খালেদা জিয়া প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা তারেক শিশু মুক্তিযোদ্ধা!

খালেদা জিয়া প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা তারেক শিশু মুক্তিযোদ্ধা!

ফজলুল বারী: বিএনপির দাবি হচ্ছে  খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সাজানো মামলায় সরকার তাদেরকে নির্বাচনের অযোগ্য করে রেখেছে। সাম্প্রতিককালে  খালেদাকে তারা এখন দেশের ‘প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা’, তারেককে ‘শিশু মুক্তিযোদ্ধা’ বলতে শুরু করেছে!

জিয়া তাদের স্বাধীনতার ঘোষক। এরমানে দাঁড়ায় এই পরিবারের সবাই মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের কারনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ জিয়াউর রহমানের বগুড়ার বাড়িঘর অক্ষত ছিল।

বিএনপির দাবিকৃত দেশের প্রথম শিশু মুক্তিযোদ্ধা তারেক রহমানের এখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব-পাসপোর্ট পর্যন্ত নেই!  মুক্তিযোদ্ধা তারেক রহমানকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতারের পর শর্ত সাপেক্ষে বিদেশ যেতে দেয়া হয়। তখন বলা হচ্ছিল মেরুদন্ডের চিকিৎসা শেষে তারেক দেশে ফিরে আসবেন।

কিন্তু মানুষ দেখলো তার চিকিৎসাও শেষ হয়না, তিনি আর দেশেও ফেরেননা। আদতে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। এমন একটি স্ট্যাটাস ছাড়া  কোন একটি দেশে কেউ অবিরাম অবস্থান করতে পারেননা।

বাংলাদেশের আইনে যৌথ নাগরিকত্ব গ্রহনযোগ্য। কিন্তু অপর দেশের নাগরিকত্ব, পাসপোর্ট ত্যাগ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে অংগ্রহন করা যায়না। কারন নির্বাচিত ব্যক্তিকে দেশ ও জনগনের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের শপথ নিতে হয়। তথ্য গোপন করে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তার নির্বাচন বাতিল হয়।

তারেক রহমান ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়েছেন কিনা বা পেয়েছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। শরণার্থী হিসাবে পাওয়া ট্র্যাভেল ডকুমেন্টে তিনি একবার সৌদি আরব গিয়েছিলেন। কিন্তু কোকোর মৃত্যুর পর তিনি মালয়েশিয়ায় আসতে পারেননি। অনেক দেশ ট্র্যাভেল ডকুমেন্টে ভিসা দেয়না।

১/১১’র সরকার ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়। আদালতে তাকে হাজিরের ছবি দেখে অনেকে চমকে যান। র‍্যাবের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে তাকে আদালতে নেয়া হয়েছিল। অথচ এর কয়েক মাস আগেও তারেক রহমান ছিলেন দোর্দন্ড প্রতাপশালী।

আদালতে দেয়া তারেক রহমানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে ভারতীয় পত্রিকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ২০০৮ সালের ১০ জানুয়ারি লিখেছিল, ‘রিমান্ডের সময় আমাকে ২৪ ঘন্টার ১৮ ঘন্টাই হাত ও চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল’। তারেক রহমান বলেছিলেন, ‘আমাকে বেঁধে রূমের ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে আবার ফেলে দেয়া হয় এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়’।

তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মারিয়ার্টির পাঠানো রিপোর্ট পরবর্তীতে উইকিলিকসে ফাঁস হয়।  মারিয়ার্টি লিখেছিলেন ২০০৮ সালের ২১ আগষ্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোজাহিদ সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সাবজেলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন।

বেগম জিয়াকে নির্বাচনে রাজি করাতে তখন বৈঠক চলছিল। ছেলেদের মুক্তি ও চিকিৎসার জন্যে বিদেশ পাঠানোর আগে খালেদা জিয়া কোন বৈঠকে রাজি হচ্ছিলেন না। তত্ত্ববধায়ক সরকার শুরুতে শুধু খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে কোকোর মুক্তিতে রাজি ছিল।

পরে খালেদা জিয়ার অনঢ় অবস্থানের কারনে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তারেক রহমানকেও মুক্তি দেয়া হয়। ওই সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মুক্তির পর তাকে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা ১১ টি মামলায় জামিন দেয়া হয়।

১১ সেপ্টেম্বর লন্ডন রওয়ানার আগে মুক্তির শর্ত অনুসারে তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ওই সময় শর্ত ছিল অন্তত তিন বছর তারেক রাজনীতি করবেননা। বেগম জিয়া তখন বলেছিলেন, তারেক অসুস্থ। এখন তার চিকিৎসা দরকার। এই মূহুর্তে সে রাজনীতিতে বিরত থাকবে।

তারেক রহমানের মুক্তির পর ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকাকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানী আতাউর রহমান বলেছিলেন,  তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা ধংস হয়ে গেল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে ক্ষমতায় ফিরে এলে তারেকের দেশে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে যায়।

এরপরও অনেকদিন বিএনপি বলতো, চিকিৎসা শেষ হলে তারেক রহমান ফিরে আসবেন। কিন্তু ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল মির্জা ফখরুল প্রথম স্বীকার করেন ২০১২ সালে তারেক ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন। এক বছরের মধ্যেই তা গ্রহন করা হয়।

রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে তারেক রহমান বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্রিটিশ সরকারের কাছে জমা দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ পচা একটা দেশ। আমি আর কোনদিন পচা বাংলাদেশে ফেরত যাবোনা। কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে এটাই  নিয়ম।

সেই থেকে বিএনপি এমন এক নেতৃত্বে চলছে যে আরেক দেশে আশ্রয় নিয়েছে। খালেদা জিয়াকে দেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা, তারেককে শিশু মুক্তিযোদ্ধা দাবি করার তাদের নিয়ে হঠাৎ আলোচনা বেড়েছে। ‘তাদের নেত্রী নাকি দেশের এক নম্বর নারী মুক্তিযোদ্ধা’ এমন প্রশ্নটি রেখেছিলেন ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম।

বিএনপি এর প্রতিবাদ করে খালেদা জিয়ার এক নম্বর নারী মুক্তিযোদ্ধা হবার ঘটনা প্রকাশ করেছে! এ  ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের নতুন ইতিহাস উদ্ভাবক মির্জা ফখরুলের বক্তব্য হলোঃ ‘জিয়াউর রহমান সাহেবের বিদ্রোহের পর তাঁর স্ত্রী, তিনি যখন সোয়াত জাহাজের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন কমান্ডার সোহরাব হোসেন সহ সেনাবাহিনীর সৈনিকদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করছিল।

সেই সময় খালেদা জিয়া প্রথম বলেছিলেন, তোমরা অস্ত্র সমর্পন করবেনা।  যতক্ষণ পর্যন্ত না জিয়াউর রহমান ফিরে আসেন।“ এ-ই  দিয়ে তার শুরু। এরপর মুক্তিযুদ্ধের নতুন এই ইতিহাসবেত্তার বক্তব্যঃ ‘আমাদের দলের নেতা তারেক রহমান সাহেবও ওই সময়ে অনেক কষ্ট করেন।

ওই সময়ে (একাত্তরে) তার ছোটভাই সহ খালেদা জিয়ার সঙ্গে বন্দী ছিলেন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ওই ছোট মানুষটির অবদানও কারও অস্বীকার উপায় নেই।‘

একাত্তরের উত্তাল মার্চে তৎকালীন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন-প্রস্তুতির ছবি এখনও অনলাইনে ভেসে বেড়ায়। মির্জা ফখরুলের বলা ইতিহাস অনুসারে তারা যেহেতু জিয়াউর রহমানের স্ত্রী না, তাই তাদের কেউ  দেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধাও না। প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা খালেদা জিয়া।

যিনি পাকিস্তানী জেনারেল জাঞ্জুয়ার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শোক প্রকাশ করেছিলেন। জাঞ্জুয়াকে নিয়ে প্রায় সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা হয়। খালেদা জিয়া অকৃজ্ঞ নন বলেই জাঞ্জুয়ার মৃত্যুতেও প্রটোকল ভেঙ্গে শোক জানিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনুসন্ধানে ১৯৯৭ সালে আমি ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় একমাস ছিলাম। আগরতলার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য আমাকে বলেছিলেন একাত্তরে জিয়া খালেদা জিয়াকে নিয়ে যেতে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান সানীকে ঢাকায় পাঠান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়ার জেড ফোর্সের সদস্য দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান সানী মেউর জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর ছোটভাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। খালেদা জিয়া তখন সানীর সঙ্গে যেতে রাজি হননি।

কিন্তু খালেদার কাছে পৌঁছুতে গিয়ে একাধিক মুক্তিযোদ্ধা তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। ওই ঘটনায় জিয়া খালেদার ওপর ক্ষুদ্ধ হন।

মুক্তিযুদ্ধের পর জিয়ার সঙ্গে খালেদার কি সমস্যা হয়েছিল, খালেদা কেনো তখন বারবার বঙ্গবন্ধুর কাছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে যেতেন, তা নিয়ে খালেদা জিয়া, মির্জা ফখরুল বা বিএনপির কেউ এখনও পর্যন্ত কিছু বলেননি।

মির্জা ফখরুল একদিন নিশ্চয় তার বাবা মির্জা রুহুল আমিন চোখা মিয়ার মুক্তিযুদ্ধে অবদান নিয়েও জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন!