তারিক কে অনেক দিন লেখা দিতে পারি না ! কি করব! লিখতে শুরু করার আগেই মেমরি সিস্টেম হয় করাপ্টের অ্যালার্ম দেয়, না হয় সিস্টেম এম্পটির মেসেজ দেয় । মাঝপথেই আমার সাহিত্য শেষ । বড়জোর সাহিত্য হয় দশ বারো লাইনের । তারিক কত কষ্ট করে এত সুন্দর একটা সাইট দাড় করিয়েছে । আমি লজ্জার মাথা খেয়ে আমার এই অপুষ্টিতে ভোগা সাহিত্য পাঠিয়ে ওর সাইটটাকে কলঙ্কিত করতে চাই না। সেটা ওকে বোঝাতে পারি না, শুধু বাংলাদেশের পলিটিশিয়ানদের মত ( সবাই না ) মিথ্যা বলি ” তারিক ব্যস্তরে, লেখা পাঠাতে পারছি না ” । যথারীতি তারিক মার্কা উত্তর আসে ” শ্যা কিসের ব্যস্ত !!! ” ।
আমি আর কথোপকথন বাড়াই না , ভাব দেখাই আসলেই বিজি । কিসের বিজি ? অফিস থেকে ফিরে হয় আইফোন না হয় কম্পিউটার । সহধর্মীনী তো আইফোনটাকে আমার হার্টের সাথে তুলনা করেছে । আইফোনটাকে একটু একা দেখলেই ব্যঙ্গ সুরে বলে ” তোমার হার্টটা দেখি পরে আছে ! ” ছেলেও মায়ের কথা শুনে মজা পায় । আমি লজ্জা পেলেও কিছু বলি না । কি করব ! সময় একটু বেশীই দেয়া হয় আইফোনটাকে, অফিসের সময়টা বাদ দিলে । আমার ভুলে ভরা সাহিত্য যে আইফোনের স্ক্রীনেই সৃস্টি । ভুলক্রমে যদি নামিদামী( ?) হয়েও যাই তবে আমার পান্ডুলিপির জন্য কোন মিউজিয়াম থাকবে না । কোন ক্রমে আইফোনের মেমরি যদি ক্রাশ হয় তো আমার সাহিত্যের পান্ডুলিপিও খতম । আমার সাহিত্য বলতে তো ছোটবেলার স্মৃতি । চেরি গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুকে আমি ডায়মন্ডের সাথে তুলনা করে সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারি না । পাতাতে আশ্রয় নেয়া শিশির বিন্দুটির মত নিজেকে সাহিত্যের জগতে পরগাছা মনে হয় । দুরের পাহাড়ের চুড়ায় বিরামহীন ঘুরে চলা উইন্ডমিলের পাখাগুলোকে ঘুরতে দেখে আমার সাহিত্য হয় না । সিনেমায় দেখা রিক্সার চাকাকে ঘুড়ানো দেখাতে দেখাতে পরিচালক যেমন ব্যাকফ্লাসে চলে যায় , আমিও উইন্ডমিলের পাখার ঘুড়নি দেখে অতীতে চলে যাই । চেখের সামনে ভাসতে থাকে একরাশ স্মৃতি । কিছু স্মৃতি হাসায় কিছু স্মৃতি চোখের কোনে পানি জমায় । নস্টালজিয়ায় ভুগতে থাকি । আঙ্গলের ডগা বড় বেশী সচল হয় । চোখ বন্ধ করলেই আব্বার চলাচলের আওয়াজ পাই,মরচে পরা সাইকেলের বেলের আওয়াজ শুনে চমকে উঠি ।
এবারও আমি আমার অতীতের স্মৃতি নিয়েই লিখব । জাপানের ঈদের একদিন আগের কথা । অফিসে যাবার প্রস্তুতি হিসাবে কাপড়ে আইরন চালাচ্ছি মানে কাপড় ইস্ত্রি করছি । কর্ডলেস মেশিন । ইস্ত্রি করতে করতে কখন যে শৈশবে চলে গেছি টেরই পায়নি । ভাগ্যিস কর্ডলেস ছিল আইরন মেশিনটি । তানাহলে কাপড়ে ক্যালেন্ডারের ছাপ পরে যেত। কাপড় পোড়ার গন্ধ পেয়ে ছেলের মা এক নিশ্বাসে দশটা বাক্য শুনিয়ে দিত । সেরকম কিছুই ঘটে নাই , শুধু কিছু সময়ের জন্য ফিরে পেয়েছিলাম ছোটবেলার ঈদের আগের দিনগুলোকে । আমার মেজভাইটা ছিল মহা শৌখিন । সিনেমার নায়কদের ফ্যাশনকে নকল করতে যেয়ে যে প্যান্ট বানিয়েছিল সেটা দিয়ে গ্রামের কাচা রাস্তাও অটোমেটিক ঝাড়ু দেয়া হয়ে যেত । সমস্যা হলো প্যান্টে ইস্ত্রির ভাজ না থাকলে ঝাড়ুর কাজটা একটু বেশীই হয়ে যেত । গ্রামে কাপড় চোপড় ভাজ করে বইয়ের ভার দিয়ে ইস্ত্রির কাজটা অনেকে সেরে নিত । মোটা কাপড়ের প্যান্টের ক্ষেত্রে মান্ধাতার আমলের সেই টেকনিক কাজে লাগত না । শহরে অবশ্য ড্রাই ক্লিনিং এর সাইনবোর্ড লাগানো লন্ড্রির দোকান ছিল । সেটাও ছিল বেশ দুরে আর ঈদের আগে ভিড় একটু বেশীই হত । ভাই তাই শর্টকাট ব্যবস্থা নিয়েছিলো । আমাদের গ্রামে ভবেশ দা দের একটা ইস্ত্রি মেশিন ছিল যেটার ফুয়েল ছিল কয়লা । মেশিনে কয়লা ঢুকিয়ে সেগুলোতে আগুন দিয়ে দুপাশ থেকে বাতাস দিয়ে কয়লাগুলোকে টকটকে লাল করলেই রেডি ফর ইস্ত্রি । ” strike while the iron is hot ” মনে হয় সেই আয়রন মেশিনের কল্যানেই সৃষ্ট । কয়লা বানানোর দায়িত্ব পরত আমাদের কাধে । একটু আশা করতাম আমাদের কুচকে যাওয়া শার্টটা যদি ইস্ত্রির চাপ খাওয়ার সুযোগ পায় । ভাই নিরাশ করত না, আমাদের পরিশ্রমের মুল্য দিত । উঠানের ঠিক মাঝখানে আমাদের পড়ার টেবিলটাকে সেট করা হত। মার সদ্য বোনা নকশি কাঁথাকে বিছানো হত টেবিলে। প্যান্টের বেল বটমের জায়গাগুলো প্রেসার একটু বেশী খেত । আমাদের কুচকানো শার্টগুলোর চেহার পাল্টে যেত । হাতের আঙ্গুল পুড়ে ফোসকার দাগ বানিয়ে শার্টের কুচকানো দুর করাই ছিল বড় প্রাপ্য। চোখে মুখে যে কালচে দাগ পরত সেটা ছিল এক্সট্রা পাওনা । আয়রন মেশিনটাকে গরম করা থেকে শুরু করে ঠান্ডা করা পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ চলত ।
এখন যখন ক্যালেন্ডারে পাওয়ার দিয়ে একটু পরেই কাপড়ে লাগাই, চোখের সামনে ভেসে উঠে আনন্দ ও কষ্টের সেই সময়গুলিকে । ভার্সিটি পড়ুয়া ভাতিজা এখনকার ছেলেদের সাথে ওর ছেলেবেলার তুলনা করে দুঃখ প্রকাশ করেছে । বিকালের আকাশে ঈদের চাঁদ দেখার চেয়ে ফেইসবুকেই চাঁদ ওঠার খবর নিতেই ব্যস্ত নাকি এখনকার যুগের ছেলেরা । ওর জন্মের সময় আমি ছিলাম ভার্সিটির ছাত্র। আমার আক্ষেপ একটু বেশী হবারই কথা । না আমার কোন আক্ষেপ নেই । আমার কাছে আমার ছোটবেলার স্মৃতি আমারই । এযুগের ছেলেদের স্মৃতি তাদেরই। আরো কিছুদিন পর হয়ত ব্যক্তিগত খরচে চাঁদ ওঠার খবর নিতে স্পেসে যাবে মানুষজন । শুধু স্পেসে কেন চাঁদেই বসবাস করা শুরু করবে মানুষ । তখন হয়ত এখনকার যুগের ছেলেগুলো আপসোস করবে । উন্নতির লিমিট নেই, শেষ বলে কিছু নেই । ফেইসবুককে চাদ ওঠার খবরের মাধ্যম হিসেবে দেখলে ক্ষতি নাই । ফেইসবুক যখন মানুষকে নির্মমভাবে নিহত করার খবরের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়, তখুনি আৎকে উঠি । ঘৃনা করি তথাকথিত উন্নতিকে। ফিরে পেতে চাই সেই অতীতকে যেখানে ঈদের চাঁদ ওঠার প্রচারের মাধ্যম ছিল গলা। গলা ফাটিয়ে বন্ধুদের শোনাতে চাই ” ঐ দেখ! ঈদের চান্দ উঠেছে! “
(মোঃ মাহবুবর রহমান , তোত্তরি, জাপান)