ফজলুল বারী:আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি কেমন হলো। এটা জানতে চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। অনেক মতামত এসেছে। যদিও এসব মূল্যহীন। শেখ হাসিনা তাঁর নতুন টিম ঠিক করেছেন। যাদের নিয়ে কাজ করলে ভালো লাগবে তাঁর সেভাবে সাজিয়েছেন নতুন টিম। নতুনদের নিয়ে দল নেতৃত্ব সাজানোর অঙ্গীকার ছিল। এদের অনেকে নতুন পদ পেয়েছেন। কিন্তু মুখগুলো নতুন নয়। সাধারন সম্পাদকের পদের দিকে অনেকের দৃষ্টি ছিল। শারীরিক অসুস্থতার কারনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সরিয়ে ওবায়দুল কাদেরকে সাধারন সম্পাদক করা হয়েছিল। আবার ওবায়দুল কাদেরকে সরানোর কথা ওঠে শারীরিক অসুস্থতার কারনে। কিন্তু ওবায়দুল কাদের যে সরতে চাইছিলেন না তা তাঁর চেহারায় ফুটে ওঠেছিল। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর মুখে হাসি ছিলোনা।
দেখতে মনে হচ্ছিল তাকে এখন সরিয়ে দিলে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। যেন যে কোন দূর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। আবার তাঁর বদলে যাদের নাম চাউর হয়েছিল সে তুলনায় ওবায়দুল কাদের বেটার চয়েস। সে কারনে মনে হয় ওবায়দুল কাদেরেই আস্থা রেখেছেন শেখ হাসিনা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকন্ঠও। শেখ হাসিনা যা চান তা তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে মার্কেটিং করেন। কিন্তু একটা বড় ঘাটতি তাঁর আছে তা তিনি মানেন কিনা জানিনা তবে মানলে তাতে দেশের লাভ। আর সেটা হলো ওবায়দুল কাদেরের সড়ক মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, বিআরটিসি এসব দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা দরকার এবং তা অতিদ্রুত।
নতুন আওয়ামী লীগে শাহজাহান খানের প্রমোশন অনেকের মতো আমাকেও চমকে দিয়েছে। ভয়ও করেছে। শাহজাহান খানকে আমরা দেশের দাগী পরিবহন মাফিয়া হিসাবে চিনি-জানি। যে কোন সময় তিনি পরিবহন ধর্মঘট ডেকে দেশকে সরকারকে জিম্মি করতে পারেন! কিন্তু আমি যে শাহজাহান খানকে দেখেছিলাম এই শাহজাহান খান সেই শাহজাহান খান না। আমি যখন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমন করি তখন বরিশাল অঞ্চল ঘুরে মাদারীপুর পোঁছে এই শাহজাহান খানের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলাম। তখন তাঁর ঘরে নতুন বৌ। সদ্য তাদের বিয়ে হয়েছে। শাহজাহান খান একটি একান্নবর্তী সংসারের সদস্য। সে বাড়ির একটা কক্ষ ভর্তি তাঁর বিয়ের উপহার সামগ্রীতে! একটা উপহার বক্সের ওপর লেখা পড়ে চোখ আটকায়। ‘মাদারীপুরের ধাঙ্গড় সম্প্রদায়ের পক্ষে উপহার’। একজন মানুষ সবার কত আপন হলে এমন উপহারও মিলে!
শাহজাহান খান তখন মাদারীপুরের জাসদ নেতা। তার বাবা আসমত আলী খান শিকদার ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা। সেই জাসদ নেতা-আওয়ামী লীগ নেতার বাহাস আমি খুব এনজয় করতাম। সেই শাহজাহান খান ঢাকায় কেন্দ্রীয় জাসদের নেতৃত্বে আসেন। এরপর যোগ দেন আওয়ামী লীগে। একবার আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দিলোনা। শাহজাহান খান বিএনপির অফিসে গিয়ে সংগ্রহ করেন বিএনপির মনোনয়নপত্র। তার বিএনপিতে যোগদান ঠেকাতে তাকে ডেকে এনে আবার দেয়া হয় মনোনয়ন। যে লোক দলীয় মনোনয়নের জন্যে বিএনপিতে যোগ দিতে চেয়েছিল সেই লোক আজ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য! শুনে ভয় করে? শেখ হাসিনা কী তাকে চোখে চোখে রাখতে প্রেসিডিয়ামে নিয়ে এসেছেন? দেখা যাবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই হাসিনার লড়াই। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ সবজায়গায় তিনি ছুরি চালিয়েছেন। আমি পংকজ দেবনাথের কথা ভাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিল থেকে শুরু করে সবকিছুর সামনের সারির মুখ। আমির হোসেন আমু জাতীয় পার্টি থেকে মইদুল আহমদকে নিয়ে এসেছেন মেহেন্দিগঞ্জে মনোনয়ন দেবেন বলে। শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিলেন পংকজ দেবনাথকে। এমপি হয়ে গেলেন পংকজ। সেই পংকজকে এবার জবাই করেছেন শেখ হাসিনা। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনের ধারেকাছে ভিড়তে দেননি। নতুন আওয়ামী লীগ কী দুর্নীতিবাজ মুক্ত? জাহাঙ্গীর কবির নানককে কেনো গত নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হয়নি? ছাত্রলীগের জবাই করা সভাপতি শোভনের সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল আব্দুর রহমানের? এমন আরও অনেককে নিয়ে প্রশ্ন আছে। শেখ হাসিনা সব জানেন। এরপরও তাদের কেনো নেয়া হয়েছে সেটাও তিনি জানেন।
আমার এক বন্ধু এবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক হয়েছেন। তার গল্পটা বলি। এরশাদ আমলে আমি বিচিন্তায় কাজ করি। রাজবন্দীদের তালিকা নিয়ে একটি রিপোর্ট করার এসাইনমেন্ট পেয়েছি। আওয়ামী লীগের রাজবন্দীর তালিকার জন্যে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার রোডের বাড়িতে ফোন করেছি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যেটি আজ মিউজিয়াম সেই বাড়িতেই তখন শেখ হাসিনা থাকতেন। সেটিই আওয়ামী লীগের অফিস। ফোন ধরে অনেক মন্দ কথা বললেন আমার সেই বন্ধু। বললেন আপনাদের বিচিন্তায় এই লেখা হয় সেই লেখা হয়। আমি বললাম এখন আমাকে তালিকা দেন। আমাকে বলা হয়, ফোনে কী তালিকা দেয়া যায়? সাহস থাকলে বত্রিশ নাম্বারে চলে আসেন। একটা রিকশা নিয়ে দিলুরোডের বাড়ি থেকে বত্রিশ নাম্বারে চলে আসি। তাকে প্রথম দেখি সামনাসামনি। আমার মতো হালকা-পাতলা।
আমাকে সামনে পেয়ে আবার এক পশলা কথা শুনিয়ে দেয়া হয়। আপনাদের কাগজে এই লেখা হয় সেই লেখা হয়। আমাকে নেয়া হলো বাড়ির রান্না ঘরে। কচুর মুখির তরকারি শুকনো করে রান্না করা হয়েছে। হাড়ি উচিয়ে দেখিয়ে বলা হয়, ভাত খাবেন? আমাদের নেত্রীও এসব দিয়েই খান। বললাম, দেন খাই। প্লেট ধুয়ে খেতে বসে গেলাম। খাবার সময় নেত্রী সেখানে আসেন। আমাকে এটা দিয়ে খেতে দেয়া হয়েছে দেখে তিনি যেন লজ্জা পান। আমি তাকে বলি অনেক মজা হয়েছে আপা। নেত্রী হেসে চলে গেলেন। খাওয়া শেষে বললাম, এবার তালিকা দেন। আমাকে বলা হয় এসব তালিকা তৈরি থাকে নাকি। আসলে তখনও আওয়ামী লীগের কোন কাজই আজকের মতো এতোটা গোছানো হয়নি। সাবের হোসেন চৌধুরী যখন আওয়ামী লীগের গবেষনা সেল গড়ে তোলেন তখনই দলটি গুছিয়ে চলতে শুরু করে। আমার সেই বন্ধুটির নাম বাহাউদ্দিন নাছিম। আওয়ামী লীগের নতুন যুগ্ম সাধারন সম্পাদকদের অন্যতম। গুডলাক বন্ধু।