যাত্রাপথের গল্প

যাত্রাপথের গল্প

সকালে কর্মস্থলে যাবার পথে আমরা ট্রেন চেন্জ করি প্রতিদিন। প্ল্যাটফরম ১১ থেকে পরের ট্রেন ধরতে হয়, মিনিট পাঁচেক সময় আমাদের অপেক্ষাকাল। ওই প্ল্যাটফরম এ একটা পা ভাঙা কবুতর হাটাহাটি করে সবসময়। অন্য গাংচিল আর কবুতর উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, খোঁড়া কবুতর টা আস্তে আস্তে লাফিয়ে আগায়।

বিষয়টা আমার সাড়ে চার বছর বয়সী পুত্রের চোখ এড়ায় না। সে, পাখিটার পা ক্যানো ও কিভাবে ভেঙেছে তা নিয়ে আমাকে অজস্র প্রশ্ন করে। একদিন কোথা থেকে একটুকরো খাবারের দানা এসে পড়লে বাকি পাখিরা উড়ে এসে হামলে পড়ে ওই খাবারে। খোঁড়া কবুতরটা আসার আগেই সব শেষ। ব্যাপারটা অসম্ভব কষ্ট দেয় ওকে।
আমাকে বলে, মা প্লিজ গিভ দ্যা বার্ড সাম ফুড ফ্রম মাইন।

আমি ওর স্যান্ডউইচের পাউরুটির কোনা ভেঙে একটু দেই ওর হাতে, ও তা সোজা দিয়ে আসে পাখিটার একদম কাছে।
পাখিটা খেতে থাকে। আমরা প্ল্যাটফর্ম ছাড়ি।

সেই থেকে আমরা তিন বক্স খাবার ক্যারি করি। এক বক্স আমার, এক বক্স ওর আর একটা ছোট্ট বক্স পাখির জন্য।
কোনো দিন কোনো কারণে যদি তাড়াহুড়া লেগে যায়, আর খাবার দিতে না পারি, পরের ট্রেনে কান্না করতে করতে যায়।

পা ভাঙা কবুতর টা আজকাল আমাদের আসতে দেখলেই ডানা ঝাঁপড়ায়… হয়তো ও টের পায় হাজার মানুষের আনাগোনার ভীড়ে একটা ছোট্ট মানুষের, এক বুক ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে আসা!

গল্পটা কিউট তাইনা? কিন্তু পিছনের বাস্তবতা হচ্ছে, ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ঝড়ের গতিতে নেমে উল্কার গতিতে ১১ নম্বরে পৌঁছাতে হয় । কোনো কারণে মাননীয় পক্ষীকে না খাওয়াতে পারলে পরের ট্রেনে ওনার কান্না সামাল দিতে হয়।

একদিন বেশ বিরক্ত হয়ে কথায় কথায় ঘটনা বললাম আমার ম্যানেজার কে। জানো, আমার ছেলে রোজ এই কান্ড করে।

ষাটোর্ধ ম্যানেজার আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিতে থেকে দৃঢ় গলায় বললো, ফারিনা, ইউ শুড বী ভেরি প্রাউড অফ হিম, হি ইস সো কাইন্ড! আই থিঙ্ক ইউ শুড নট রাশ এন্ড লেট হিম
অফার ব্রেকফাস্ট টু দি বার্ড এভ্রিডে, ইভেন ইফ ইট গেটস ফিউ মিনিটস লেট!

জীবনটা আসলেই অনেক ছোট। সেই ছোট জীবনে আমি হাভাতের মতো ভালোবাসা কুড়াতে থাকি। পাখিপ্রেম আমার পুরনো অভ্যাস। চর্চায় ছেদ পড়েছে যদিও। শৈশবে প্রতিবার ঝড়ের পরে ডানা ভাঙা পাখি কুড়িয়ে এনে ওদের সেবা শুশ্রূষা করে উড়িয়ে দেয়ার অসামান্য স্মৃতি আছে আমার আর আমার বাবার। রীতিমতো ঘরের একটা অংশে আমরা আস্তে যাতায়াত করতাম, পাখি ভয় পাবে বলে। কার্নিশে কার্টন দিয়ে খড় কুটা রেখে দিতেন বাবা, পাখি বাচ্চা দিতো ঐখানে।

রহস্যময় জগৎ তার নিজ নিয়মে জিন থেকে জিনে কেমন করে যেনো অনেক কিছুই পৌঁছে দেয়! আমার ছেলেটার পশু পাখিপ্রেমও হয়তো তাই!

মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে আমি আনমনেই বলে উঠি :

“তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হবার জন্য,
আমি নাহয় পাখি ই হবো,
পাখির মতো বন্য

ফারিনা মাহমুদ
লেখিকা ও কলামিস্ট,মেলবোর্ন , অস্ট্রেলিয়া