আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক ব্যথা, বেদনা, সংগ্রাম ও গৌরবের। অনেক অশ্রু ও রক্তের ইতিহাস। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র উত্তাল গণ অভ্যুত্থান ও ৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে দেশের স্বাধীনতা।
৭১-এর ২৫ মার্চ কালো রাতে বাংলার মাটিতে ভয়াবহ ও নৃশংস গণহত্যাটি শুরু করে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মোজাহিদ বাহিনী। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে ওরা বাঙালি জাতিসত্তাকে হত্যার নিষ্ঠুর যজ্ঞে মেতে উঠেছিল।
পাকিস্তানি হায়েনার দল ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিত ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের, পুলিশ ও ইপিআরের সদর দফতরে আগুন ধরিয়ে দেয় বাজার ও বস্তিতে, আতংকে হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু ঘর থেকে বের হলে তাদের ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে একটানা, যতক্ষণ না প্রতিটা মানুষ মারা না যায়। বাংলার মাটি, বাংলার প্রাণ সেদিন ভেসে গিয়েছিল রক্ত গঙ্গায়।
ফজিলাতুন নেসা বাপ্পিওই রাতেই ওরা গ্রেফতার করে স্বাধীনতার মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তছনছ করে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়ি। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
‘This may be my last message from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.”
এ প্রসঙ্গে সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বই থেকে অনূদিত একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে চাই, ‘দোজখের দরজাগুলো একবারেই খুলে দেওয়া হলো। যখন বন্দুকের প্রথম গুলিটি ছোঁড়া হলো, শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর পাকিস্তানের সরকারি রেডিও-র কাছাকাছি তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যে ভেসে এলো। এটা নিশ্চয় যা হবে এবং সেমত জানান দিল, শেখ সাহেব পূর্বপাকিস্তানকে ঘোষণা করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে।” (পৃষ্ঠা ৭৫)
৭১ এর ২৯ মার্চ সিডনির মর্নিং হেরাল্ড লিখেছে, ‘ঢাকার মাটিতে ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান বাহিনী এক লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে’। মাত্র ৯ মাসে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রতিদিন গড়ে ৯ থেকে ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ২০ মে ৭১, চুকনগরে একদিনে হত্যা করা হয় ১০ হাজার মানুষকে।
৮১ সালের ডিসেম্বরে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩৩ তম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- বিশ্বের ইতিহাসে যে সমস্ত গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তারমধ্যে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক সংখ্যেক ব্যক্তি নিহত হয়েছে বাংলাদেশে ৭১ সালের গণহত্যায়। বলা হয়েছে, ‘This is the highest daily average in the history of Genocides’।
আর্মেনিয়াতে গণহত্যা হয়েছে ৬ বছরে ১৫ লক্ষ, ভিয়েতনামে ২০ বছরে ৩৬ লক্ষ আর বাংলাদেশে মাত্র ৯ মাসে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। ৭১ এর অক্টোবরে সিআইএ মার্কিন সিনেটকে অবহিত করেছিল ‘ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানে ২৫ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে’। মার্কিন সিনেটের এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন ৭১ সালে। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যার অভিযোগ আনয়ন করেন। ‘গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ডস রেকর্ডস’ এই গণহত্যাকে বিশ শতকের ৫টি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ এর অবমুক্তকরন দলিলে এই নৃশংস হত্যা যজ্ঞকে ‘Selective genocide’ বা ‘Genocide’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। স্যামুয়েল টটেনসম্পাদিত ‘সেঞ্চুরি অব জেনোসাইড’ গ্রন্থে বাংলাদেশের গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ বলা হয়েছে। এনসাইক্লোপেডিয়া আমেরিকানা, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকেও ৩০ লাখ বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় টাইম ম্যাগাজিন মন্তব্য করেছিল, ‘It is the most incredible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland’।
সে সময় ঢাকয় অবস্থানরত ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং বলেছেন, ‘২৫মার্চ গণহত্যার যে চিত্র আমি ঢাকায় প্রত্যক্ষ করেছি এবং পরবর্তী ৯ মাসে সমগ্র বাংলাদেশে যা অব্যাহত ছিল তার ভিত্তিতে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ হতে পারে’।
১৩ জুন’ ৭১-এ এই নিষ্ঠুর গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানি সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাসের একটি প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদন বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দেয় যা লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
এই গণহত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে জর্জ হ্যারিসন ও পন্ডিত রবি শংকর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন। জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ধ্বনি এখনও আমাদের শিহরণ জাগায়। শাহরিয়ার কবিরের ডকুমেন্টারি ‘জার্নি টু জাস্টিস’- এ বিশ্বের খ্যাতনামা গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ও আইন প্রণেতাগণ এই গণহত্যা সম্পর্কে মর্মস্পর্শী ও হৃদয় বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন, যা দেখলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে, এদের মধ্যে উইলিয়াম স্লোগান, গিতা সেগাল, ফেডরিখ মাল্ম, বিধুকুমারী দেবি ও আরও অনেকে রয়েছেন। এমনকি খোদ পাকিস্তানের সীমা কার্মানী, সৈয়দ হায়দার ফারুখ মাহমুদী (জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মউদুদির পুত্র), আহমদ সালিম, তাহিরা আব্দুল্লাহ এই নৃশংস গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছেন, বিচার চেয়েছেন।
এটি ছিল পরিকল্পিত গণহত্যা। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়েরিতে লিখেছিল, ‘Paint the green ofEast Pakistan Red’ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিল, ‘Kill three million of them and the rest will eat out of our hands’।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতার চিত্র বিশ্বের প্রায় সকল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। ৫ এপ্রিল- ১৯৭১ এ নিউজ উইকে প্রকাশিত একটি সংবাদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য ছাপা হয়েছিল,
‘শেখ মুজিব ও তার দল পাকিস্তানের শত্রু, বিনা শাস্তিতে এদের রেহাই দেয়া হবেনা’ -প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।
‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। শেষ শত্রুসৈন্য নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত যেকোনও মূল্যে শত্রুদেরকে মোকাবিলা করো এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর স্বৈরশাসনের কবল থেকে দেশকে বাঁচাও’- শেখ মুজিবুর রহমান।
(সূত্র: বাংলাদেশ জেনোসাইড এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, মূল সংগ্রহ ও সম্পাদনা: ফজলুল কাদের কাদেরী, বাংলা অনুবাদ সম্পাদনাঃ দাউদ হোসেন, পৃষ্ঠা: ৩৪)
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধটি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল, প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অস্ত্র হাতে বীর বাঙালি সেদিন পরাজিত করেছিল বর্বর পাকিস্তানিদের, ওরা আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ভুট্টো-ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়াল কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রেখেছিল। কারাগারের ভেতর কবর খুঁড়েছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, কেউ তাকে মারতে পারেনা’। মৃত্যুর মুখে এমন প্রত্যয় যিনি ব্যক্ত করতে পারেন তিনি আমাদের জাতির পিতা, বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার জন্য তার জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছিলেন।
’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ওই দিন তিনি এক বক্তব্যে বলেন- ‘বাংলার মাটিতে যুদ্ধপরাধীদের বিচার হবে’। এই লক্ষ্যে ৭২-এর ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকার প্রনয়ন করে ‘The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) order, 1972’, যা দালাল আইন নামে পরিচিত- ৭৩ এর জুলাইয়ে প্রণয়ন করা হয় International Crimes Tribunals Act- 1973 সালে সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধপরাধের দায়ে প্রায় ১১ হাজার দালালের বিচার চলছিল। এরমধ্যে ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানে ১২, ৩৮, ৬৬ ও ১২২নং অনুচ্ছেদ সংযোজন করে দালালদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন, দালালদের ভোটাধিকার ও সংসদ সদস্য হওয়ার অধিকার ছিল না।
৭৫’-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তান বানানোর লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ইনডেমনিটি দেন, বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দেন, পুনর্বাসন করেন। ৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে অর্ডিন্যান্স নাম্বার- ৬৩/১৯৭৫ জারি করেন এবং কারাগারে আটক ও দণ্ডিত সকল যুদ্ধপরাধীকে ছেড়ে দেন, ’৭৬ সালে সেকেন্ড প্রক্লেমেশন অর্ডার নাম্বার- ৩/১৯৭৬ জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাবলী তুলে দেন। সেকেন্ড প্রক্লেমেশন ঘোষণা জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ দেন। প্রক্লেমেশন অর্ডার নাম্বার- ১/১৯৭৭ জারি করে দালালদের সংসদে নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ তুলে দেন। প্রক্লেমেশন অর্ডার নাম্বার- ১/১৯৭৭ এর মাধ্যমে সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের রাজনীতি করার সুযোগ দেন।
রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী, রাজাকার আলীমকে মন্ত্রী বানান। শহীদ পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু যে সব বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক ওই সব বাড়ি থেকে শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে উৎখাত করেন। বঙ্গবন্ধু ৭৩ সালে ১৮ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কুখ্যাত যুদ্ধপরাধী গোলাম আযম গংদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ৭৮ সালে গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন।
জিয়াউর রহমানের সময় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে জেনারেল ওসমানী বাধ্য হয়ে তাকে ৩ (তিন) বার সাসপেন্ড ও গ্রেফতার করার হুমকি দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিল তার গভীর সম্পর্ক যা অনেক পত্র-পত্রিকা ও পুস্তকে বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমানকে লেখা পাক-আর্মি কর্নেল বেগের মে ২৯, ১৯৭১ এর একটি চিঠি, দৈনিক আমাদেরসময়.কম-এ ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৩ তে প্রকাশিত হয়।
“Major Zia Ur Rahman, Pak Army, Dacca
We all happy with your job. We must say good job! You will get new job soon.
Don’t worrie about your family. Your wife and kids are fine.
You have to be more carefull about major Jalil.
Col. Baig Pak Army
May 29, 1971”
(তোমার কাজে আমরা সবাই খুশি। আমাদের অবশ্যই বলতে হবে তুমি ভালো কাজ করছো। খুব শিগগিরই তুমি নতুন কাজ পাবে। তোমার পরিবার নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ো না। তোমার স্ত্রী ও বাচ্চারা ভালো আছে। তোমাকে মেজর জলিল সম্পর্কে আরো সতর্ক থাকতে হবে। কর্নেল বেগ, পাক আর্মি মে ২৯, ১৯৭১)
পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অন্যতম কর্তা কর্নেল বেগ সকাল-সন্ধ্যা বাঙালিদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ও কর্নেল বেগ প্রতিপক্ষ। প্রশ্ন জাগে, কেন পাকিস্তানি হানাদার কর্নেল বেগ জিয়াউর রহমানের কাজে খুশি, আর খুব শিগগিরই জিয়াউর রহমান নতুন কাজ কেন পাবে?
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। জিয়াউর রহমান খালেদা জিয়াকে নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়ে লোক পাঠানো সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে যাননি, তিনি ক্যান্টনমেন্টেই ভালো আছেন সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন স্বামীকে।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার নেতৃত্বের ইতিহাস নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। এমনকি ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের প্রতিও জিয়াউর রহমানের ভীতি ছিল। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে দেওয়া হয়নি। একই ধারাবাহিকতায় ৯১ সালে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে দেশকে, ইতিহাসকে, আমাদের গৌরবকে ম্লান করে দেন।
অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর বিকৃত খেলায় মেতে ওঠে বিএনপি। রাজাকারের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়, আর যুদ্ধপরাধীদের বিচার দাবি করায় শহীদ জননী জাহানারা ঈমামের হাতে হাতকড়া পড়ায়।
ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেল জানজুয়ার মৃত্যুতে, খালেদা জিয়া সকল প্রকার রীতিনীতি প্রথা ভেঙে জানজুয়ার জন্য শোকবার্তা প্রেরণ করে সেদিন বীর বাঙালির মাথা হেঁট করে দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিল পত্র ১৫ খণ্ড সিরিজ গ্রন্থের ২০০৪ সনের পুনর্মুদ্রণকৃত তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চের ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ বা ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ বাদ দিয়ে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর চক্রান্ত করে বিএনপি-জামাত জোট সরকার।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির আলোকবর্তিকা, নিকষ কালো অন্ধকার দূর করেছেন, তাঁর নেতৃত্বে আমরা উদয়ের পথে যাত্রা করছি। তিনি জীবনের ওপর মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে সকল অপশক্তি ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম গংদের বিচার চেয়ে ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে দেওয়া তাঁর একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করছি, ‘এই সংসদ সার্বভৌম সংসদ। সেই লক্ষ্যে, আমি বিশ্বাস করি যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ, যুদ্ধ ও গণহত্যাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সাধন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পরও পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের সাথে জড়িত থেকে বাংলাদেশের বিরোধিতা, বিদেশি নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে বেআইনি রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ জনগণের যে মতামত প্রতিফলিত হয়েছে, তাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আন্তর্জাতিক ক্রাইম অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ সম্পর্কে বিচারের জন্য আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আপনার মধ্যমে এই সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে গোলাম আযম ও তাঁর সহযোগিদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে প্রসিকিউশন ও বিচারের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব রাখছি’।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নির্বাচনি ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধপরাধ, গণহত্যার বিচার চলছে। রায় কার্যকর হচ্ছে। ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে দিতে, বিতর্কিত করতে দেশে-বিদেশে গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করেছে যুদ্ধাপরাধীর দল। এমনকি ট্রাইব্যুনাল থেকে নথি চুরি করেছে। যুদ্ধপরাধীদের বাঁচাতে ডলার এর বিনিময়ে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে টবি ক্যাডম্যান, আর একিন গাম্প এর কথা উল্লেখ করতে পারি। ওই ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউর হিসাবে আমার কাজ করার সুযোগ ঘটেছিল- ওই দুষ্ট চক্রের থাবা যে কত ভয়ঙ্কর সেটি তখন প্রত্যক্ষ করেছিলাম। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হলে ওই দলের নেত্রী পাকিস্তানের মতই মর্মাহত হন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি জামাত একত্রে হরতাল করে। ২০১১ সালে প্রকাশ্য জনসভায় বিএনপি নেত্রী গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী, সাকা চৌ গংদের মুক্তি দাবি করেছিলেন।
খালেদা জিয়া, তার পুত্র তারেক রহমান ও বিএনপি নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের সুরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেন। গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে কটাক্ষ করেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেন।
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলার মাটিতে এই ঔদ্ধত্য ও স্পর্ধা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা মেনে নিতে পারি না। এটি গর্হিত অপরাধ। ইতিমধ্যে মহান জাতীয় সংসদ ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
এখন প্রয়োজন গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের শাস্তির জন্য আইন প্রনয়ন। পৃথিবীর ১৭টি দেশে গণহত্যা অস্বীকার বা Holocaust denial law রয়েছে। যেমন- অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেজ রিপাবলিক, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডস, পোলান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, রোমানিয়া ইত্যাদি।
বীরের রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারাআমরা ব্যর্থ হতে দেব না, ত্রিশ লাখ শহীদ বুকের রক্ত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। দুই লাখ সম্ভ্রম হারা মা-বোনের আর্তনাদ আমরা ভুলি নাই।
রাজনীতির কবির অমর কবিতা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আত্মায় বিরাজমান। এ প্রসঙ্গে ৮ মার্চ, ১৯৭১ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের অংশ ঠিক এরকম, ‘আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রাখিয়া গতকাল নির্ভীক নেতা এবং বীর জনতার কণ্ঠস্বর একই সুরে ধ্বনিত হইয়া ওঠে যুগ-যুগান্তর, দেশ-দেশান্তরের সকল মুক্তি-পিপাসু সভ্য জাতির হৃদয়বাসনার অমোঘ মন্ত্র- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। ধ্বনি ওঠে লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে দিগন্ত কাঁপাইয়া ‘জয় বাংলা’ ৭ই মার্চ তাই বাংলার সার্বিক স্বাধিকার আন্দোলনের দুর্গম দুস্তর পথের প্রান্তে একটি অতুলনীয় স্মৃতিফলক।’
যারা গণহত্যা অস্বীকার করে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে- তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় বিশ্বাস করে না। ১০ এপ্রিলে প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মানে না।
যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে তারা মুজিবনগরে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ এর প্রথম সরকার মানে না, যে সরকারের অধীনে আমরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। ওরা আমাদের সংবিধান মানে না, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতকে অবমাননা করে। তাই ওদের শাস্তির নিমিত্ত আইন প্রণয়ন আবশ্যক। গত ৪ মে, ২০১৭ এ সংক্রান্ত আমার একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব মহান জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি বিশ্বাস করি ৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুজাহিদ বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস গণহত্যা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের শাস্তির জন্য মহান জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করবে। ইতিমধ্যে এই আইনটির খসড়া তৈরি করা হয়েছে বলে মাননীয় আইন মন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন।
আমরা শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করবো। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করবো।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।