সাদাকালো একটা ছবি। কিছুটা বিবর্ণ। কিন্তু ৪৫ বছর ধরে সযত্নে এই ছবিটা সংরক্ষণ করে চলেছেন ফেরদৌস রহমান। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের এক অবিস্মরণীয় মূহুর্ত যেন ধরে রেখেছে ছবিটি।
৩রা এপ্রিল ১৯৭১। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনির নৃশংস অভিযান এবং গণহত্যার খবর তখন আসতে শুরু করেছে। লন্ডন প্রবাসী বাঙালিরা হতবিহ্বল। সবাই উদ্বিগ্ন স্বদেশে ফেলে আসা স্বজনদের নিয়ে। কেউ বুঝতে পারছেন না কী ঘটছে, কী করা উচিৎ।
সেদিন লন্ডনের রাস্তায় দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। শাড়ি পরা প্রায় দুশো বাঙালি নারী রাস্তায় নেমে এসেছেন তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে। বাচ্চাদের পুশ চেয়ারে বসিয়ে মিছিল করে তারা চলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দফতর দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটের দিকে। পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে, সেব্যাপারে বিশ্ব গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সেটাই প্রথম চেষ্টা।
সেদিনের মিছিলে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের এক বিরাট অংশ ছিলেন একেবারে সাধারণ গৃহিণী। তাদের অনেকের জন্য জীবনে সেটাই প্রথম মিছিল। কিন্তু তাদের তেজোদীপ্ত মুখ আর সংকল্প দেখে সেটা মনে হচ্ছিল না।
মিছিলের সংগঠকদের একজন ছিলেন ফেরদৌস রহমান। তাঁর স্বামী তখন লন্ডনে পাকিস্তান হাই কমিশনের একজন কর্মকর্তা।
“ঢাকার গণহত্যার খবর পাওয়ার পর ৩১শে মার্চ আমরা একটা মিটিং ডাকলাম। সেই মিটিং এ বসেই আমরা একটা সংগঠন করলাম, নাম দিলাম বাংলাদেশ উইমেন্স এসোসিয়েশন। মিসেস বকশ ছিলেন কমিটির কনভেনর, আর মিসেস লুলু বিলকিস বানু ছিলেন উপদেষ্টা। আমি ছিলাম কমিটির জনসংযোগ সম্পাদক। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, তেসরা এপ্রিল আমরা মিছিল বের করবো।”
“আমরা মহিলারাই যে প্রথম মিছিল বের করেছিলাম, তার একটা কারণ ছিল। আমরা ভেবেছিলাম, আমরা শাড়ি পরা মহিলারা মিছিল করে রাস্তায় নামলে যত সহজে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবো, অন্যরা তা পারবে না।”
সত্যি সত্যি তাদের এই কর্মসূচী সেদিন সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফ তখন এক তরুণ ছাত্র নেতা। তিনিও বলছিলেন, মহিলাদের আগে রাস্তায় নামানোর সিদ্ধান্তটি তারা সচেতনভাবেই নিয়েছিলেন।
“আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে মহিলা শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে, এরকম একটা বার্তা পৌঁছে দেয়া। তাই আমরা সবাইকে বলেছিলাম, শনিবার তেসরা এপ্রিল যেন সবাই মহিলাদের নিয়ে আসেন এমব্যাংকমেন্টের কাছে। সেখান থেকে সবাই মিছিল করে রাণীর প্রতি আহ্বান জানাবেন, তিনি যেন হস্তক্ষেপ করেন এই গণহত্যা বন্ধে।”
পরদিন ৪ঠা এপ্রিল লন্ডনে বাঙ্গালিদের আরও বড় সমাবেশ হলো ট্রাফালগার স্কোয়ারে। সেই সমাবেশের জন্য আগে থেকে অনুমতি নিয়ে রেখেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা বদরুল হোসেন তালুকদার। সেই মিছিলে যোগ দিলেন কয়েক হাজার মানুষ।
লন্ডন ভিত্তিক একটি সংগঠন স্বাধীনতা ট্রাস্টের আনসার আহমেদউল্লাহ বলেন, সেসময় বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাজ্যেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই পুরো যুদ্ধের সময় ধরেই এভাবেই লন্ডন পরিণত হয় বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে।
লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে এই আন্দোলনে এবং বিশ্বজনমত গঠনে সেদিন বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরি। আবু সাঈদ চৌদুরি সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন।
একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ তখন তার অফিস এবং বাড়ি, দুটিই ছেড়ে দিয়েছিলেন বিভিন্ন বাংলাদেশি সংগঠনের অফিস করার জন্য। তাঁর স্ত্রী জাহানারা বেগম তখন একেবারেই তরুণী, বিয়ের পর সদ্য এদেশে এসেছেন।
“১১, গোরিং স্ট্রীট ছিল আমার স্বামীর পাট ব্যবসার অফিস। তিনি পুরো অফিস ছেড়ে দিলেন বাংলাদেশ আন্দোলনের জন্য। সেখানে বসেই আবু সাঈদ চৌধুরি তার সব কার্যক্রম চালাতেন।”
ব্রিটেনে তখন কাজ করেন বহু বাঙালি চিকিৎসক। ডা: হালিমা বেগম আলম এবং তাঁর স্বামী ডাঃ মুহাম্মদ শামসুল আলম, দুজনেই তখন লন্ডনে পড়াশোনা শেষ করে চিকিৎসকের পেশায় নিয়োজিত। ঢাকায় গণহত্যার মর্মান্তিক খবরের ধাক্কা সামলে উঠার পর তাদের মনে হলো, কিছু একটা করতেই হবে।
সব ডাক্তারদের মিলে গঠন করা হলো একটি সংগঠন। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, লন্ডন থেকে তারা ঔষধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করে পাঠাবেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য।
‘আমি তখন সার্জন হিসেবে কাজ করি। নার্সদের বললাম তারা যেসব যন্ত্রপাতি ফেলে দেয়, সেগুলো যেন আমাদের দেয়, যাতে সেগুলো আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠাতে পারি। একই ভাবে বিভিন্ন ফার্মেসীতে গিয়ে সংগ্রহ করতাম মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ। কিন্তু অনেকে ভালো ভালো অপারেশনের সাজ সরঞ্জাম, মেয়াদ ফুরিয়ে যায়নি এমন ঔষধও আমাদের দিতো। এদের কাছে আমাদের অনেক কৃতজ্ঞতা।”
হালিমা বেগম আলম জানান, মহিলারা তখন এক বিরাট ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশে আন্দোলনে। লন্ডনের প্রত্যেকটি এলাকায়, বৃটেনের প্রতিটি শহরে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটির কার্যক্রমে মহিলারা অংশ নেন সক্রিয়ভাবে। ( সূত্র:বিবিসি বাংলা )