল। সেগুলো প্রকাশে আমরা উদগ্রীব ছিলাম। আমরা স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা ছাড়তে চেয়েছিলাম। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা গণহারে ঢাকা থেকে করাচি ফিরছিল। গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাই পশ্চিমারাও ঢাকা ছাড়ছিল। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল তখন বিদেশিতে পরিপূর্ণ ছিল। যাত্রী পরিবহনের জন্য পাকিস্তান এয়ারলাইন্স তখন টিকিটের বিপরীতে নম্বর ইস্যু করত। সেই নম্বরের ভিত্তিতেই যাত্রী পরিবহন করা হতো। আমরা উপায় খুঁজছিলাম কীভাবে বের হবো। আমার আর মিশেলের টিকিট ছিল, কিন্তু নম্বর ছিল না। তখন হোটেলে থাকা দু’জন জার্মান আমাদের দু’জনকে নম্বর দেন, যার মাধ্যমে আমরা পরদিন সকালে ঢাকা ত্যাগ করতে পারব। আমি আর মিশেল পরিকল্পনা করলাম_ কীভাবে ক্যামেরার ফিল্ম ও নোটগুলো অক্ষত রাখা যায়; কীভাবে সেগুলো নিয়ে কাস্টমস পার হওয়া যায়। আমি একবার ব্রিটিশ হাইকমিশনে যাই। কিন্তু তারা আমাকে কোনো সহযোগিতা করেনি। টিপিক্যাল ব্রিটিশদের মতো আচরণ করে দূতাবাস কর্মকর্তা আমাকে রুক্ষভাবে জানান, তারা কোনোভাবেই আমাকে সহযোগিতা করতে পারবেন না। তারাও আমাকে নিয়ে ভীত ছিলেন। তবে জার্মান দূতাবাস আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। তারা ডিপ্লোম্যাটিক ট্যাগ লাগিয়ে আমাদের ফিল্মগুলো পাঠাতে সম্মত হয়েছিল। আমি আর মিশেল আমাদের অর্ধেক ফিল্ম (৯ রোল ছবি) জার্মান দূতাবাসে দিয়ে আসি। জার্মান দূতাবাস আমাদের জানায়, বন-এ পেঁৗছার পর তারা এপি’কে ফোন করবে। তারা এসে ফিল্মগুলো নিয়ে যাবে। কিন্তু সেই ছবিগুলো আমরা আর পাইনি। বন-এর এপি অফিসে কেউ ফোন করেনি। আমরাও ছবিগুলো পাইনি। ওই ছবিগুলোতে গণহত্যার দালিলিক প্রমাণ ছিল, যা চিরতরে হারিয়ে যায়। যাই হোক_ জার্মান দূতাবাস থেকে ফিরে আমরা ঢাকা বিমানবন্দরে চলে যাই। এরপর বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরি ২৫ মার্চ ঢাকায় যা ঘটেছিল। তবে সেই ভয়ঙ্কর গণহত্যা অভিযানের আংশিকই আমরা তুলে ধরতে পারি। পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে এর মধ্য দিয়েই কিন্তু শুরু হয়েছিল একটি স্বাধীন দেশের যাত্রা, নাম যার বাংলাদেশ।
সূত্রঃ সমকাল, ১৮ মার্চ ২০১৫