পরবাস জীবনের শুরুতেই আমরা যে যেভাবেই জীবন শুরু করি, কারো না কারো অল্প বা বেশী রকমের সাহায্য সহযোগিতা নিয়েই করি। থাকার জায়গা খোঁজা, গাড়ী কেনা, কখনোবা জব খোঁজা থেকে শুরু করে যেটা সবচেয়ে জরুরী এই প্রবাসে টিকতে হলে ‘’সামাজিক মেলামেশা’’ সেটাতেও পাই বাড়িয়ে দেয়া হাত!
আজ আমি বা আপনি যা পাই, কাল হয়তো নুতন আসা কাউকে ততোটা বা নিজের সকল সাধ্যমতই অন্য কাউকেও দেয়ার চেষ্টা করি। এই আমাদের প্রবাস জীবনের এক বিনে সুতার বন্ধন বয়ে নিয়ে যাচ্ছি পরম্পরা!
প্রবাস জীবনের শুরুর দিকে যখন তখন খারাপ লাগেনা এমন মানুষ খুব কম আছেন বোধ হয়। কারো মাস ৩/৪ কারো বা বছরও লেগে যায় জীবনধারায় পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে। তবে এই অভ্যস্ত হতে খুব বেশীই কাজে লাগে কাছের কোন বন্ধু বা পরিবারের সাথে মেশা। যেটাকে আমরা বিদেশী ভাষায় হ্যাং আউট বলি!
দেখা যায় এখানে জীবন যাপনের শুরুতেই যাঁদের সাথে মেশা হয় তাঁদেরই অন্য বন্ধু বা নিজের পরিবারের কারো না কারো দিক থেকে কোন কানেকশন থেকে এবং আমাদের কেউ কেউ সৌভাগ্যক্রমে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কোন বন্ধু পেয়ে যাই। এরপর শুরু হয় সবার সাথে সামাজিক মেলামেশা উৎসব আনন্দ উদযাপন।
কিন্তু সবমিলে দেখা যায়, আমরা আমাদের সকল রকম আত্মিক সম্পর্ক সবার সাথে ওভাবে অনুভব করিনা। মোটকথা সবার সাথে সবার সবকিছু মেলেনা বা আশাও করা যায়না। এর মাঝেই প্রতিটা মানুষ বন্ধু বেঁছে নেয় বন্ধু পরিবারের সাথে উঠা বসা করে তাঁদের মেলানো সময় অসময়ে।
আপনি আমি না চাইলেও অনেকরকম সামাজিকতায় জড়াতে হয়ে। বিশেষ করে জন্মদিন পার্টি বা অন্য যে কোন উদযাপনে প্রায় সবাই খুব কাছের সার্কেল ছাড়াও অল্প পরিচিত অনেককেই দাওয়াত দেন এবং আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব সময় না হলেই যাই সেখানে।
কিছু মিশ্র অভিজ্ঞতা শেয়ার করি আজ। একবার এক দাওয়াতে গেছি, মহিলারা সব একটা আলাদা ঘরে বসেছে। ওই আলাপের মাঝেই আলাপ উঠেছে কে সুন্দর এ শহরে, কেন সুন্দর… পরিচিত এক মেয়ের কথা বেশ কয়েকজন বলছে, তিনি সুন্দর। কিন্তু বিষয়টা বারবারই নাকচ হয়ে যাচ্ছে, ‘তার উচ্চতা বিষয়ক জটিলতায়’। কয়েকজন বলছে, আরে আপা যে কী বলেন, ঐ মেয়েটা তো খুব শর্ট সে আবার সুন্দর হইলো কেম্নে (আসলেই তো, কেম্নে কি, সুন্দর মানে তো উঁচা লম্বা সাদা হইতে হইবে, তাইনা)!!!
না কেউ যদি বলেন অমন কোন আড্ডায় আমার ভুমিকা কী ছিলো, আমার ভুমিকা হচ্ছে একটা বোকা বোকা হাসি নিয়ে দেখা এবং শুনা। স্রষ্টার অসীম দয়া আমাকে তেমন একটা হাসি দান করেছেন বলে রক্ষা এবং এমন কোন সময়ে আমাকে আবার ওয়াশরুমেও যেতে হয় খুব দ্রুত। কেউ যদি মনে করেন এমন আলাপে আমার এলার্জি আছে, আমি ‘সুন্দরের তাত্বিক সংজ্ঞা আলোচনায় উদ্বুদ্ধ’ আসলে তা না। নিজের টেনেমেনে ৫ ফুট উচ্চতাটা তখন বড্ড সামনে এসে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় ‘’এই মেয়ে তুমি গুটিয়ে থাকো’’!!!
না বিষয় হচ্ছে, ক্লোজ সার্কেল বন্ধুদের মাঝে কথা বলার বিষয়ে আমাদের কোন বাধা নেই। বলি আমরা। তবে সামাজিক কোন আড্ডায়, ধরুন কোন দম্পতি বিয়ের অনেক বছর পরও কেন বেবী নিচ্ছেনা এই নিয়ে আলোচনা হতেই পারেনা। এমন হতেই পারে সেই আড্ডায়ই এমন কেউ আছেন এই বিষয় নিয়েই খুব গভীর কোন ক্ষত নিয়েই আছেন আপনার কোন এক বাক্যবাণে সে খুব কষ্ট পাচ্ছেন আপনার অজান্তেই।
একবার বাংলাদেশ থেকে এক মা বাবা বেড়াতে এসেছেন। মেয়ের বাড়ি। সেই মেয়ে এবং জামাইয়ের বন্ধুদের দাওয়াতে যেয়ে বাবা চান্স পেলেই বন্ধুদের জিজ্ঞেস করছিলেন, উনার মেয়ের জামাই কী কাজ করেন তারা তা জানেন কিনা। সে এক কান্ড বটে ! না এমন নির্দোষ বিষয় নিয়ে আসলে কিছু বলার নেই!!!
কোন এক আড্ডায় কথা হচ্ছে শহরের একজন ভদ্রমহিলা একটা মিউজিয়ামে ভলান্টিয়ারের কাজ করেন, গাইডের মত। বাংলাদেশী মেয়ে। অন্য কোন এক বাংলাদেশী মহিলা দেখেছে অস্ট্রেলিয়ান কোন এক প্রবীণকে কাজের ওখানে হাগ দিতে… বলাই বাহুল্য সেই আলাপ ছড়াতে ছড়াতে এক আড্ডায় আলাপ হচ্ছে আরে জব তো কত জনই করে। কতকিছু করে। আমরা কী আর সব জানি নাকি, এক বাংলাদেশী আপা জানেন নাকি, উনি নাকি সবাইকে হাগ দিয়ে বেড়ান। মজার ব্যাপার হচ্ছে যেখানে আলাপটা হচ্ছে যাকে নিয়ে হচ্ছে সে তখন সেখানে উপস্থিত। কেউ তাকে চেনেনা। যার কথা বলছি, সে আমার খুব প্রিয় এবং কাছের কেউ, সেই আমাকে বলছিলো তার জীবনের এমন মজার ঘটনার বিষয়টা। তাঁর যেমন পার্সোনালিটি দারুণ করে সেখানে আন্সার দিয়ে এসেছে। তবে আমরা যারা কিছু শুনেই এমন বলি, তাদের মনোজগত নিয়ে ভাবনাটা কিন্তু একটু জটিল, কেন বলেন এমন, শুধু ধারণাকেই প্রকাশ করতে গিয়ে অন্যকে ছোট করতে যেয়ে নিজেই ছোট হয়ে যাওয়া নয় কি?
আরেক সমস্যা নিয়ে বলে শেষ করি আজ, কেউ কেউ আছেন বিশেষ করে রাজনৈতিক বিশ্বাস খুব বেশীই প্রখর এবং তা ধারণ করেন সব সময় সব অবস্থাতে। এক বাসায় অনেক লোকের দাওয়াতে রাজনৈতিক আলাপ উঠেছে। যে পক্ষ মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কোন আজেবাজে কথা মেনে নেয়না, একটু মাথা গরম। আবার এক পক্ষ খুব অবলীলায় রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেই মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ পাকিস্থান এইসব নিয়ে যেমন ভাবেন তাই বলছেন এবং বলছেন খুব ঠান্ডা মাথায় ইনিয়ে বিনিয়ে। অন্যদিকে মাথা গরম মানুষ যিনি আছেন সে পারলে সেই মানুষের গায়ে হাত তুলেন… এখন যার বাসায় এমন ঘটনার ঘনঘটা, হোস্ট হিসেবে তার আসলে কী করা উচিত, ভাবেন একবার।
না এটা অনেকদিন আগের কথা বলছি, তখন শাহ্বাগ আন্দোলন পুরো দেশকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মাঝে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু ভাবনা একেবারেই নুতন এক মাত্রা পেয়েছে… তখন সে আগুনে ছড়িয়ে গেছে সবখানে। এরপর থেকে আমাদের অজান্তেই অনেকের সার্কেল ছোট হয়েছে কারো হয়েছে অনেক বড়, অপ্রত্যাশিত।
কী বলতে চাইলাম আসলে আজ, বলতে চাইলাম, আড্ডায় থাকলে অনেক সময় চেপে যেতে হবে বা উপভোগ করতে হবে। তা যদি না পারেন, আমার মত একটা হাসির প্র্যাকটিস করে নিতে পারেন, যার মানে হবে, ‘আপনি কিছু বিষয়ে একমত বা সহমত না’ তবে সব বিষয়ে আপনি জ্ঞানীও না। তারচেয়েও বড় কথা সব জায়গায় জ্ঞান ফলানোরও মানে নেই… সময় নষ্ট বা কোথাও কোথাও অশোভন।
ভালোবাসি জীবন!!!
জীবন হোক সুন্দর, সুন্দর খাই, সুন্দর দেখি, সুন্দর ভাবি, ভাবার করি প্র্যাকটিস, কী বলেন!!!
আরও পড়তে পারেন :
পরবাসী জীবন, কিছু একান্ত অনুভব!!!