গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে বিশৃংখলার মূলে বানিজ্যমন্ত্রী

গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে বিশৃংখলার মূলে বানিজ্যমন্ত্রী

ফজলুল বারী:গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে গত দু’দিনে বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটেছে। চলতি করোনা ভাইরাসের মহামারী নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠার পরিস্থিতিতে ভয় জাগানিয়া এসব পরিস্থিতি অবিশ্বাস্য। ঝুঁকি এড়াতে সারা দুনিয়ায় যেখানে মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে, সবাইকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে বাধ্য করা হচ্ছে জরিমানা, সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকরা চাকরি বাঁচাতে বেতনের আশায় গাদাগাদি অবস্থায় চলে এসেছেন ঢাকায়! এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় দু’দিন ধরে নানান আলোচনা সমালোচনা চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে বিজেএমইএ’র সভাপতি রুবানা হককে। কিন্তু রবিবার এ নিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্যে মূল দায়ী বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি ও সরকারি কিছু সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত। এক সময় বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবল্টু’ বলে বিদ্রূপ করা সালাম মুর্শেদীও এখন আওয়ামী লীগের এমপি! এই সালাম মুর্শেদীর নেতৃত্বে একদল গার্মেন্টস মালিকদের কারখানা থেকে এভাবে শ্রমিকদের ঢাকা আসতে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছিল।

এই জরুরি বার্তার মূখ্য রূপকার সরকারের বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি। পিঁয়াজ কেলেংকারী নিয়ে এই কিছুদিন আগে তিনি সরকারকে দেশেবিদেশে ডুবিয়েছেন। ডোবানোর বাকি কাজটি যেন করলেন এবার! এই বানিজ্যমন্ত্রী এই কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে মালিকদের গার্মেন্টস কারখানা খুলতে বলেছেন। এই বানিজ্যমন্ত্রীর নিজেরও গার্মেন্টস কারখানা আছে। তিনি শেফল গ্রুপের কর্নধার। তার গার্মেন্টস কারখানার হাতে এখন কাজও আছে। কিন্তু করোনা মহামারী এড়ানোর মূল চিকিৎসা বাড়ি থাকা এবং বাইরে বেরুলে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, সেখানে গার্মেন্টস কারখানায় ঢুকতে বেরুতে, কারখানার ভিতরে কাজ করতে, কাজ করাতে সামাজিক দূরত্ব কী করে সম্ভব? বানিজ্যমন্ত্রীর গার্মেন্টস কারখানায় এসবের বালাই আছে কী তা কী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন কী? কারন দিন শেষে সব দোষ গিয়ে পড়ে শেখ হাসিনার ওপর!

করোনা মহামারী মোকাবেলার এই সরকার অনেক ভালো কাজও করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বক্ষন সক্রিয়। আবার সমন্বয়ের অভাবে সুনামের বদলে বদনাম হয়ে যাচ্ছে বেশি! পিঁপড়ায় খাচ্ছে লাভের গুঁড়। যেমন দশ টাকা কেজির চাল কেনার লাইন দেখার কী কেউ নেই? প্রান্তিক মানুষদের তালিকা সরকারের কাছে আছে বলে তাদের ভাতার টাকা, চাল এসব দেয়া হয়। সেখানে যদি সামাজিক দূ্রত্ব মানা না হয় তাহলে যে মহামারীতে সব যাবে রসাতলে। তাদের যার যার ঠিকানায় সরকারি ত্রানের খাবার পৌঁছে দেয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ। ত্রানের ছবির জন্যে যাতে ঝুঁকি বাড়ানো না হয়।

সরকার সাধারনত ঈদের ছুটির আগেও গার্মেন্টস মালিকদের সঙ্গে বসে, কে কিভাবে ছুটি দিলে যানবাহন নিয়ে মানুষের ভোগান্তি কম-বেশি হবে তা নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু এই করোনা নিয়ে এবার ছুটি ঘোষনার আগে তেমন করে আলোচনা করা হয়নি। এবার ছুটি ঘোষনার পরও মানুষ ঈদের ছুটির মতো যানবাহনে গাদাগাদি করে করোনা ছড়ানোর বিপদ নিয়ে বাড়ি গেছেন। তখন আমরা লিখেছি নাড়ির টান! বিপদের সময়েও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কাটাতে চায়, শেয়ার করতে চায়।

কিন্তু তখনও বুঝিনি এভাবে বিপদজ্জনকভাবে যারা বাড়ি গেছেন তাদের যে বড় অংশ ছিল গার্মেন্টস কর্মী! কিন্তু তারা ফেরার সময় তাদের পরিচয় জানা গেলো! তাদের সিংহভাগ গার্মেন্টস কর্মী! সরকারি ঘোষনায় গণপরিবহন বন্ধ থাকার এই সময়ে তাদের কাছে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে কারখানায় হাজির না হলে চাকরি যাবে, বেতন পাবেনা! আমি আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম এবার জানা গেল এখনও দেশের গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন হয় এনালগ পদ্ধতিতে! ব্যাংক একাউন্টে বেতন জমা না দিয়ে হাতে হাতে বেতন দেয়া হয়!

আমার একটি সুবিধা আমাকে দেশেবিদেশের অনেক লোকজন ভালোবাসেন। তাই কখনও ভুল কিছু লিখলে অনেকেই তা শুধরে দিয়ে ইনবক্সে বার্তা দেন। প্রিয় একজন গার্মেন্টস মালিক তেমন একটি বার্তা দিয়ে এবার আমার ভুল শুধরে দিয়েছেন। তাঁর এই বার্তায় এমন আরও কিছু তথ্য তিনি দিয়েছেন যা দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির করুন একটি দিক ফুটে উঠেছে। ইনি লিখেছেন এখনও বাংলাদেশের ৩০-৪০ ভাগ গার্মেন্টস শ্রমিকদের জাতীয় পরিয়পত্র নেই।

এখন যার জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কোন বিকাশ বা ব্যাংক হিসাব খোলা যায়না। আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের অনেকের ক্ষেত্রে যারা বিবাহিতা তাদের অনেকে স্বামীর হাতে টাকা চলে যাবার ভয়ে ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে টাকা নিতে চাননা। কারন তারা বেতনের একটা অংশ মা-বাবাকেও দিতে চান। অনেক ক্ষেত্রে অনেক গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বামী তাদের ব্যাংক কার্ডটি নিজস্ব নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়! তখন তারা সহজে স্ত্রীর বেতনের টাকা এটিএম বুথের মাধ্যমে তুলে নেয়ায় তাদের নিজেদের চলার টাকা বা মা-বাবাকে দেবার টাকাও আর থাকেনা। ব্যাংক কার্ড স্বামীকে না দেয়াকে কেন্দ্র করে অনেকের সংসারও ভেঙ্গে যায়। অনেক গার্মেন্টস শ্রমিক এসব স্বত্ত্বেও সংসারটি টিকিয়ে রাখতে চান। কারন স্বামী বাড়িতে  বাচ্চা রাখেন বলেই তিনি কাজ করতে পারেন।

এবার গার্মেন্টস শ্রমিকদের এভাবে এই সময়ে ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় সহ কর্মক্ষেত্রে এভাবে ছুটে আসার আরও কিছু কারন সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অনেক গার্মেন্টস এরমাঝে অর্ডার হারানোয় অনেক গার্মেন্টস এখন বন্ধ হয়ে যাবার শ্রমিকদের কাজ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কাজেই এই পরিস্থিতিতে যখন তারা কারখানায় ফেরার অনুবার্তা পেয়েছেন বার ফোন কল পেয়েছেন, তখন তারা কাজ হারানোর ভয়ে পড়ি কি মরি করে ছুটতে শুরু করেছেন কর্মস্থলের উদ্দেশে।

এই সময়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলার নতুন একটি বার্তা পেয়েও গার্মেন্টস শ্রমিকরা এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি থেকে চলে এসেছেন। সরকার গার্মেন্টস মালিকদের কাছে তাদের শ্রমিকদের নাম-সাকিন-ব্যাংক একাউন্ট নাম্বারের তালিকা চেয়েছে। এ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে আগামী তিন মাস এই শ্রমিকদের বেতন তাদের ব্যাংক একাউন্টে সরাসরি জমা করা হবে। বেতনের এই টাকা গার্মেন্টস মালিকদের ২% সুদে ঋন হিসাবে দেবে সরকার। কাজেই গার্মেন্টস মালিকদের পক্ষে তাগাদা দেয়া হয়েছিল যার যার ব্যাংক একাউন্টের তথ্য জমা না দিলে তারা বেতন পাবেনা। যাদের এখন ব্যাংক একাউন্ট নেই, বেতন পেতে ব্যাংক একাউন্ট খুলতেও তাদের অনেকে এই সময়ে এভাবে পড়ি কী মরি করে ঢাকায় বা যার যার কর্মস্থলে ছুটে এসেছেন। তারা যখন বাড়ি গেলো তখন লিখলাম নাড়ির টান। ফেরার সময় লিখলাম রক্তচোষা গার্মেন্টস মালিক!

যদিও এই পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্য বানিজ্যমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন। আর গালাগালির সবটাই গেলো বেচারি রুবানা হকের একাউন্টে! বিজেএমইএ’কে এরাই গার্মেন্টস খুলতে বলে। আবার সমালোচনার বিপদ দেখে বলে বন্ধ করো! রুবানা হকের এরশাদ আমলের সেই ঘটনা অনেকে তুলে এনেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই ঘটনাটি আমাদের চোখের সামনের ঘটনা। এখন যারা লিখছেন তাদের বেশিরভাগ শুনে লিখেছেন। সেই ঘটনাটি আমি লিখেছিলাম বেশ আগে। এখন আর লিখিনা। কারন যেখানে এরশাদের সঙ্গে আমরা সংসার করি, সেই সময়ের সেই বয়সের রুবানা হকতো সামান্য এক নস্যি মাত্র। আনিসুল হকের আমরা প্রশংসা করি। আনিসুল হককে তৈরি করতে নেপথ্যের সেই মানুষটির নাম কিন্তু রুবানা হক। কাজেই ফর্জ এড়িয়ে নফল নিয়ে ব্যস্ত করার পিছনে কিন্তু ভিন্ন বদমতলব আছে। বদমতলবটি হলো আমরা যাতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের দিয়ে নিরাপত্তাহীন কাজ করানোর বিষয়টি ভুলে থাকি!

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com