অস্ট্রেলিয়ায় মহান একুশ এবং একুশের বৈশ্বিক চেতনার ক্রমোত্থান

অস্ট্রেলিয়ায় মহান একুশ এবং একুশের বৈশ্বিক চেতনার ক্রমোত্থান

 নির্মল পাল : সিডনীর বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা লাকেম্বার পীল পার্কে নির্মিত হতে যাচ্ছে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস  স্মৃতিসৌধ”। বিগত ২৮শে জুলাই ২০১৯ বেলমোড় সিনিয়র সিটিজেন ক্লাবে আয়োজিত এক অনাড়ম্বর সাংবাদিক সম্মেলনে ক্যানটারবারি-ব্যাঙ্কসটাউন কাউন্সিলের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কাউন্সিলরদ্বয়ের পৌরহিত্যে উদ্যোক্তারা আনুষ্ঠানিক ঘোষনার মাধ্যমে প্রশংসনীয় এই গৌরবদীপ্ত তথ্য জনসমক্ষে উপস্থাপন করেন। একুশের চেতনার উত্তরসূরি হিসেবে স্থানীয় বাংগালিদের জন্য এই খবর যেমন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং শিকড়ের সাথে প্রবাসের স্থায়ী সংযুক্তিকরণে অন্যতম একটি স্থাপনার ভিত্তিরচনা, তেমনি আন্যান্য সকল ভাষাভাষীর নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা ও সংরক্ষণের উৎসাহ অনুপ্রেরণার নন্দিত স্থাপত্য স্থাপনা। বাস্তবায়িত হলে সিডনী তথা অস্ট্রেলিয়ায় এটি হবে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ। ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মিশনারি বার্তা স্থানীয় সকল ভাষাভাষীর মধ্যে পৌঁছে দিয়ে নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চায় উৎসাহী করে তোলার লক্ষ্যে স্থানীয় সংগঠন বাংলা হাব ইনক এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব মুনির হোসেনের লিখিত প্রস্তাবটি স্থানীয় বাংলাভাষী কাউন্সিলরদ্বয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ক্যানটারবারি-ব্যাঙ্কসটাউন কাউন্সিলের অনুমোদন লাভ করে। নকশাসহ অনুমোদনপ্রাপ্ত এই স্মৃতিসৌধের নকশা করেন জনাব পার্থ প্রতিম বালা। মাতৃভাষা সকল ভাষাভাষী মানুষের জন্যই অবিচ্ছেদ্দ এবং অত্যন্ত আবেগপ্রবণ একটি বিষয়। সম্ভবত সেই বাস্তবতার নিরিখেই এই মহতি উদ্যোগে বহুজাতিক কমিউনিটির সকলকেই অবহিতকরণ এবং সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির পরিকল্পনায় আয়োজকরা আসছে ১৩ই অক্টোবর’১৯ স্থানীয় রকডেলের একটি ফাংসান সেন্টারে তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ডিনার পার্টির আয়োজন করেছে। সাংবাদিক সম্মেলনে আয়োজকদের দেয়া তথ্যানুযায়ী নির্ধারিত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন ঘোষণার ২০তম উদযাপনের মধ্য দিয়ে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২০(২১/২/২০)উন্মোচিত হবে সিডনীর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ।

 

নভেম্বর ১৭, ১৯৯৯ তারিখে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ পরিষদ সর্বসম্মতভাবে বিশ্বব্যাপী ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণার পর একুশের চেতনাকে বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর একুশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সিডনী প্রবাসী বাঙালিদের নেতৃত্বে বাংলার মহান শহীদ মিনারের নতুন প্রজন্ম তথা আন্তর্জাতিক সংস্করণ হিসেবে সকল ভাষাভাষীর চেতনাদীপ্ত ঐতিহাসিক পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” সিডনীর অ্যাশফিল্ড পার্কে ২০০৬ সনের ১৯শে ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশের চেতনার প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের সুদীর্ঘ পরিক্রমায় এই বৈশ্বিক ঐতিহাসিক জয়যাত্রার পথ এবং পরামর্শ ধরে কানাডার ভ্যানকুভার স্টেটের সারি কাউন্সিলে ২০০৯ সনে তিন শতাধিক ভাষার প্রতিফলনে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের দ্বিতীয় “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”। কানাডার টরেন্টো শহরের প্রসিদ্ধ কনফেডারেশন পার্কে কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত স্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরসহ একুশপ্রেমী বাংগালি অধ্যুষিত বহু শহরেই “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” প্রতিষ্ঠার অপেক্ষমান। অস্ট্রেলিয়া ক্যাপিটাল টেরিটোরি পার্লামেন্টে ১৩/৯/১৭ তারিখে সর্বসম্মতভাবে পাশকৃত মোশনে ক্যানবেরার কেন্দ্রস্থলে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুমোদিত।

শহীদ মিনারের অনুপস্থিতিতে নব্বই দশকের শেষার্ধের দুএক বছর সিডনীতে আবাসগড়া একুশপ্রেমী বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালির(তাঁদের সকলের প্রতি আমার লাল সালাম)নেতৃত্বে শতাধিক বাঙালি সিডনীর কেন্দ্রস্থলের হাইড পার্কে অবস্থিত আর্মি মেমোরিয়ালের পাদদেশে মহান একুশের প্রভাতে জড় হয়ে প্রভাত ফেরী করে ফুল দিয়ে বাংলাভাষা শহীদের প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাতেন। বাংলা ভাষা শহীদদের অশরীরী আত্মাকে শহীদ মিনারের আদলে খুঁজে পেতেন আর্মি মেমোরিয়ালের মাঝে। মাতৃভাষা, মাতৃভূমি স্বদেশকে রেখে  আসার অন্তর্দাহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে তৃপ্ত করতেন শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করার মাধ্যমে। নিজেদের সাধ্য-সমর্থ অনুযায়ী প্রবাসে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির রক্ষার তৌফিক অর্জনের জন্য নীরব শপথ নিয়েছেন। লোক দেখানো, জনপ্রিয়তা অর্জন বা নিজেকে প্রচারণার জন্য নয়, বরং স্বদেশ, মাতৃভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি নীরব নির্মোহে শপথ-সাধনার মাধ্যমে আত্মতৃপ্ত হওয়াই ছিল তাঁদের একুশের চেতনাদীপ্ত প্রয়াস। যে চেতনার টানে সমসাময়িক কালে সিডনীর বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী একুশ প্রেমীদের উদ্যোগে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস  স্মৃতিসৌধ” অথবা “শহীদ মিনার” এর স্থায়ী স্থাপনা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” উদযাপনের নীরব বিপ্লব এগিয়ে চলেছে।

একুশ আমার, আমাদের এবং বর্তমানে বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর অহংকার। মহান একুশের চেতনাদীপ্ত আবেগ অহংকারের সূত্র ধরেই সিডনীর অ্যাশফিল্ড পার্কে ১৯৯৯ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উদযাপনকে ঘিরে ঢাকাস্থ বাংলা একাডেমীর মাসব্যাপী একুশে বইমেলার অনুকরণে সিডনীর একুশে বইমেলার যাত্রা শুরু হয়। অনেকটা একান্ত ব্যাক্তিগত উদ্যোগের সমর্থনে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে শুধুমাত্র মিশুক প্রকাশনার কিছু বই পাটিতে সাজিয়ে আয়োজিত এই বইমেলার স্থানটিই যে বিশ্বের সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে উৎসাহের ঐতিহাসিক ভিত্তি রচনার পবিত্রতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করার মত স্মভাবনা বা পরিবেশ তখনও হয়ে উঠেনি। একই বছরের ১৭-১১-৯৯ তারিখে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বব্যাপী ২১শে ফেব্রিয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত ২০০০ সনে অনুষ্ঠিতব্য একুশে বইমেলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন হিসেবে উদযাপনের পরিকল্পনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করে। একুশে বইমেলা-২০০০ স্টলের সংখ্যা এবং মানুষের উপস্থিতিতে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। গুষ্টিভিত্তিক একুশে বইমেলাকে সকলের একুশে বইমেলা হিসেবে পরিনত করার পবিত্রতর পরিকল্পনায় অক্টোবর-২০০০ “একুশে বইমেলা পরিষদ ইনক” নামে নিবন্ধন লাভ করে। একুশের আবেগ-উচ্ছ্বলতায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০০১ সনে অনুষ্ঠিত একুশে বইমেলায় নির্মিত অস্থায়ী “শহীদ মিনার” মেলার প্রধান আকর্ষণ হিসেবে উপস্থিত বাংলাভাষীদের জাতীয় আবেগ-অনুভুতিকে সিক্ত করে। মাত্র ৭২.৬৫ ডলার ব্যয়ে রিভার্স গারবেজ সামগ্রীতে নির্মিত এই অস্থায়ী আইকনিক “শহীদ মিনার” অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম “শহীদ মিনার”। কয়েক সহস্র মাইলের ব্যবধানে বসবাসকারী বাঙালিদের মধ্যে অস্থায়ী আইকনিক শহীদ মিনারের উপস্থিতিতে মহান একুশ উদযাপন সকল একুশপ্রেমীর মনে  গভীর আবেগ এবং শ্রদ্ধায় ঢাকাস্থ প্রধান শহীদ মিনারে উপস্থিতির নৈসর্গিক অনুভূতির সঞ্চার করে। যে অনুভূতি উদ্দীপনার সঞ্চারণ পরবর্তীতে সিডনী তথা অস্ত্রেলিয়ায় বাংলাভাষীদের মধ্যে “শহীদ মিনার” নির্মাণের মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের সংস্কৃতি সৃষ্টির পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে বিশেষ উজ্জীবনী মাত্রা সংযুক্তকরনে অবদান রেখে চলেছে।

 

(চলবে)

        

লেখক পরিচিতিঃ নির্মল পাল;

ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au

প্রতিষ্ঠাতা, এবং চেয়ারপারশনঃ                   এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক

প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ      পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”

প্রকাশিত গ্রন্থঃ                           “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”

বৈশ্বিক দর্শনঃ                            “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”,(স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)