ফজলুল বারী:প্রিয়জন হাসান আরিফ আর নেই। খবরটা শোনার পর থেকে মনটা বিক্ষিপ্ত। অনেক দিন ধরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন। ওই অবস্থায় তার হাসির ছবি দিয়ে মুন্নি সাহা ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছিলেন। আবৃত্তি শিল্পী সংস্কৃতিজন হাসান আরিফের ভক্ত সহকর্মী অনেক। অনেকেই তাঁর চিকিৎসা সংগ্রাম নিয়ে লিখছিলেন।
আমি মুন্নির পোষ্টগুলো অনুসরন করেছিলাম। আমি এসব পড়তাম আর কাঁদতাম। আমরা এক সময়ের সহযাত্রী ছিলাম। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সহযাত্রী। আমরা মিডিয়ায়। হাসান আরিফরা শিল্পকলায়। টেলিভিশনে আসার আগে মুন্নি সাহা, মিথিলা ফারজানারা আবৃত্তিতে গলা তৈরি করেছেন।
শুদ্ধ উচ্চারনে কথা বলার গলা। এসবের পিছনে হাসান আরিফদের ভূমিকা-অবদান অনেক। কৃতজ্ঞ মুন্নিরা তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত এসব লিখে লিখে প্রার্থনা করছিলেন, ফিরে আসুন। কিন্তু আর ফিরলেন না হাসান আরিফ। চার মাসের লড়াই ব্যর্থ হয়ে গেলো। এটা আমাদের সবার দূর্ভাগ্য।
এত সুন্দর করে যিনি কথা বলতেন, এত সুন্দর করে যিনি হাসতেন, তিনি এখন শুধুই কফিনে মোড়ানো নিথর একটি মরদেহ। আগেই লিখেছি আমাদের সম্পর্কটা স্বৈরাচারী এরশাদ আমলের। মিছিলে-চারুকলা-বেইলি রোড-টিএসসিতে। কি দারুন সব সংগঠন ছিল আবৃত্তি শিল্পীদের।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ এসব কি দারুন সব সংগঠন ছিল। এসবের নাম শুনলেই স্বৈরাচারী এরশাদ, তার দালালদের কাপড় নষ্ট হয়ে যেত। সেই স্বৈরাচারী এরশাদ, তার দালালরা যখন আওয়ামী লীগের আপন হয়ে গেলো, দেশের কবি-শিল্পী সবার যেন বন্ধ্যাত্ব লাগলো!
অতঃপর অনেক বছর ধরে দেখি হাসান আরিফরা শুধু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুর্দা বিদায়ের কাজ করেন! বিখ্যাত ব্যক্তিরা মারা যাবার পর জাতির শ্রদ্ধা নিবেদনে লাশ আনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে কফিনের অপর প্রান্তে প্রায় অনিবার্য চরিত্র হাসান আরিফ।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারন সম্পাদক। তাকে শুধু সেখানে দেখে দেখে ভালো লাগতোনা। হাসান আরিফের কাজ কী শুধু মুর্দা বিদায় করা! আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তি থাকে আন্দোলনে, রাজপথে। আর ক্ষমতায় গেলে হাসান আরিফদের কাজ হয় মুর্দা বিদায় করা!
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নাটক, দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা আবৃত্তি দেখার-শোনার ধারা সৃষ্টি হয়। গোলাম মোস্তফা, আসাদুজ্জামান নূর, ভাস্কর বন্দোপাধ্যায়, কাজী আরিফ, প্রজ্ঞা লাবনী, আমান উদ দৌলা, হাসান আরিফ, শিমুল মোস্তফা, আহকাম উল্লাহ থেকে শুরু করে কতজন যে আবৃত্তিকে বাংলাদেশে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়কার টিএসসি যেন ছিল পথ নাটক-আবৃত্তি শিল্পের সূতিকাগার। সব সংগঠনের অফিস ছিলনা। কিন্তু টিএসসির ভিতরে বাইরে গ্রুপ গ্রুপ বসে মহড়া ভিত্তিক শিল্পকলার চর্চা এই প্রজন্মের দেখার সৌভাগ্য হয়নি। হাসান আরিফরা সেই সব দিনরাত্রির অনিবার্য চরিত্র হয়েছিলেন। আবৃত্তির অনেক কর্মী-শিল্পী তারা তৈরি করেছিলেন।
সেই আবৃত্তি শিল্পীরাই আজ ছড়িয়ে গেছে সবখানে। হাসান আরিফরা বেঁচে থাকবেন তাদের সৃষ্টির মাঝে। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে তাঁর দেহ দান করে গেছেন। এমন সাহসী দৃষ্টান্ত তিনিই। ভালো থাকবেন প্রিয় হাসান আরিফ। অনন্তকালের তরে, গৌড়মন মধু করে, পান করি করিবেক, যশস্বী তোমারে।