বিদেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা বলতে ইন্ডিয়াতে এক মাসের শিক্ষাসফর । ফরম ফিল আপের ঝামেলা
ছিল না তখন। এখানে সেই ঝামেলাটা এমন ছিল যে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচির অবস্থা । জীবনজীবিকার জন্য মনবসুর দেয়া স্কলারশিপ ব্যাংকে জমা হবে । ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবশ্যই দরকার । একাউন্ট খোলার পুর্বশর্ত এলিয়েন কার্ড । সেটা আবার দিবে সিটি অফিস । এলিয়েন এর সিনেমা দেখে ভয় পেয়েছি প্রচুর, এখন আমাদেরকে জাপানীজরা সেই গোত্রে ফেলেছে । ভাগ্য ভাল এখানকার সার্ভিসগুলো অতুলনীয় । টেকনিক্যাল কারনে সময় লেগেছে যেটুকু তার চেয়ে এক মিনিটও বেশী নেয়নি । ভাষার প্রতিবন্ধকতা দুর করতে ইন্টারপ্রেটারও যোগাড় করেছে দরকার হলে । সার্ভিসগুলো শুধু বিদেশীরা পাচ্ছে তা নয় । সিটির অধিবাসী সবার ক্ষেত্রেই সমান ।
মনবসু স্কলারশিপটা আসলে পিএইচডি প্রোগ্রাম। তবে কারো মাস্টার্স করা না থাকলে তাকে মাস্টার্স থেকে শুরু করতে হয় । তারপর সেটা অটোমেটিক্যালি পিএইচডিতে কনভার্ট হয়। অনেকে মাস্টার্স করে এসেও আবার মাস্টার্স করে, ডাবল মাস্টার্স আর কি! এই কমপ্লিকেশন দুর করতে ইদানিং বেশ কঠোর হয়েছে অটো পিএইচডিতে ঢোকা । ভাগ্য খারাপ হলে গাইটের পয়সায় করতে হয় পিএইচডি ।
ফ্যাকাল্টি কিংবা ইউনিভার্সিটি ভেদে মনবসুর সময়কালটা ভেরী করে । ইন্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি গুলোর সাড়ে তিন বছর, মেডিকেল ফ্যাকাল্টিগুলোর সাড়ে চার বছর লাগে । প্রথম ৬ মাসের সময়টা আসলে জাপানীজ কালচার শেখার সময় । সেটাও অবশ্য প্রফেসরের মতিগতি ও স্কলারশিপ হোল্ডারের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে । প্রফেসর একদিন রুমে ঢুকে মোটা একটা কানজির ( চাইনিজ ক্যারেকটারের ) বই হাতে দিয়ে বললেন ইচ্ছে থাকলে শিখতে পার । মনে মনে ভাবলাম প্রথম ছয়মাস রিসার্চ কম করলেও হবে ।
জাপানে ইউনিভার্সিটিরগুলোর বৈশিষ্ট্য হল ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার নামে একটা সেকশন থাকে । বিদেশীরা সেখানে যেয়ে আড্ডা দিতে পারে। জাপানী ক্লাসেরও ব্যবস্থা থাকে । সকালের দিকে রিসার্চ করে বিকেলে চলত জাপানী শেখার তোড়জোড় । অ আ ক খ এর মত আমরা হয়ে গেলাম আ ই উ এ শেখার ছাত্র । ঠাকুর মার ঝুলি শোনার মত আমরাও জাপানীদের মুকাশি বানাসী (পুরান দিনের গল্প) শুনতে লাগলাম সেনসেই ( শিক্ষকের ) এর মুখে । ইচ্ছুনবোওশির মত পিচ্চির এ্যাডভেনচার । নায়কের নাকি নৌকা ছিল ছোট্ট গামলা, তরবারি ছিল সুচ । উচ্চতা কত ছিল সেই নায়কের? লিলিপুটদের চেয়েও পিচ্চি ছিল কি? ঢাল তলোয়ারের আকৃতি দেখে বুঝেছিলাম কতই না বড় ছিল সেই বীর । তাই জিজ্ঞেস করি নাই । পরে জেনেছিলাম ইচ্ছুন নাকি জাপানী পর্বপুরুষদের দৈর্ঘ্যের একক ।
বাশের ভিতর থেকে জন্ম নেয়া রাজকন্যা কাগুইয়াহিমের কাহিনীও শোনাতেন কতেকদিন । কার্টুন নাকি হয়েছে কাগুইয়াহিমেকে নিয়ে । বাংলাদেশের মানুষ হয়ত দেখবে বাশ থেকে জন্ম নেয়া রাজকন্যার কাহিনী । ছোটবেলায় ঠাকুরমারঝুলি কেউ পড়ে শুনিয়েছিল কিনা বলতে পারব না, বুড়া বয়সে জাপানীজ ঠাকুরমারঝুলি শুনে অন্য দেশের অনেককেই ঘুমাতেও দেখেছি ।
সকালে গবেষণার কাজ মানে আয়নের দৌড়াদৌড়ির সিমুলেশন আর বিকালে বাচ্চাদের মত কখগঘ পড়ি । পড়া শেষে সাইকেলে ফিরতে ফিরতে সুর্যের আলোকে ব্যবহার করে সাইকেলকে পথ দেখানো সম্ভব হত না । সাইকেলের লাইটকে সঙ্গী বানিয়ে নীড়ে ফিরা । পাখিরা নীড়ে ফিরে কলকাকলীতে মাতিয়ে তুলে ওদের বাসাগুলো । আর আমার নীড়ে অপেক্ষা করত বাল্বগুলো ।
প্রথম কিছুদিন ছোট আপার বাসায় ক্ষুধা নিবারন করলেও আস্তে আস্তে নিজেই চুলোয় আগুন দিলাম । হল লাইফের খিচুড়ি ও ডিম ভাজার অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে ঝাপ দিলাম মাঝ দড়িয়ায় । কোনদিন মুখে দেয়া গেলেও বেশীর ভাগ সময়ই খাবারগুলোর জায়গা হতো ময়লার বাক্সে।
বাজার করতে যেয়ে প্রথম প্রথম জিনিসপত্রের দাম শুনে পেটের ক্ষুধাও ভয় পেত । হলান্ডের এক মুলার দাম বাংলাদেশী টাকায় দুশত টাকা। তাও সেটা আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে, তখন বাংলাদেশে মুলা সের দরে বিক্রি হত ।আঙ্গুলের সাইজের পাঁচটা ঢেড়সের একটা প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকত ২০০ ইয়েন। প্রিয় লাল শাককে তন্ন তন্ন করে খুজেও পাওয়া যায়নি। আসলে লাল শাকের উৎপাদন এখানে হয় না। জিনিসপত্রের দামের চেয়েও বেশি ভাবাত ভাষাটা। সবকিছুই জাপানিতে লেখা। দরকারি জিনিসটা চোখের সামনে থাকলেও খুজে পেতে সমস্যা হত। এমন ঘটনাও শুনেছি যে কেউ একজন, সরিষার তেল ভেবে উলন টি (জাপানি চা) কিনেছে। কেননা দুটোর কালারই একই রকম। পরে সেটা দিয়ে ডিম ভাজার চেষ্টা করে বার্থ হয়েছে! মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করা মেজ ভাইকে কথায় কথায় বলেছিলাম দ্রব্যসামগ্রীর আকাশ ছোঁয়া দামের কথা । বিদেশে থাকার অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক ভাই সেদিন বলেছিলেন, ঐ সব চিন্তা করলে না খেয়ে মারা যাবি।
কিছু কিছু দোকানে ১০০০ টাকার সদাই কিনলে ২০০ টাকার ডিম এক টাকায় পাওয়া যেত । দোকানের অবস্থান ও দিনক্ষনের তথ্য পাওয়া যেত শুক্রবার রাতের বাঙ্গালীদের মিটিংয়ে । মিটিংয়ে পলিটিক্সের টপিকস স্থান পেলেও এক সময় বাজার সংক্রান্ত তথ্যও আদান প্রদান হত । মুখিয়ে থাকতাম সেই দিনটির জন্য । দুধ আর হান্ড্রেড পারসেন্ট জুস দিয়ে পুরন করতাম এক হাজার টাকার কোটা । এক প্যাকেট ডিম এক ইয়েনে কিনে রাজ্য জয়ের আনন্দে ফুরফরা মেজাজে, গান গেয়ে গেয়ে ফিরতাম বাসায় । কিছুদিন পরে দেখি শরীরের ওজন দশ কেজি বেড়েছে । ব্যাপার কি? খাচ্ছি তো শুধু দুধ আর জুস? পরে জেনেছিলাম হান্ড্রেড পারসেন্ট জুসগুলো চিনি দিয়ে ভরা । জানার পর থেকেই বাই বাই দিয়েছিলাম জুসকে । জুসের ভ্যারাইটিজ দেখে লোভ সামলাতে পারি না এখনো । ডান হাত জুসের প্যাকেট তুলতে গেলে বাম হাত ভুড়ির চর্বি চেক করে । ফলাফলে বাম হাতের পরীক্ষাই জয়ী হয় । জুসের প্যাকেটটি নিজের জায়গায় মুখ গোমড়া করে পড়ে থাকে ।
বিশ্ববিদ্যালয় ও বাসায় আসা যাওয়ার একঘেয়েমির অবসান ঘটত শুক্রবার রাতে । হামলা হত কোন বাঙ্গালী ভাইয়ের বাসায়, তবে বেশীর ভাগই ছোট আপার বাসায় । প্লান চলতো শনিবার ও রবিবারের সিডিউল নিয়ে । পার্টি আছে কোথায়? প্রোগাম হবে কোন সেন্টারে, কুকিং ফেস্টিভেলে কোন বাংলাদেশী হাড়ি পাতিল সাজানোর দায়িত্ব পেয়েছেন? এরকম হাজারো তথ্য ইনপুট করতাম আগামি দুদিনের সিডিউলে । মিটিংয়ের সমাপ্তি ঘটতো বাংলাদেশের বড় দুই দুলের সাপোর্টারদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে ।
দিন শেষে বিছানায় শরীর হেলিয়ে দিয়ে চোখ পরত মাথার উপরের বাল্বগুলোতে । নিঃশব্দের কথোপকথন হত ওদের সাথে । দুজনেই নিঃসঙ্গ । একজন বিদ্যুৎ কোম্পানির উপর নির্ভরশীল অন্যজন জাপান সরকারের বৃত্তির উপর । একজনের জন্মস্থান জাপানে হলেও গ্রামের নাম জানে না । অন্যজনের জন্মভুমি, জন্মস্থান চোখের সামনে ভাসছে কিন্তু ইচ্ছে করলেও যেতে পারবে না । চোখের কোনে জমে যাওয়া পানিটা ঘুম পাড়ানি ড্রপের দায়িত্ব নিত । পাশের বাসার গাড়ীখানা স্টার্ট দিয়ে জানিয়ে দিত দিন শুরু হয়েছে …