প্রবাসীর বাংলাদেশ ২০১৯  – পর্ব ১

প্রবাসীর বাংলাদেশ ২০১৯  – পর্ব ১

জুলাই ২০০৯ , বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমাই অস্ট্রেলিয়া, পরিবার নিয়ে।

এরপর লম্বা সময় দেশে যাওয়া হয়নি। ২০১১তে একবার খুব জরুরী কাজে, ৪ সপ্তাহ এবং এরপর ২০১৬তে  আরেকবার মাত্র যাওয়া।

২০১৯ এ এসে, বলা যায় এই প্রথম একটু আয়োজন করেই ঘুরে আসলাম বাংলাদেশ। ৭ জানুয়ারী থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারী’১৯, সময়কাল ৫ সপ্তাহ। পুরো এই সময়টা ছিলাম ঢাকা আর আমার শহর ময়মনসিংহ মিলিয়েই। আজ সিডনী বাঙালী পাঠকদের সাথে শেয়ার করি, সদ্য সমাপ্ত এই ট্যুরের কিছু একান্ত অনুভব স্মৃতি।

ডিসেম্বরে স্কুল হলিডে বা নিজের কাজের ছুটি মিলিয়েই আমরা অনেকেই চাই লম্বা কোন ট্যুরে যেতে এবং সেটা বাংলাদেশ হলে তো কথাই নেই। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন, সব মিলে দেশে যেতে পারছেননা অনেক বছর ধরে। অনেকেই আছেন  নিজের কাজ এবং বাচ্চাদের হলিডে অনেক আগে থেকেই ম্যানেজ করে  চেষ্টা করেন নিয়মিতই দেশে যেতে। এবং ডিসেম্বরে টিকেটের দাম চড়া হলেও সেটা যতোটা সম্ভব চেষ্টা করেন আগে ভাগেই করে নিতে। ক্রিসমাস ছুটির অপেক্ষাতেই থাকেন পুরো বছর জুড়ে।

কিন্তু অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনা। আমি প্রায় এক বছর ধরে বাংলাদেশ যাব যাব ভাবলেও নিজের কাজে আগে থেকে বাৎসরিক ছুটির আবেদন ঠিক সময় না করায়, ডিসেম্বর মাসে যাওয়া হলোইনা।

বলেই নেই,  আমাকে বাংলাদেশের যা কিছু খুব খুব টানে, তার মাঝে একটা ভীষণ ভালোলাগা বাংলাদেশের শীতকাল, শীতকালকে ঘিরে যে আবহ, বাংলাদেশের কুয়াশা। একটা ভরা শীতে আবার যাবো, কুয়াশায় ভেজাবো পা খুব ইচ্ছে থাকা সত্বেও হয়েই উঠলোনা।  সব মিলে জানুয়ারী মাসই ঠিক করতে হল  যাওয়ার সময়টা  এবং এতে একটা লাভ হলো বৈকি, বইমেলার অল্প কটা দিনও পেয়ে গেলাম। যদিও আমার পুত্রের স্কুল প্রায় ১০ দিন মিস হয়ে গেল, আমার জন্যেই।

বাংলাদেশ যাওয়ার আগে মানে প্ল্যান করা থেকে একদম উড়ার দিন পর্যন্ত কী ভীষণ এক রোমাঞ্চকর সময় জানা আছে নিশ্চয়ই অনেকের। যারা প্রতি বছর যেতে পারছেন, তাঁদের কথা আলাদা।

গিফট কেনা থেকে শুরু করে, লাগেজ গুছানো… এরপর এয়ার পোর্টেও অনেক সময় ওজন সংক্রান্ত নানান ড্রামা এবং শেষমেশ ১০/১২ ঘন্টা বা তারও বেশী সময়ের একটা ট্রিপ শেষ করে বাংলাদেশের আকাশ ছুঁয়ে ‘’ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’’!

আপনি যখন অস্ট্রেলিয়া থেকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া হয়ে বাংলাদেশ যাবেন এবং সেটা যদি লম্বা  সময় পর হয় স্বাভাবিক ভাবেই দেশের এয়ারপোর্টে নেমে নিজের অজান্তেই একটা কম্পেয়ার চলে আসে চোখে। আমরা কতোটা আছি পিছিয়ে বা অন্যদিকে।

প্লেন থেকে নেমে এয়ারপোর্টে ঢুঁকার পথ ধরেই বিশাল বিজ্ঞাপন এবং বাংলাদেশের সিনিক কিছু বিউটি দেখে মন অন্য রকম করবেই। অনেক বছর পর হলে দেখবেন আবেগ আপ্লুত লাগে নিজেকে। আরো একবার মনেই হবে, আহ নিজের দেশ কী সুন্দর এই দেশ। সামনে আগাতে থাকবেন, উন্নত দেশের চাকচিক্য জৌলুষ কমতে থাকবে চোখ থেকে। বাড়তে থাকবে আপন আপন এক আবহ।  পরিষ্কার পরিছন্নতার ছটা কমে আসবে, মশারা জানাবে অভিবাদন। তবুও বুকের মাঝে দেখবেন, অন্য রকম এক ড্রাম বিট … ”নিজের দেশ, আমার বাংলদেশ!!!

এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশনে যেয়ে দাঁড়াতে হলো, ভীনদেশী লাইনে, অন্যদেশের পাসপোর্ট বহন করছি , তাই নিজ ভূমে পরবাসী।  ছোট বেলায় নানা বাড়ী,  দাদা বাড়ী বা অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে দেখা যেত অনেকক্ষণ এক লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কারো দিকে ঠিকঠাক তাকিয়ে সালাম দেব, সেও যেন লজ্জায় যাই মরে।

অনেকদিন পর বাংলাদেশ নেমেও এমন একটা ভাব, যেন এয়ারপোর্টের সব লোকজন আমায় নিয়ে মেতেই বসে আছে।  স্বামী সন্তানকে এগিয়ে দেই, তাদের ফর্মালিটি আগে সারতে। আমার পালা আসার পর,  খুব আনস্মার্ট না হলেও হঠাৎ আমি যেন কেমন গুলিয়ে ফেলি..  ইমিগ্রেশন অফিসারের সাথে বাংলায় কথা বলবো না ইংরেজী এমন ভাবার আগেই তরুণ অফিসার আমার  নভঃকে দেখিয়ে বলে, হী ইজ ইউর চিলড্রেন ? আমি এমন প্রশ্নে পুরাই ব্ল্যাংক হয়ে যাই, নভ: আমার পুত্র, চিল্ড্রেন… আমিও সেইরকম এক আনসার দেই, শী ইজ (ইয়া মাবুদ একী অকান্ড)!!! অফিসার আমাকে পুত্র এবং তার পিতার লেখা ঠিকানা থেকে আমারটা কেন আলাদা তাই এই প্রশ্নবান। কথা বেশী না বাড়িয়ে ঠিক করে দেই, মানে এক করে দেই  ঠিকানা তাঁর পরামর্শে।

এয়ারপোর্ট থেকে গ্রীন রোড, মধ্যরাতে  আসতে আসতে বুঝতে পারি, এ শহর ঘুমায়না।  জ্যাম, ধুলো  এবং শব্দ এই  ছাড়া ঢাকা… না ভাবাই যায়না…  রাস্তার দু পাশের বদলে যাওয়া আর হরেক রকম বিলবোর্ডের ঝকমারী দেখতে দেখতেই চলে আসি আমাদের ঠিকানায়।

ঢাকায় এসে, আমি মূলত একটা  বেলায়ই ঘুমাই। জেট ল্যাগের কোন সমস্যা আমার এই জার্নিতে হয়না। অসম্ভব শান্ত জনাকীর্ণ মেলবোর্ণের এক উপশহরে থাকি আমি। ভীষণ রকমের নিঃস্তব্ধ, সেখান থেকে ঢাকায় যেখানটায় উঠি, বলা যায় ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। একদিকে ফার্মগেইট, অন্যদিকে কারওয়ান বাজার এবং ধানমন্ডি হসপিটাল ও বসুন্ধরা মার্কেট। সারা রাত ধরে গাড়ী এবং হর্ন চলতেই থাকে। একদম শুরুতেই একটা ধাক্কা লাগলেও আমি চেষ্টা করি কান পেতে এই শব্দ শুনে শুনে অভ্যস্ত হতে।  নিজের ভিতরের সব আবেগকে বলি, নদী এ দেশ তোমার, এই শহরে তোমার জীবনের লম্বা সময় কেটেছে। কত ঋণ আছে তোমার, তুমি এরই অংশ…

প্রবাসী আমরা যারা বাংলাদেশ আয়োজন করে বেড়াতে যাই, তাদেরই জানা আছে, সময়টা আমাদের কী ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের পরিবার

আত্নীয়, পরিজন এবং বন্ধু বান্ধবের জন্যে সময় দেয়া। কারো আবার এর মাঝেই মা বাবা বা নিজের জন্যে চিকিৎসার কোন প্ল্যান থাকলে তার জন্যেও রাখতে হয় সময়।

তাই বাংলাদেশের ডে – টু থেকেই  বসে বসে আরাম করে সময় নষ্ট করার সময় আমাদের অনেকেরই থাকেনা।  আমি সম্পূর্ণ পারিবারিক এবং বন্ধু বৎসল একজন মানুষ, আমার সময়গুলো তাই দামীর থেকেও দামী, আমি তাই মনে করি।

এবার পণ করে গিয়েছিলাম, দেশে গিয়ে আমার ৫টা সপ্তাহ কাজে লাগাবো, খুব।  কাজে মানে কাছের যতজন পারা যায়, তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎটা করেই যাব।  জানি যা চাই সব হয়তো বাস্তবায়ন করা যাবেনা, তারপরও… কাল থেকেই নেমে যাবো মাঠে , প্রিয় প্রিয় মানুষদের কাছে যেয়ে ছুঁয়ে দিয়ে বলে দেবো আরো একবার ”এই যে আমি” তোমাদের হয়ে এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি, ইয়ে মানে মনে মনে বলি আরকি!!!

ঢাকা অনেক বদলে যাওয়া ঢাকা। সেই সব সব বদলে যাওয়া অনেক ইতিবাচকতা শুধু মাত্র  ঢাকার জ্যামের কাছেই হয়ে যায় ম্লান। এই সমস্যা নিয়ে অনেক বেশী কাজ হওয়া উচিত। জ্যামের জন্যে প্রতিদিন ঢাকায় থাকা জনগোষ্ঠীর উপর যে চাপ যায় শারীরিক, আর্থিক, মানসিক,  নিঃসন্দেহে এর অনেক অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ভাবা উচিত অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়ে। কাজ করা উচিত এবং যতটা পারা যায় এই শহরকে মুক্ত করতেই হবে।

বেঁচে থাকলে, আমাদের এই রাজধানী শহর, আমার দেখা এই ২০১৯ এর ঢাকা এবং ময়মনসিংহ থাকা অল্প কিছু অভিজ্ঞতা আর আমার একান্ত  ভাবনা নিয়ে ফিরবো আগামী লেখায়।

যারা সাথে ছিলেন এইসময়টুকু,  ভালোবাসা সবার জন্যে।

জীবন হোক  নিরাপদ, আনন্দময়।  আমরা যে যেখানে আছি প্রিয় মানুষদের নিয়ে বেঁচে থাকা হোক কাঙ্খিত ভালোবাসাময়!!!

ভালোবাসার বাংলাদেশ ভালো থাকুক!!!

 

নাদেরা সুলতানা নদী
কলামিস্ট/সংস্কৃতি কর্মী
উপস্থাপক, বাংলা রেডিও
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা