তিন ভাগে বিভক্ত জেএমবি, পৃথক নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা

তিন ভাগে বিভক্ত জেএমবি, পৃথক নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা

অনলাইন ডেস্ক: ১৭ আগস্ট ২০১৫
এক দশক আগে এই দিনে সারা দেশে একযোগে ৫০০ বোমা ফাটিয়ে অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এরপর প্রতিষ্ঠাতা ও শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি, গ্রেপ্তার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার মুখে বিপর্যস্ত সেই সংগঠনটি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে একক নেতৃত্বে নয়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটি এখন তিন ভাগে ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে।
গত কয়েক মাসে গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবির সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠীর ওপর নজরদারিকারী একাধিক সূত্র। এর মধ্যে এক ভাগের নেতৃত্বে আছেন জেএমবির কারাবন্দী আমির মাওলানা সাইদুর রহমান। এই অংশের মূল মনোযোগ পুরোনো নিষ্ক্রিয় সদস্যদের উজ্জীবিত করে সংগঠন গোছানোর দিকে।
জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০০৭ সালে জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা আমির শায়খ আবদুর রহমানসহ পাঁচ শীর্ষস্থানীয় নেতার ফাঁসি হওয়ার পর মাওলানা সাইদুর রহমান জেএমবির আমির হন। তিনি ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হন। তিনি কারাগার থেকে নানাভাবে বাইরে থাকা সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। আর তাঁর ছেলে আবু তালহা মোহাম্মদ ফাহিম জামিনে বেরিয়ে মাঠপর্যায়ে তাঁর বাবার অনুসারীদের সংগঠিত ও শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছিলেন। ফাহিমকে ২০১০ সালের ৮ জানুয়ারি রাজশাহী থেকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। এর নয় মাসের মাথায় তিনি জামিনে মুক্তি পান।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বলছে, জামিনে বেরিয়ে ফাহিম জেএমবির ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ২৭ জুলাই রাতে রাজধানীর উত্তরায় একটি মেসে অভিযান চালিয়ে ফাহিমসহ জেএমবির আট জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন, জেএমবি এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তাই নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিরা উত্তরার একটি মেসে জড়ো হয়ে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করতে চেয়েছিল।’ তিনি বলেন, জেএমবি এখন তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নেতা সাইদুর রহমান। জেএমবির এই অংশের লক্ষ্য ছিল যেকোনো উপায়ে সংগঠনের আমির সাইদুর রহমান ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানীকে কারাগার থেকে মুক্ত করা।
জেএমবির আরেকটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুলিশ হত্যা করে প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন ও বোমা মিজান। এই অংশটির সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথম টের পায় গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে আক্রমণ করে জঙ্গিরা সাজাপ্রাপ্ত তিন জেএমবি নেতা সালাহউদ্দিন, বোমা মিজান ও হাফেজ মাহমুদকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। হাফেজ মাহমুদ ওই দিন সন্ধ্যায় ধরা পড়েন এবং ক্রসফায়ারে নিহত হন।
জেএমবির এ অংশটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে ২০০৫ সালের মতো নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে ভারতের বর্ধমানে বিস্ফোরণের ঘটনায় সেটা সফল হয়নি বলে ঢাকার গোয়েন্দা সূত্রগুলো দাবি করছে।
ভারতে গিয়ে বর্ধমানের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবির সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, জেএমবির এ অংশটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার মুখে দেশে বসে প্রস্তুতি নিতে পারছিল না। তাই সীমান্তের ওপারে ভারতের বর্ধমানে বসে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ওই কর্মকর্তা বলেন, জেএমবির এ অংশটি কারাবন্দী আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গি নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন।
জঙ্গিদের ওপর নজরদারির দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, জেএমবির তৃতীয় অংশটিতে আছে মূলত তরুণ কর্মীরা। এ অংশটি এর আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রতি ঝুঁকেছিল। কেউ কেউ আনসারুল্লাহর সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। তবে এখন এ অংশটির আগ্রহ এখন সিরিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের প্রতি। রাজধানীর গোপীবাগের স্বঘোষিত ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি লুৎফুর রহমানসহ ছয় খুন এবং রাজাবাজারে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যার ঘটনায় জেএমবির এই অংশটিকে সন্দেহের শীর্ষে রেখেছে তদন্তকারী সংস্থা।
১৯৯৮ সালে জেএমবির জন্ম হলেও প্রথম কয়েক বছর সংগঠনটির নাম প্রকাশ পায়নি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা ফাটানোর পর ব্যাপকভাবে সংগঠনটি আলোচনায় আসে। এরপর কয়েক মাসের মধ্যেই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান ও অন্যতম শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব নেতা ধরা পড়েন। বিচারের পর ২০০৭ সালে শীর্ষস্থানীয় ছয় নেতার ফাঁসি কার্যকর করার পর সংগঠনটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরপর কয়েক দফা নেতৃত্ব পুনর্গঠিত হলে ওই সব নেতাও পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার হন। ফলে গত ১০ বছরে জেএমবি নতুন কোনো নাশকতা চালাতে পারেনি। কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রিজন ভ্যানে হামলা করে নেতাদের ছিনিয়ে নিয়ে জেএমবি আবার আলোচনায় আসে।

(সুত্রঃ প্রথম আলো)