ফজলুল বারী: প্রিয় তোয়াব ভাই। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বিশাল এক দিকপাল। বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক তোয়াব খান। লেখায় পড়ায় ও লেখানোয়–ব্যক্তিগত জীবনে আধুনিক একজন মানুষ। আজ আপনার ৮৯ তম জন্মদিন।
কেমন আছেন তোয়াব ভাই। জনকন্ঠের বাইরে এই প্রথম আপনার জন্মদিন পালিত হচ্ছে। অবশ্য জনকন্ঠে থাকতেও আপনি আপনার জন্মদিন নিয়ে লিখতে দিতেননা। আমরাই ফুল নিয়ে একটা ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে যেতাম। তখন এমন সোশ্যাল মিডিয়া না থাকায় তা ছড়াতোও কম।
আপনার স্নেহধন্য সাংবাদিকরা আজ ছড়িয়ে গেছেন সবখানে। অনেকে এখনও জনকন্ঠের ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা সবাই আপনাকে ভালোবাসি। প্রিয় তোয়াব ভাই, আমরা জনকন্ঠে থাকতে আপনি আপনার মেয়ে এশাকে হারিয়েছেন। আমরা তখনও অনেক অবুঝ।
সন্তান হারানোর বেদনা পাইওনি। জানতামওনা। আজ জানি। আমাদের অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের অনেক রকম কাজ চলছে। গরিব মানুষের উঠোনে নলকূপ করা হয়েছে ছত্রিশটি। খুব শীঘ্রই আরও তিনটি নলকূপের কাজ শুরু হবে। একটি নিজস্ব নলকূপ একটি পরিবারকে বদলে দেয়।
তারা অনেক বেশি আত্মমর্যাদাশীল, স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে ওঠেন। আমরা খুব গরিব মানুষ, যার নিজের একটি ভিটে আছে কিন্তু ভালো একটি ঘর নেই, তাদের ঘর বানিয়ে দেই। ছোট দোকানি দশ–পনের হাজার পুঁজি দিলে তারা তরতর এগিয়ে যান।
অনেক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে পারছেননা। আমরা লিখলেই ডোনাররা এগিয়ে আসেন। লাল টুকটুকে শাড়ি পরে আমাদের বোন যায় স্বামীর ঘরে। এখন আমাদের অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের ছোট্ট তিনটি খাবার ঘর চালু আছে।
কুলাউড়ার উন্দাল, গাজীপুরের অমর্ত্য ফাউন্ডেশন গরিবের হেঁসেল আর ভোলার বায়তুর তৌকির অমর্ত্য জামে মসজিদ। এই স্পটগুলোয় এখন আমরা প্রতিদিন কমপক্ষে ২শ মানুষকে ইফতারি খেতে দেই। এই মানুষগুলো খুব গরিব। তারা আমাদের খাবারের ওপর নির্ভরশীল।
তাদেরকে সেহেরির খাবারের বাজার করে দেয়া হয়েছে। আপনি শুনে খুশি হবেন ঈদে তাদের সবাইকে আমরা ঈদ উপহার দেবো। এক ব্যাগ ঈদের খুশি। একটা ব্যাগে করে শাড়ি+স্যান্ডেল বা লুঙ্গি+স্যান্ডেল বা থ্রিপিস+পাঞ্জাবি+জামা+স্যান্ডেল। সবার ঈদ উপহার এরমাঝে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
রোজায়–ঈদে আপনার আইডিয়া–এসাইনমেন্টে করা নানান রিপোর্টের কথা মনে পড়ে। বাজার দর থেকে শুরু করে ঈদ ফ্যাশনের খুঁটিনাটি নানা কিছু। শিকড়ের টানে মানুষের গ্রাম যাত্রার আদ্যপান্ত। আপনিই শুধু কোথাও যেতেননা। পারলে ঈদের দিনও পত্রিকা বের করেন!
একবার কুরবানির ঈদের আমাদের কাছে আসা একটি চিঠির সূত্র ধরে আমার লেখা একটি ছোট্ট রিপোর্ট নিয়ে আপনি একটি বক্স নিউজ করলেন ফ্রন্ট পেইজে। শেরপুরের এক গ্রামের এক মসজিদের ইমাম লিখেছেন তার গ্রামের লোকজন গরিব। বছরে একবার শুধু তারা কুরবানির ঈদেই মাংস খান।
কিন্তু আগের ঈদে গ্রামে কোন কুরবানি না হওয়ায় তারা সে বছর মাংস খাননি। জনকন্ঠের সে রিপোর্ট দারুন আবেদন সৃষ্টি করে। ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। কয়েকটি পরিবার তাদের কুরবানির টাকা নিয়ে অফিসে এসে হাজির হয়। তাদের অনুরোধ তাদের টাকাগুলো যাতে আমরা সে গ্রামে পাঠিয়ে কুরবানির ব্যবস্থা করি।
আপনাদের নির্দেশে অফিসে গিয়ে টাকাগুলো রিসিভ করে শেরপুরে পাঠানো হয়। তখনতো আজকের মতো বিকাশ–নগদ এসব ছিলোনা। শেরপুরে আমাদের সাংবাদিক মনিরুল ইসলামের পরামর্শমতো ফুলবাড়িয়ায় গিয়ে বিআরটিসির অমুক গাড়ির অমুক ড্রাইভারের হাতে টাকাগুলো দিয়ে আসি।
মনিরুল ইসলাম টাকাগুলো পেয়ে সেই ইমামকে সঙ্গে নিয়ে হাটে গিয়ে বিশাল তিনটি গরু কিনে দিয়ে আসেন। ঈদের দিন ঈদের জামাত শেষে ঈদগাহের পাশেই পশু তিনটি কুরবানি হয়। গ্রামবাসীও মাংস নিয়ে বাড়ি যান। অন্য রকম এক ঈদ হয় গ্রামে। ঈদের ছুটির পর এ নিয়ে ছাপা হয় ফলোআপ রিপোর্ট।
প্রিয় তোয়াব ভাই, আপনি শুনে খুশি হবেন গত কুরবানির ঈদে এই আইডিয়ায় আমরা বাংলাদেশের তিনটি স্পটে গরিবের কুরবানি নামের পশু কুরবানির ব্যবস্থা করেছি। এতে বিভিন্ন দেশ থেকে ডোনাররা টাকা পাঠিয়েছেন। একেকটি গরুতে সাতজনের কুরবানি হয়।
প্রতি ভাগার দাম ধরা হয়েছিল দশ হাজার টাকা। কারনে গ্রামে সত্তুর হাজার টাকার মধ্যে কুরবানির গরু পাওয়া যায়। অনেকে টাকা দিয়েছেন। কিন্তু কোন নাম দেননি। বলেছেন নাম আল্লাহর নামে দেন। বা অমর্ত্যের নামে দেন। আসলে সবাই যার যার মতো কুরবানি দেন।
এখানে আমাদের আহবানে গরিবের কুরবানিতে অংশ নিতে এসেছিলেন। গরিব গ্রামগুলোয় অনেক মানুষ এভাবে কুরবানির মাংস পেয়েছেন। গ্রামগুলোয় এ নিয়ে এক রকম উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আগামী কুরবানির ঈদেও আমরা গরিবের কুরবানির আয়োজন করবো। এবার নতুন কিছু গ্রামে।
প্রিয় তোয়াব ভাই, এভাবে জনকন্ঠে আপনার নেতৃত্বে দেশে–বিদেশে নানান রিপোর্টিং’এর আমাদের কত স্মৃতি। দেশের একটা স্মৃতির ঘটনা আজ লিখি। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় সফরের নিউজের কভারের জন্যে আমাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু আমি তাদের বিএনপি বিটের সাংবাদিক না হওয়ায় ওই মিডিয়া টিম ইচ্ছা করেই জনকন্ঠের সাংবাদিককে ফেলে রেখে ঢাকা ছেড়ে চলে যায়। বগুড়া থেকে ওই সফর শুরু হবার কথা। বগুড়ার বিএনপি নেতা হেলালুজ্জামান লালুকে ফোন করলে তিনি বলেন, আপনি বগুড়া চলে আসুন।
পর্যটন মোটেলে আপনার রূম থাকবে। বগুড়া থেকে আপনি মিডিয়া টিমের সঙ্গে সংযুক্ত হবেন। আহমদ নজির ওই মিডিয়া টিমকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আমাকে ফেলে আসা স্বত্ত্বেও পর্যটন মোটেলে দেখে তারা বিব্রত হন। কিন্তু তারা বা আমি কেউ কাউকে তা বুঝতে দেইনা।
পরদিন থেকে রিপোর্ট প্রকাশ শুরু হয়। মাঠের বক্তৃতার চাইতে আমি পথের এবং মাঠের বর্ননা বেশি লিখতাম। জনকন্ঠে তা গুরুত্ব দিয়ে ছাপাও হতো। তখন বগুড়ায় এবং উত্তরাঞ্চলে জনকন্ঠ সবার আগে পাওয়া যেতো। সকালেই তাই আমার রিপোর্ট দেখা–জানা নিয়ে কাড়াকাড়ি চলতো।
সকালে যাত্রা শুরুর সময় গাড়ির সামনে চালকের আসনের পাশে বসা আহমদ নজির উচ্চস্বরে আমার রিপোর্ট পড়ে সবাইকে শোনাতেন। যে রিপোর্টারকে তারা ঢাকায় ফেলে এসেছিলেন। আমি তাদের আচার–ব্যবহারের পরিবর্তন দেখে তখন মনে মনে হাসি। এটাই ছিল আমাদের পেশাদারিত্ব।
এভাবে আপনার নেতৃত্বে আমাদের কাজ করার অনেক স্মৃতি প্রিয় তোয়াব ভাই। আপনার নতুন মিশন আপনার নেতৃত্বে আবার বেরুচ্ছে অধুনা বিলুপ্ত দৈনিক বাংলা। আজ আপনার জন্মদিন উপলক্ষে আমাদের খাবার ঘরগুলোয় ইফতারির আগে আপনার জন্যে বিশেষ দোয়া হবে।
আমাদের গরিব মেহমানরা, ছোট ছোট সোনামনিরা আপনার জন্যে দু’হাত তুলে অনেক দোয়া করবেন। আপনি যেন সুস্থ থাকেন। আপনি পত্রিকা যেন খুব তাড়াতাড়ি বেরোয়। আপনার নতুন মিশন নতুন দৈনিক বাংলা যাতে নতুন কিছু হয়। সফল হয়। আপনাকে আমাদের অভিবাদন।