কাউসার খান:বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ১৯৯৮ সালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার সংবিধান স্বীকৃত বলে ঘোষণা দেন। তবে দীর্ঘ ২০ বছরেও সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। বিশ্বের ১৫৭টি দেশে এক কোটির ওপর প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন অথচ এই প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করেনি কোন সরকার। একজন বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বের যেকোনো দেশেই বসবাস করুক না কেন, বাংলাদেশের যেকোনো নির্বাচনে তাঁর ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে।তবে বাস্তবে এ দৃশ্যের কোন দেখা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশির বাস।
অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ এবং মধ্যপাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রায় এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক অবস্থান করছেন।তবে বাংলাদেশের এই কোটি সংখ্যক নাগরিকের অনেকের ভোটার তালিকায় যেমন নাম নেই, তেমনই বাংলাদেশি হিসেবে জাতীয় পরিচয় পত্রও নেই অনেক প্রবাসীর।
দৃশ্যপটের ব্যতিক্রম নেই বিশ্বের অন্যতম দেশ অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও।দেশটির প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট দেওয়ার সদিচ্ছা বহু বছরের। বাংলাদেশ থেকে নেতৃস্থানীয় কেউ অস্ট্রেলিয়ায় সফরে এলেই প্রবাসীরা বারবার তাঁদের ভোট প্রদানের সরকারি ব্যবস্থার আর্জি জানিয়েছেন।গত বছর আগস্টে সরকারি সফরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি আসেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি। প্রথম আলোর সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রবাসীদের ভোট গ্রহণের কথা জানানো হয়। প্রথম আলোতে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের একাংশে মন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে প্রবাসী মূল্যবান ভোট ভেস্তে যাচ্ছে। তাই ডিজিটাল পদ্ধতি দেশের সাথে একযোগে ভোট প্রদানের পদ্ধতি চালু করতে সরকার অক্লান্ত শ্রম দিয়ে যাচ্ছে।’ আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগেই সরকার প্রবাসীদের ভোট গ্রহণ সুবিধা চালু করবে বলে আশাবাদী ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী। তবে আশার কোনো খবর এখনও শোনেন নি অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট গ্রহণে বাংলাদেশ সরকার কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা প্রসঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় বাংলাদেশ হাইকমিশন, ক্যানবেরার প্রথম সচিব নাজমা আক্তারের সঙ্গে।জানালেন, অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেক বছর ধরেই ভোট প্রদানের ইচ্ছার কথা হাইকমিশনকে জানিয়ে আসছে।তাঁদের ইচ্ছার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে গত বছর দাপ্তরিক চিঠি পাঠায় হাইকমিশন।নির্বাচন কমিশন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের তালিকা চাইলে ভোটার হতে ইচ্ছুকদের নাম নিবন্ধনের জন্য হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সেই বিজ্ঞপ্তি দেখে যাঁরা নিজেদের তথ্য জমা দিয়েছে তাঁদের একটি তালিকা গত বছর সেপ্টেম্বরে নির্বাচন কমিশনকে পাঠানো হয়। এরপর নির্বাচন কমিশন থেকে পরবর্তি পদক্ষেপের কোনো নির্দেশনা আসেনি।
দেশের নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকজন প্রবাসীর সঙ্গেও কথা হয়। সিডনিতে বসবাসরত বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার্সদের সংগঠনের সভাপতি আব্দুল মতিন বললেন, ‘বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের বহুদিনের আবেদন, প্রবাসীদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু এর দীর্ঘসূত্রিতার জন্য হতাশ হয়ে পড়ছি। তবু আবেদন করবো যতদ্রুত সম্ভব আমাদের ভোটাধিকার দেয়া হোক। এখন ডিজিটাল যুগে এটা এমন কিছু কঠিন কাজ না।’
অস্ট্রেলিয়ার পশিম রাজ্যের পার্থে বসবাসরত বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি হাসনা হেনা বললেন, ‘বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অবশ্যই দেশের নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে চাই। ভোটাধিকার থেকে একজন নাগরিকেকে বঞ্চিত করার কোনো কারণ নেই। প্রবাসী নাগরিকদের ভোট গ্রহণ খুব বেশি ব্যয়বহুলও নয়। ডিজিটাল মাধ্যমে হাইকমিশনের সহায়তায় এই পরিকল্পনা যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিত।’
অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ রাজ্যের অ্যাডিলেড প্রবাসী পিদিম পাঠাগারের প্রধান এনায়েতউল্লাহ বললেন, ‘ভোট দেওয়া আমার রাষ্ট্রীয় অধিকার। প্রবাসী হিসেবেও সংবিধান আমাকে ভোটের অধিকার দেয়।এবার আমি দেশের বাইরে বা যেখানেই থাকি না কেন। বিশ্বের উন্নত দেশের পাশাপাশি ভারতসহ অন্যান্য দেশেও এক্সপ্যাট ভোটিং কিংবা পোস্টাল ভোটিং এর মতো সুবিধা রয়েছে। আমি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমার দেশেও ডিজিটাল কোনো ভোটিং পদ্ধতির চালু হোক। ডিজিটাল দেশ গড়ার বর্তামান সরকার নানা প্রকল্পের আওতায় এই প্রবাসী নাগরিকদের ভোট গ্রহণের পদ্ধতিও চালু করা হোক অতিসত্বর এবং আমাদের ভোট দেয়ার সুযোগ দিক।’
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যে গত বছর কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি মিলে প্রবাসীরা যেন তাঁদের ভোটা দিতে পারে সে নিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছিলেন। মেলবোর্নে বসবাসরত সালাউদ্দিন আহমদ তাঁদের একজন। পরবর্তিতে নানাবিদ রাজনৈতিক মতভেদের দরুন উদ্যোগটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। প্রবাসীদের ভোটের অধিকার নিয়ে সালাউদ্দিন জানালেন, ‘আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভোটের অধিকারের কথা জানিয়ে অনেকবার হাইকমিশনের শরণাপন্ন হয়েছি। এখন সরকার কিভাবে প্রবাসীদের মূল্যবান ভোট সংগ্রহ করবে এটা সরকারের নীতিনির্ধারকদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আমরা প্রবাসীরা যারা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখি, আশা করব শিগগিরিই সরকারও আমাদের অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন।’
এ বছরের শুরু দিকের নির্বাচন কমিশনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন মোট ভোটারের সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখেরও বেশি। বিদেশে বসবারত কোটির বেশি ভোটারের মতামতও সমান গুরুত্ব রাখে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগেই এই বিশাল প্রবাসী ভোটারদের ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত সরকারের। আর এমনটাই দাবী অস্ট্রেলিয়ায় মেধা ও শ্রমে বাংলাদেশকে তুলে ধরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের।