ড. এজাজ মামুন:একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে ও বাস্তবতার নিরিখে এতটুকু বুঝি যে রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে একদিকে যেমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে, অপরদিকে যোগ্য নেতা নির্বাচনে ব্যর্থ হলে গণতন্ত্র কখনই অর্থবহ হয় না। এটা যে উন্নত অনুন্নত সব দেশের জন্যই সত্য তা বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালেই সহজে অনুধাবন করা যায়। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ অনেকটা ভাগ্যবান। তারা এমন এক নেতা নির্বাচন করেছেন যার মেধা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, অক্লান্ত পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা এক দশকে দেশকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেই জননন্দিত নেতা যিনি তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রক্তের উত্তরসূরি শুধু নন, তাঁর আদর্শের যথার্থ অনুসারীও বটে। গত এক দশকে শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন তা তাকে একটি রাজনৈতিক দলের নেতার অবস্থান থেকে দেশের মানুষের আশা-ভরসার কাণ্ডারি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সামপ্রতিক সময়ে, বিশেষত গত এক দশকে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নীতি আর কৌশল অর্থনীতিতে অসাধারণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে যা খুব সহজেই পরিমাপ করা যায়। শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে গত দশকে বাংলাদেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশের মতো। গত অর্থ বছরে (২০১৭-১৮) জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৭.৮৬ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতিও ছিল নিয়ন্ত্রণে। কমে এসেছে দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্যের হার। ২০০৯ সালে যেখানে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩২.৫ শতাংশ তা কমে ২০১৮ সালে হয়েছে ২১.৮ শতাংশ। হতদরিদ্রের হারও এক দশকে প্রায় পাঁচ শতাংশ কমে এসেছে। এক দশকে জনপ্রতি আয় ৭৫৯ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৫২ মার্কিন ডলারে।
এবছর জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসবই ছিল শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি দিয়ে গড়া ভিশন ২০২১-এর অর্জন। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ১৯ শতাংশেরও বেশি মানুষ মধ্য ও উচ্চবিত্তের কাতারে পৌঁছাবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশকে বিশ্বের ৪৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিবেচনা করছে। আর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ছিল প্রথম দশটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের একটি।
বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে দেশের অর্থনৈতিক যে ভিত রচিত হয়েছে তাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরিত করবার এক মহাসংকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে ভিশন ২০৪১ নামে। চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে এই মহাসংকল্প পূরণ করা যে সম্ভব তাও অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৃত্তিমূলক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউস কুপারসের বিশ্লেষণ বলছে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালে বিশ্বের ২৮তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্থান করে নেবে আর ২০৫০ সালে উন্নীত হবে ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে। বাংলাদেশের এই উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো এদেশের শ্রমজীবী মানুষ। তারাই আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সত্যটি পুরোপুরি বিশ্বাস করেন। সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েই তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। একইভাবে স্বল্পতম সময়ে বাংলাদেশের যে অর্জন ও যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তাকে ধরে রাখতে হলে ক্ষমতাসীন দলটিরও উল্লেখযোগ্য গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা দরকার।
মাঠ পর্যায়ের কিছু উপাত্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রাচীন এই সংগঠনটির ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কর্ম-প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দিচ্ছে জনবিচ্ছিন্ন ভুঁইফোড় কিছু উঠতি ও নীতিহীন নেতা-কর্মী। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অতিভক্ত আমলা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংগঠন ও সরকারি কর্মচারীরা এই সরকারের অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশ আধুনিকতার দিকে এগুচ্ছে, সেখানে অজানা কারণেই আমলাতন্ত্র ঔপনিবেশিক পথে এগুচ্ছে। রাষ্ট্রের এক শ্রেণির কর্মচারী জনসেবক থেকে জনপ্রশাসক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সর্বক্ষণ সচেষ্ট রয়েছে।
জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা একটি স্বচ্ছ, সচ্ছল ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় যন্ত্র তৈরির জন্য বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনো গতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেননি। আর অনেক ক্ষেত্রে এই সংকটগুলোকেই সরকারের রাজনৈতিক সংকট বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সারা বিশ্বের মতো উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মানুষ ব্যাংকগুলোকে আমানত রাখার ও দেশের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের সহায়ক ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বেশ কয়টি ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা ও ঋণ কেলেঙ্কারির বিপরীতে দৃশ্যমান বিচার বা প্রতিকারের ব্যবস্থার অভাব একটি গতিশীল সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোকে ম্লান করে ফেলছে। দেশের সাধারণ মানুষ মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশের স্বপ্নগুলোকে এগিয়ে নিতে হলে শেখ হাসিনার মেধা, দূরদৃষ্টি, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও অপরিসীম পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও প্রত্যাশা করেন, বাংলাদেশের স্বপ্নগুলোর ফলপ্রসূ অর্জন যেন কোনোভাবেই সুবিধাবাদী, দুর্নীতিগ্রস্ত, নীতিহীন, অবিবেচক ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা সংগঠনের কাছে জিম্মি না হয়ে যায়। আর এ জন্যেই আগামী নির্বাচনটি যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ জাতির জনকের কন্যার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতত্বের ধারাবাহিকতা।