ছোটবেলা র স্মৃতি

ছোটবেলা র স্মৃতি

না, আমার ছেলেবেলা রবীন্দ্রনাথের মত ছিল না। একটা উদাহরণ দেই, তাহলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে সবকিছুই। রবীঠাকুর তেল মালিশ করে গোসল দিতেন আর আমি বন্যার পানিতে গোসল করে শরীরে জমে যাওয়া পলির সাদা রঙ্গটাকে ঢাকতে তেল দিতাম। তারপরেও সবারই ছোটবেলা বা ছেলেবেলা বলে একটা অধ্যায় থাকে। কারো ছোটবেলায় ঈদে দরীদ্রদের মাঝে কাপড় বিলি করার স্মৃতি আছে আবার সেই কাপড়ে ঈদের নামাজ পরার স্মৃতি নিয়েও অনেকে বেচে আছে। স্মৃতিগুলোকে তো আর বাটখারায় তুলে পরিমাপ করা যাবে না । ওটা একান্তই নিজস্ব। আধুনিক যুগে ব্যাক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ আইন করে মানষের ব্যাক্তিগত তথ্য রক্ষা করা হয়। টেলিফোনের বিলের রসিদ টাকে স্রেডার মেশিনে টুকরো টুকরো করা হয় যাতে তথ্য ফাস না হয়। কিন্তু স্মৃতিগুলোকে রক্ষা করতে হয় না । ওটা মস্তিকের ক্লাউডে সংরক্ষণ হয় আজিবন। ওটাকে পুনরুদ্ধার করতে পাসওয়ার্ড লাগে না , লাগে শুধু কিছু লগ্ন, কিছু ঘটনা।

ছোটবেলা সবারই আছে এবং থাকবে। ররীঠাকুরের মত নামকরা লোকদের কথা সবাই জানবে কিন্তু পৃথিবীর ছয় সাতশ কোটি মানুষের ছোটবেলা সম্পর্কে জানা মুশকিল। আমি হয়তো বিদ্রোহী কবির মত ল্যাম্পপোষ্টের নিচে পড়াশুনা করি নাই কিন্তু এটাও সত্য যে টেবিল লাম্প এর নিচে আমার পড়াশুনা করার ভাগ্য হয় নি। বিদ্যাসাগরের মত আমি হয়ত মাইলপোষ্ট দেখে নাম্বার গননা শিখিনী, তাই বলে টেলিভিশনে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান থেকেও আমরা নামতা শিখিনী। আমরাও সংখ্যা গননা শিখেছি এবং সেগুলো সত্যি স্মৃতিমধুর। স্কুল ছুটির আগে বন্ধুদের সাথে গলা মিলিয়ে একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ…. এখনো কানে বাজে। আমরা হয়ত আবুল কালাম আজাদের মত হকার ছিলাম না কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের মত গামছা বিছিয়ে পড়াশুনার জন্য চান্দা উঠাই নি। তাই বলে আমার পড়াশুনার খরচও খুব সহজেই সংগ্রহ হয়নি। আমি টের না পেলেও আব্বা পেয়েছিলেন ।  হয়তবা প্রিয় গরুটি হাতছাড়া করতে হয়েছে কিংবা বাপ দাদার পৈত্রিক সম্পতিকে বন্দক রাখতে  হয়েছে কিছু সময়ের জন্য ।
আজ যখন উন্নত দেশে নরম বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না, মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার ঘুমের কথা। বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের আনাগোনা বেশী হলে, খাটে জায়গা হত না আমাদের মত ছোটদের। বুবুরা মাদুর বিছাতো মেঝেতে। গনবিছানায় শুয়ে বোনদের শ্বশুর বাড়ীর গল্প শুনতে শুনতে কখন যে স্বপ্নের রাজ্যে চলে যেতাম টেরই পেতাম না। বাড়ীতে বিয়ের অনুষ্ঠান থাকলে তো কথাই নাই। উঠানের সঙ্গীতানুষ্ঠান শেষ করেও মন ভরত না বুবুদের। বিছানাতে শুয়েও গীতের মহড়া চলত। আমরাও ওটাকেই লুলাবাই মনে করে ঘুমিয়ে পরতাম, আমাদের তো আর “টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার” শোনানোর কেউ ছিল না।
আজ যখন বড় বড় জাহাজে চড়ে ঘুড়তে যাই, ছোটবেলার ভেলায় ( আমাদের গ্রামে এই জলযানটাকে ভুড়া বলে)  চড়ার কথা মনে পড়ে। বন্যার সময় ওটাই যে ছিল আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। আমাদের গ্রামটি ঘনবসতি ছিল না। তাই বাড়ীগুলোর অবস্থানো ছিল দুরে দুরে। বন্যার সময় বাড়ীগুলোকে মনে হতো ভাসমান জাহাজ। বাড়ী থেকে মেইন রাস্তায় যেতে ভেলা, নৌকা কিংবা সাঁকোর দরকার হত। কম সময়ে এবং জিরো ইনভেসমেন্টে ভেলা বানানো যেত। তাই এই সম্ভুক গতির যানটিই ছিল বেশীর ভাগ সময়েরই যোগাযোগের মাধ্যম। আব্বার পকেটে টাকার আমদানী একটু বেশী থাকলে নৌকাও তৈরি হত আমাদের বাড়িতে। অনেকেই  অবশ্য চেয়ারম্যান মেম্বারদের বাগিয়ে রাস্তা বানিয়ে নিত মেইন রাস্তার সাথে। আব্বা বাগিয়েছিলেন মেম্বারদের কিন্তু ততদিনে ভুড়া চালাতে চালাতে আমাদের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গেছিল। যাদের ভুড়া চড়ায় বা চালানোর অভিজ্ঞতা নেই তাদের জন্য একটু ডেমো না দিলেই নয়। ঘোড়াই চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল এই জলযানটির জন্য কথাটি যথাযথ।  লগি দিয়ে জমিতে গুতো দিলেই ভুড়া সামনের দিকে এগুতো। নিউটনের তৃতীয় সুত্রের ব্যবহার আর কি। কিন্তু সমস্যা হল জমির প্রতিক্রিয়া। জমিতে পলি জমায় ওটার প্রতিক্রিয়া খুব একটা বেশী থাকত না। লগি শুধু ভুগর্ভস্থ ভেদে ব্যস্ত থাকত প্রতিক্রিয়ার কথাটাকে বেমালুম ভুলে। ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার লড়াইয়ের যে অ্যাকশনের সৃষ্টি হত তা ছিল ভুড়ার কম্পন। সে কম্পনে যাত্রী ও চালক মৃদু দোলন অনুভব করত মাত্র। উপরন্ত লগিকে পুর্বের অবস্থানে ফেরাতে যে বল প্রয়োগ করা লাগত সেটাতে ভেলা আবার তার পুর্বের অবস্থানে ফিরে যেত। ত্বরণ নামক পদার্থ বিদ্যার সেই বিষয়টাকে ডিফাইন করতে কষ্ট হত। আর তাই আমরাও এই যানটির চালক হতে অপারোগতা প্রকাশ করতাম প্রায়ই। আব্বা যাত্রী হলে যার ডাক পরত সে যেতে বাধ্য থাকত । অন্যদের বেলায় হত সমস্যা। ডাক পড়লেই কেউবা পড়ুয়া হওয়ার ভান করে টেবিলে বসে পরত, কারো বা প্রকৃতির ডাক পরত সেই সময়। ঠেলাঠেলির এক পর্যায়ে বড়দের হাতগুলো একটিভ হয়ে যেত। উপায় না থাকায় মাঝির দায়িত্ব পরত নিজের কাধে।
বাংলাদেশের সব জেলাতেই কমবেশি বন্যা হয় তবে আমাদের জেলাটাতে মানে গাইবান্ধায় মনে হয় সেই সময়টাতে বন্যা একটু বেশি হত।  গ্রামটা ছিল আবার  যমুনা নদীর ধার ঘেষে। সেই সময় একটু দুরেই ছিল, এখন তো গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত। আগে নদী দেখার জন্য যেতাম আর এখন নদী আমাদেরকে দেখছে প্রতিনিয়ত। বন্যার সময় পানি যাতে মিছিল করে আমাদের গ্রামে ঢুকতে না পারে তাই একটা বেড়ী বাধ ছিল গ্রামের পূর্ব দিক দিয়ে। আমরা ওটাকে বড় বাধ হিসেবে চিনতাম। বাধটা এত উচু ছিল যে  ওটাতে ওঠার সময় মনে হত ছোটখাট পাহাড়ে উঠছি। ওটা নাকি সাঘাটা থানার জুমারবারি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে যমুনা ওটাকে অক্ষত রাখে নাই। মাঝে মাঝে ওর থাবার চিহ্ন রেখেছিল ।পানির আগমন এবং নির্গমনকে কন্ট্রোল করার জন্য বাধটাতে অনেক  স্লুইস গেইট ছিল,  সেগুলো বন্যার সময় খুলে দেয়া হত  । ফলে কাতল ও রুই মাছের পোনা সহজেই ঢুকে পরত আমাদের গ্রামে। পলিও নিয়ে আসত প্রচুর। তিন মাস আবাদি জমিগুলো অনাবাদি হয়ে পলি জমাতো। স্কুল গুলো রেহাই পেত না বন্যার গ্রাস থেকে আর আমরাও বন্যার অঘোষিত ছুটি ভোগ করতাম দেড় দুই মাস। ঘর থেকে বেরুলেই পানি। অনেক সময় বন্যার পানিতেই পা ধুয়ে নিতাম ঘুমানোর আগে।এনজয় করতাম সেই সময়টাকে। বয়স কম ছিল, পেটে কিছু দানাপানি ঢুকলেই চলত সারাদিন। একটা চিন্তা ছিল স্কুলের। সেটাও থাকত বন্ধ। নাই কোন পড়াশুনার চিন্তা। সকালে পেটটাকে শান্ত করে বেরিয়ে পরতাম। সারাদিন টো টো কোম্পানির মত ঘুরে বেড়াতাম। গ্রামের মানুষগুলো বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে রাস্তাতে সময় কাটানো বেশি পছন্দ করত।  অনেকেই টং(মাচা) বিছিয়ে নিত। বড়লোকদের বর্ষাকালীন ভিলার মত। কেউ জাল বুনলে,অন্যরা বাঘ বকরি কিংবা ষোল পাত খেলত। একদল ছিল তাস খেলায় মগ্ন। টুয়েন্টি নাইন  খেলায় তুরুপ( ট্রাম)  করার সময় যে শব্দের সৃষ্টি হত সেটা ককটেল ফাটার আওয়াজকে হার মানাত। তবে এইসব একটিভিটি শুধু দিনের বেলায় সীমাবদ্ধ ছিল। রাতে এইসব মানুষের চেহারা পাল্টে যেত। এক একজন প্রফেশনাল জেলে হয়ে যেত। বন্যার প্রারম্ভে ঢুকে পরা কাতল ও রুই মাছের পোনাগুলো নাদুস নুদস হয়ে জন্মস্থানে ফেরার যাত্রা শুরু করত। ওগুলোকে ধরার জন্য চটকা জাল ( অনেকেই ওটাকে বড় ছিপ জাল বলে) ফেলে ওৎ পেতে বসে থাকত। জালে এক ঝাক আটকা পরলেই আশে পাশের গ্রাম পর্যন্ত প্রচার হতে টেলিফোনের দরকার হত না। মাছের ভার সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় ভেঙ্গে যেত জালের ছিপ। মা শুধু মাছের মাথা রান্না করত আর দেহটাকে শুটকি বানাত। আজ যখন মাথার স্বাদ নিতে ফ্রোজেন মাছ রান্না করি, মনে পড়ে যায় সেইসব দিনগুলিকে।

গতবছর দেশে গিয়ে নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম। আমার জিপিএস সিস্টেম প্রেডিক্ট করতে পারছিল না আমার অবস্থান। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে হল আমার অবস্থান বোঝার জন্য। ছোটবেলায় দেখা “যদি কিছু মনে না করেন” এর ফজলে লোহানির পদ্মার উপর সেই প্রতিবেদনটির কথা মনে পড়ে যায়  ” এই সেই প্রমত্তা পদ্মা…..”। যমুনা প্রমত্তা কিনা জানি না কিন্তু ওর ধ্বংসলীলা পদ্মার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। ফজলে লোহানির মত আমারও বলতে ইচ্ছে করছিল ” এই সেই প্রমত্তা যমুনা যেটা কেড়ে নিয়েছে আমার শৈশবের  স্মৃতি, কেড়ে নিয়েছে অনেকের সুখ, কেড়ে নিয়েছে অনেকের বাঁচার আশা ” ।  নদীভাংগা মানুষগুলোর চোখেমুখে শুধুই হারানোর ছাপ। ওদের অনভুতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। বেচে থাকার সংগ্রামে ওরা ব্যস্ত। নিঃস্ব হওয়ার ছাপ ওদের চোখেমুখেও ফুটে উঠেছে, ওদেরকে দেখে চিনতে কষ্ট হয় যে ওদের সাথেই ছোটবেলায় দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট খেলেছি।

Mahbub

 

 

 

 

(মোঃ মাহবুবর রহমান  তোত্তরি, জাপান, ,লেখক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার)