ফজলুল বারী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে নিয়ে একটি ভুল বক্তব্য দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে ভুল স্বীকার করে একটি ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এটা কোথাও ছাপা হয়েছে কিনা চোখে
পড়েনি। বাংলাদেশের অনেকে নিজস্ব সেন্সরশীপে নানাকিছু ছাপেনওনা। কুড়িগ্রামের চিলমারীর জেলেপাড়ার বাসন্তীকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বক্তব্য দেন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জাতীয় কৃষক লীগ আয়োজিত সভায় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি সেই বক্তব্য রাখছিলেন। ‘শেখ হাসিনা বলেন, বাসন্তী নামের একটি মেয়েকে জাল পরিয়ে ছবি তুলে সারা বিশ্বে প্রচার করা হলো’।
‘অথচ সেই সময় ১০-১২ টাকায় একটা শাড়ি পাওয়া যেত। আর একটা মাছ ধরার জালের দাম ১৫০ টাকার নিচে ছিল না। ইত্তেফাকের একজন সাংবাদিক, আর উত্তরবঙ্গের একজন সাংবাদিক তারা দু’জনে মিলে ছবিটি তুলেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে তারা দু’জনেই কিন্তু দুর্ঘটনায় মারা গেছেন’। ‘উত্তরবঙ্গের যে মোনাজাতউদ্দিন, তিনি কিন্তু পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। আর ইত্তেফাকের যিনি ছিলেন, তাকে নিজের গাড়ি চালক খুন করেন’। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য দেশের নিউজ টিভি চ্যানেলগুলো লাইভ সম্প্রচার করে। আমরা এখন বিদেশে থেকেও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে এসব বক্তব্য-নিউজ লাইভ দেখতে পারি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে চমকে উঠি। ভাবনা হয়, আমি ভুল শুনছিনাতো! শেখ হাসিনা যেহেতু পড়াশুনার মানুষ। নিজে লিখেনও।
সাংবাদিক অনেকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পারিবারিক পর্যায় পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার সময়ে সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়। এসব কারনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের একমাত্র চারন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন সম্পর্কে ভুল বলছেন দেখে চমকে উঠি। বাক প্রতিবন্ধী কিশোরী বাসন্তী ও আরেক কিশোরী দূর্গতিকে তাদের ছেঁড়া শাড়ির ওপর জাল পরিয়ে সাজানো ছবিটি তুলেন ইত্তেফাকের ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তার বাড়ি। বাংলাদেশের অনেক ফটো সাংবাদিকের এমন অনেক সাজানো ছবির গল্প ফটো সাংবাদিকরাই ভালো জানেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে তার অনেক বিখ্যাত ছবি আছে। আফতাব হোসেনকে ওই গ্রামে নিয়ে যান আনছার আলী নামের একজন রিলিফ কমিটির সদস্য। এক সময় মুসলিম লীগ করতেন আনছার আলী। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগে নাম লেখান। ওই সাজানো ছবিটি তুলতে আফতাব আহমেদ বাসন্তীর হাতে ৫০ টাকার একটি নোট দেন!
১৯৭৪ সালের ৫০ টাকা! এতেই স্পষ্ট হয় আফতাব আহমেদ বিশেষ মিশন নিয়ে তখন ওই গ্রামে গিয়েছিলেন। মানিক মিয়ার হাতের দৈনিক ইত্তেফাকের কাছে বঙ্গবন্ধুর অনেক ঋন আছে। মানিক মিয়া পরিবারের সঙ্গে তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের হৃদ্য সম্পর্ক। কিন্তু মানিক মিয়ার সন্তানরা তা মনে রাখেননি।
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘জাল বসনা বাসন্তী’ শিররোনামের ওই ফটো স্টোরি ছাপা হয়। এর উপজীব্য ছিল দুর্ভিক্ষের কারনে খাবারের অভাবে বাসন্তী-দুর্গতিরা পাটগাছের ডাটা চিবিয়ে খান! কাপড়ের অভাবে তারা মাছ ধরার জাল পরে লজ্জা নিবারনের চেষ্টা করেন! আফতাব আহমদের ছবির অনুসরনে ওই ফটো স্টোরি লিখেন ইত্তেফাকের সাংবাদিক শফিকুল কবির! যিনি পরবর্তীতে আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিক ছিলেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রথম সভাপতি। আফতাব
আহমেদ ছিলেন বিএনপি ঘরনার ফটো সাংবাদিক। এরশাদ আমলে যারা ইত্তেফাকের স্বনামখ্যাত ফটো সাংবাদিক রশীদ তালুকদার-আফতাব আহমেদকে যারা কাছাকাছি দেখেছেন তারা অনেক ঘটনা মনে করতে পারেন। একজন আরেকজনের দেখা হলেই সেখানে হাতাহাতির ঘটনা ঘটতো!
২০০৬ সালে বিএনপি জামায়াত সরকারের শাসনামলে আফতাব আহমেদকে একুশে পদক দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার প শ্চিম রামপুরার বাড়িতে খুন হন আফতাব আহমেদ। হাত-পা বাঁধা, মুখে গ্যাগ লাগানো অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ময়না তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ তাকে হত্যার দায়ে ৫ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। বাসন্তী-দুর্গতির জাল পরানো ছবি সাজানোর সহযোগী আনছার আলীও তার বাড়ির বাইরে গুলিতে নিহত হন। কাজেই ওই সাজানো ছবির দুই কারিগরেরই অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দাবিটি ঠিক আছে। স্বীকার করে নেয়া ভুল হলো দ্বিতীয় ব্যক্তিটি চারন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন নন, আনছার আলী।
মোনাজাতউদ্দিন বিভিন্ন সময়ে সাজানো ছবিটি নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন। মোনাজাত উদ্দিনের ‘চিলমারীর একযুগ’ গ্রন্থে সেই রিপোর্টগুলো আছে। সংবাদের মোনাজাতউদ্দিন বাংলাদেশের মফঃস্বল সাংবাদিকতার রিপোর্টকে পত্রিকার ভিতরের পাতা থেকে প্রথম পাতায় তুলে আনেন। শেষ জীবনে তিনি জনকন্ঠ পত্রিকায় কাজ করেন। আমি যখন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমন করছিলাম তখন প্রথম চিলমারীর গ্রামে বাসন্তীকে দেখতে যাই। বিচিন্তায় ছাপা ‘প্রজন্মের পরিভ্রমন’এ সেই বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর ৭৬ সেগুনবাগিচা থেকে আমরা বের করেছিলাম সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম।
মোনাজাতউদ্দিন তখন ঢাকায় এলেই প্রিয় প্রজন্ম অফিসে চলে আসতেন। প্রিয় প্রজন্মের তরুন সাংবাদিকদের নিয়ে চালাতেন সাংবাদিকতার পাঠশালা। সেই পাঠশালার একমাত্র শিক্ষক ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। আমরা সবাই সেখানে ছিলাম তাঁর ছাত্র। জনকন্ঠে এসে বেশি বেতন পেলেও সংবাদের মোনাজাতউদ্দিন হারিয়ে যান। আসলে সংবাদের মোনাজাতউদ্দিনকে জনকন্ঠ ধারন করতে পারেনি। সংবাদে থাকতে মোনাজাতউদ্দিন অবশ্য তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী শেখ
হাসিনাকে নিয়ে একবার একটি ভুল রিপোর্ট করেছিলেন। দহগ্রাম-অঙ্গারপোতা যাবার তিন বিঘা করিডোর তখনও বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর হয়নি। শেখ হাসিনার মিডিয়া টিমের সদস্য হিসাবে আমরা তখন দহগ্রাম-অঙ্গারপোতা যাচ্ছিলাম। সৈয়দ বোরহান কবির, ওবায়দুল কবীর, প্রনব সাহা, আমি সহ আরও কয়েকজন ছিলাম সেই দলে।
গাড়িরবহরে শেখ হাসিনার গাড়ির পিছনেই ছিল মিডিয়া টিমের গাড়ি। বিএসএফ সদস্যরা তিন বিঘা করিডোরে বাংলাদেশের বিরোধীদলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দিতে চান। শেখ হাসিনা গাড়ি থেকে নেমে তাদেরকে বলেন দহগ্রামের জনসভা থেকে ফেরার পথে তিনি গার্ড অব অনার নেবেন। মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন বহরের শেষের দিকের একটি গাড়িতে। তিনি তখন রিপোর্ট করেছিলেন, ‘তিন বিঘা করিডোরের গেট বন্ধ থাকায় থেমে গেলো শেখ হাসিনার গাড়ির বহর’। আমি তার সেই ভুল নিয়ে তখন সাপ্তাহিক খবরের কাগজ পত্রিকায় লিখেছিলাম। যে ভুল সাধারনত তিনি করতেননা। ফেরী দূর্ঘটনায় মোনাজাতউদ্দিন প্রান হারালে তাঁর শূন্য আসনে জনকন্ঠে আমার চাকরি হয়। এরজন্যে তাঁর
প্রতি আমার অনেক ঋন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর লিখবো লিখবো করছিলাম। আজ এ লেখা শেষ করার আগে ঢাকায় ফোন করে কথা বলতেই অবাক তথ্যটি পাই! মোনাজউদ্দিন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুল উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের দেয়া ব্যাখ্যা সাংবাদিকরা না ছেপে চেপে গেছেন। এভাবে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছোট করলেন না বড় করলেন! অনেক ধন্যবাদ প্রিয় প্রধানমন্ত্রী।