ফিরে দেখা ২০১৭: অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ

ফিরে দেখা ২০১৭: অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ

সিডনি, ০১ জানুয়ারি: দিন মাস পেরিয়ে অবশেষে বিদায় নিতে চলেছে আরও একটি বছর। এরই মাঝে নানান অভিজ্ঞতা, ঘটনা আর আয়োজনের নানান অনুভূতির স্মৃতিতে রয়ে যাবে ২০১৭ সালটি। ঝুলি ভরা এমন হরেক ঘটনার মাঝে কিছু কিছু ঘটনা আর কাজ কালের সাক্ষী হয়ে থাকল স্মৃতির স্থায়ী ঘরে। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের ২০১৭ সালে ঘটে যাওয়া এমন কিছু বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি নিয়ে এই প্রতিবেদন।

খুব স্বল্প খরচে ঘরে বসেই ক্যানসার শনাক্ত করার যন্ত্র উদ্ভাবন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের গবেষণাগারে কাজ করছেন বিভিন্ন দেশের ১৩ জন গবেষক। জহিরুলের নেতৃত্বে তাঁরা উদ্ভাবন করেছেন প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত করার উপায়। শনাক্তকারী যন্ত্রটি খুব কম খরচে এবং অল্প সময়ে ক্যানসারের প্রথম দিকেই শনাক্ত করা সম্ভব হবে। যন্ত্রটির আবিষ্কারক হিসেবে তিনি এর পেটেন্টও লাভ করেছেন।

এ বছর অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাঙালিদের জন্য সম্মানজনক ঘটনার মধ্যে একটি ছিল দেশটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ মূর্তি স্থাপন। এ বছর ২০ ফেব্রুয়ারি ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন সিডনির প্যারাম্যাটা ক্যাম্পাসের সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করা হয়। বঙ্গবন্ধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে প্রথম সমুদ্র আইন প্রতিষ্ঠা করায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ মূর্তি স্থাপন করে।

সিডনির স্থানীয় নির্বাচনে বাংলাদেশিদের জয়জয়কার
অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় নির্বাচনে প্রবাসী বাঙালিদের অংশগ্রহণ এ বছরই প্রথম না হলেও এ বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাঙালিরা অংশ নিয়েছেন গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সিডনির স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচনে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল থেকে পাঁচজন বাংলাদেশি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একজন বাংলাদেশি কাউন্সিলর পদে লড়াইয়ের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এর মধ্যে এবারই প্রথমবার মনোনয়ন পাওয়া তিনজন বাংলাদেশি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

সিডনিতে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন
অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বসবাসরত শহর হিসেবে সিডনিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি স্থায়ী মিশন বা কনস্যুলার সার্ভিস চালুর অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এ বছর ৭ আগস্ট বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যে চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো চালু হয়নি তবে হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে শিগগিরই চালু হবে।

শহীদ মিনার নির্মাণে সরকারি অনুদান
গত ১৬ ডিসেম্বর সিডনি-বাঙালি কমিউনিটি ইনক আয়োজন করে বিজয় উৎসবের। সেখানে বাংলা ভাষার ইতিহাসের প্রতীক শহীদ মিনার নির্মাণে অস্ট্রেলিয়া সরকারের তরফ থেকে সার্বিক সহযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে ৩৫ হাজার ৬শ ১৬ অস্ট্রেলিয়ান ডলার অনুদানেরও ঘোষণা দেন নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের রাজ্য সাংসদ অনুলাক চান্টিভংগ। শিগগিরই এর স্থাপনের কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ক্যানবেরায় সরকারিভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপন
এখন থেকে ক্যানবেরায় সরকারিভাবে মহান ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযথ মর্যাদায় উদ্‌যাপন হবে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি বা এসিটি রাজ্য সংসদে এ প্রস্তাব পাস হয়েছে। এসিটি সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা এলিস্টার ব্রুস কো এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশিদের অস্ট্রেলিয়ার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এমএলসি মুভমেন্ট’ এ ইস্যুতে দীর্ঘদিন কাজ করছে।

জনপ্রিয় ৪৫৭ কর্মভিসা বিলুপ্তির ঘোষণা
এ বছর অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন ক্ষেত্রে বেশ সংকটের দেখা দেয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল গত এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ৪৫৭ কর্মভিসা বাতিল করে দেওয়ার ঘোষণা। যদিও এ প্রস্তাবিত আইনে নতুন বছরেই চালু হওয়ার কথা রয়েছে তবে এর আগেই ভিসাটির আবশ্যিক আইনসহ নানা আইনে বিভিন্ন পরিবর্তন আনে দেশটির সরকার। ফলে এ ভিসায় অস্ট্রেলিয়ায় আসতে ইচ্ছুক এবং দেশটিতে বসবাসরত কয়েক হাজার বাংলাদেশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় পড়েন।

ক্রিকেট সংকট
এ বছর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট অঙ্গনে যে সংকট দেখা দিয়েছিল তার অন্যতম ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। দীর্ঘদিনের আর্থিক বিষয় নিয়ে ক্রিকেটারদের সঙ্গে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার দ্বন্দ্বের ফলে এ বছরের জুলাইয়ে অচলাবস্থা দেখা দেয় অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে। ফলে এ বছর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর নিয়ে বেশ শঙ্কায় পরে গোটা বাংলাদেশ।

বৈশাখী মেলার ২৫ বছর পূর্তি
বাংলা নববর্ষ মানেই বাঙালির উৎসব আয়োজন আর বৈশাখী মেলা। তবে বাংলাদেশের বাইরে সবচেয়ে বড় বৈশাখী মেলার আয়োজন হয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক আয়োজিত এ মেলার রজত জয়ন্তী ছিল এবার। দুয়ে মিলিয়ে এ বছর ১৩ মে বেশ জমকালো ভাবেই আয়োজন করা হয়েছিল এবারের মেলার। অন্যান্য মনোমুগ্ধকর আয়োজনের সঙ্গে ছিল সিডনির প্রধান সড়কে বড় বিলবোর্ডে নিয়ন আলোর বাংলা অক্ষরে লেখা আমন্ত্রণ বার্তা।

মেলবোর্নে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা
বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গত ১৬ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের প্রাণকেন্দ্র এবং সংস্কৃতির অন্যতম বাহক ফেডারেশন স্কয়ারে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ফেডারেশন স্কয়ারের ৮টি পতাকাদণ্ডে বড় আকারের বাংলাদেশি পতাকা দিনব্যাপী ওড়ানো হয়। বাংলাদেশের বিজয় আনন্দ উদ্‌যাপনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ফেডারেশন স্কয়ার কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশি-অস্ট্রেলিয়ানদের সংগঠন স্পিরিট ’৭১ এ আয়োজনের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে।

নাগরিকত্বের আইনে পরিবর্তন
জনপ্রিয় ৪৫৭ কর্মভিসা বিলুপ্তের ঘোষণা দিতে না দিতেই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণের আইনেও বেশ জটিল পরিবর্তন এনেছিল দেশটির সরকার। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল অভিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদানের আইনে এক বছরের পরিবর্তে চার বছর স্থায়ীভাবে বসবাস ও আইইএলটিএস পরীক্ষায় ৬ স্কোর করাসহ আরও বেশ কিছু আবশ্যিক শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে ক্রস বেঞ্চ ভোটে প্রস্তাবিত এই আইন পাস হয়নি। আপাতত আগামী ২০১৮ সালের জুলাইয়ের আগে আর কোনো পরিবর্তন আসছে না নাগরিকত্ব আইনে। এ ইস্যুতেও দেশটিতে বসবাসরত হাজারো বাংলাদেশি স্থায়ী অভিবাসী অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় পড়েছিলেন।

মেলবোর্নে বাংলাদেশ মৈত্রী স্মারক
এ বছর মেলবোর্নের গ্লোবাল ফ্রেন্ডশিপ ওয়ালে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ মৈত্রী স্মারক স্থাপন করেছে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ভিক্টোরিয়া।
মেলবোর্ন সিটি অব ক্যাসির ক্যার্নবর্নে রয়েছে এই বিখ্যাত ওয়াল। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের লালন এবং প্রকাশের ধারক হিসেবেই সূচনা এই গ্লোবাল ফ্রেন্ডশিপ ওয়ালের। বিশ্বের আরও নানা দেশের সঙ্গে এবার যোগ হলো বাংলাদেশের নাম। গত ২৬ জুন এই ওয়ালে বাংলায় লেখা ‘মৈত্রী ও শুভেচ্ছার প্রতীক স্বরূপ’ স্মারকটি উন্মোচিত হয়।

বাংলাদেশি ছাত্রের মৃত্যু
এ বছর অস্ট্রেলিয়ায় কয়েকটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি ছিল ডারউইনের চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটির আইটির শিক্ষার্থী প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্র ইরফান মুন্নার সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা। আরেকটি ছিল সিডনির টেকনিক্যাল অ্যান্ড ফারদার এডুকেশনের (TAFE) ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মুহাম্মদ কিবরিয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু। অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরির ডারউইনে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ঈদুল-ফিতর এবং নিজের জন্মদিনের দিন প্রাণ হারান ইরফান। অন্যদিকে সিডনির রকডেলে নিজ বাসায় অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন কিবরিয়া।

সূত্র: কাউসার খান ,প্রথম আলো