তামারা’র অন্তর্গত শিলাপাত 

তামারা’র অন্তর্গত শিলাপাত 

তামারার দৃষ্টিতে শূন্যতা। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার চোখ দুটো আলতো সবুজ। সেই সবুজ চোখে কান্নাটা ঠিক শোভা পাচ্ছেনা। তবুও তার বুকের ভিতর জমে থাকা বিষাদের খনি চোখের পানিতে দ্রবীভূত করার খানিক চেষ্টা। সে বসে আছে আমার দোতলা বারান্দায়। এ জায়গাটা তার খুব পছন্দ। এখান থেকে দিগন্ত দেখা যায়। সারি সারি গাড়ি আর আঁকাবাঁকা পীচ ঢালা রাস্তা ছাড়িয়ে ও দুর দিগন্তের পাহাড় আর গাছ-গাছালির নিবিড় সখ্যতা চোখে পরে। আমি চুপ করে তার দুঃখটা অনুভব করার চেষ্টা করলাম। অবশ্য কিছুটা সময়ও দিচ্ছিলাম তাকে। মানুষ অনেকটা পাহাড়ের মতো। কঠিন অবয়বের ভিতরেও সে ভীষণ একা। শূন্য। ঝর্নার জলের মতো চোখের পানিতে যদি কিছুটা দুঃখ ঝরানো যায়, ঝরাক না। ক্ষতি কি তাতে! আমি দু’কাপ চা বানিয়ে আনলাম। তারপর বললাম কি হয়েছে? সে কথা বলতে পারছেনা।। তার জন্য খুব খারাপ লাগছে। তামারার সাথে আজ অনেক বছ্ররের জানা শোনা। তার ছোট মেয়ে কেথি আমার মেয়ের সাথে একই স্কুলে পড়ে। একই রাস্তার উপর আমাদের বাসা। অনেক দিন থেকেই আমাদের পরিচয়, আসা যাওয়া। অনেক সময় কাছাকাছি থাকলেও একে অন্যকে জানা হয়না। অবশ্য প্রতিবেশীদের প্রতি আমার একটু বেশীই দুর্বলতা আছে। নিজ থেকেই কুশল বিনিময় করি। তামারা বয়সে আমার চেয়ে খানিক বড়। ওর বড় মেয়ে ইউনিভার্সিটি পাশ করেছে। বয়েস কি আর বন্ধুতে বাধা হয়? আমি অন্তত তা মনে করিনা। বন্ধুত্ব হয় চিন্তা আর দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্যতায়। অকথিত কথার বিনিময় আর পারস্পরিক হৃদ্যতায়। সেখানে বয়সের হিসেব একেবারেই ঠুনকো।

রাশিয়ার মেয়ে তামারা। ১৫ বছর আগে সে তার ফুফু’র দেখাশোনার দায়িত্বর জন্য কেয়ার-গিবার” হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় আসে। তার ফুফুর তিন ছেলে মেয়ে থাকা সত্ত্বেও তারা তাকে দেখাশুনার দায়িত্ব নিতে চায়না। তাই তামারাকে আনা হয়েছে তাদের মায়ের দেখাশুনার দায়িত্ব নেয়ার জন্য। তামারা সে দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। গত বছর অবশ্য তার ফুফু মারা যাবার পর তার ছেলেমেয়েরা সম্পত্তি নিয়ে ভাগাভাগি করতে গিয়ে তামারাকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছে। সেই থেকে তামারার মধ্যে একটা ক্ষোভ দানা বেঁধে আছে। জীবিত অবস্থায় যারা নিজেদের মায়ের জন্য এতটুকু সময় দেয়ার সময় করতে পারেনি তারাই এখন সম্পত্তি বাটোয়ারার জন্য একে অপরের সাথে নিত্য বৈঠক। ফুফু মারা যাবার পর পরই তামারা মেরিল্যান্ডে একটি ইউনিট কিনে সেখানেই আছে। কিন্তু যতোবারই আমার সাথে দেখা করতে আসে তার সেই ফুফুর বাড়িটার জন্য মনটা হু হু করে উঠে। তাকাতেই পারেনা সেই স্মৃতি জড়ানো, মায়া ভরা বাড়ীটার দিকে।

তামারাকে আমার খুব পছন্দ। তার কারন সে খুবই ঘরোয়া ও সাধারণ। অনেকটা আমারই মতো। আমরা ভিন্ন কালচার থেকে আসা কিন্তু আমাদের মনের অনুভুতি গুলো অভিন্ন।বড়ো অদ্ভুত লাগে। চিন্তা চেতনার মিলনে একই মানুষ বন্ধু আবার অভিন্ন হলে পরস্পর ভয়ানক শত্রু। বড়ই বিচিত্র জগত। ভৌগোলিক, ধর্মীয়, কিংবা ভাষাগত বিভাজন আমাকে তেমন একটা আপ্লুত করেনা। আমি  মানবতায় বিশ্বাসী।  আমি তামারার কান্না উপলব্ধি করতে পারছি। তাকে একটি টিস্যু এগিয়ে দিলাম। বললাম চা টা খাও। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। সে আরেকটু চুপ করে রইলো। তাকে কিছুটা সহজ লাগছে এখন। এটা ভালো। হাসি আনন্দের মতো দুঃখ কষ্ট ও মানবিক আবেগ। এসব সহজ ভাবে নেয়া উচিত। কাঁদলে বিষণ্ণতা কমে যায়। বেশ ঝরঝরে লাগে। এটা স্বতঃসিদ্ধ। আমি সান্তনা দিতে চেষ্টা করলাম, সে বলল ইটস ওকে। এখন আমি কান্নার কারণ কি জিগ্যেস করলাম।

এরপর তামারা বলল তার হাজব্যান্ড এর প্রোস্টেট ক্যান্সার। ব্যাপারটা তার কাছে অবিশ্বাস্য, তাই মেনে নিতে পারছেনা। তামারার ধারনা এ করণে তার হাজব্যান্ড তামারার উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই নিয়ে শঙ্কিত। আমি বললাম এতে শঙ্কিত হবার কি আছে! আমি অতি আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছি। আমার অতি আগ্রহি দৃষ্টিতেই তার শঙ্কা অনেকটা কেটে গেলো। মানুষ গুরত্ত দেয়াটাকে ভালোবাসে। গুরত্তের মাঝে পায় নির্ভরতার আশ্রয়। এই নির্ভরতায় সে নতুন করে উজ্জীবিত হতে পারে। তামারার মধ্যে সেটা লক্ষ্য করলাম। সে এখন অনেকটা স্বাভাবিক। তারপর সে আবারো শুরু করলো। আসল কথা হলো সে তার মেয়েদেরকে সেটা জানাতে চাচ্ছেনা। বড় মেয়েটা হটাত করে মা হবে। তামারা তার জন্য প্রস্তুত নয়। তার মেয়েও প্রস্তুত নয়। কি করবে তাও সিধান্ত নিতে পারছে না। কার কাছে দুঃখ করবে বুঝতেও পারছে না। তার দুঃখ ঝরাবার জন্য মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে। আমি মন দিয়ে তার কথা শুনি। মানুষ বড়ই অসহায়। চারপাশে এতো কিছু তারপরও আসলে সে নিঃস্ব। বিশ্বাস করবার মতো, নির্ভর করবার মতো একটা নিশ্চিত আশ্রয়ের আসলেই খুব দরকার।

তামারার পারিবারিক জীবন খুব করুণ। তার বাবা মাকে এখনো তার ভাইয়ের দেখাশোনা করতে হচ্ছে। এখানে তামারা যে কাজ করে তার থেকে একটা নিয়মিত অংশ তার বাবা মাকে পাঠাতে হয়। তার যে ভাইটি বাবা মা’র সাথে থাকে সে প্রতিবন্ধী তাই কোন কাজ করতে পারেনা। মাঝে মাঝে আমি যখন তার ইউনিটে যাই স্কাইপি-তে তার মার সাথে কথা বলি। তার পরিবারের সবাইকে দেখি। তার মা রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে তামারা সেটা অনুবাদ করে পারস্পারিক কথোপকথনে সাহায্য করে। আমি রাশিয়ান সংস্কৃতির অনেক কিছু জানতে চেষ্টা করি তার মায়ের কাছ থেকে। তামারা আমার কাছে কিছু বাংলা শব্দ ও শিখেছে। বাংলা বলে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের ও তাদের বাবাকে চমকে দেয়ার চেষ্টা করে। আমার কেন জানি স্বদেশী বন্ধুর চেয়ে ভিনদেশী বন্ধুদের অনেক বেশি সহজ মনে হয়। অনেক বেশি নিশ্চিত ও নির্ভরশীল মনে হয়। তামারার  প্রতি আমার এমনই অধিকার, যখন আমার বাড়ি বানানোর জন্য কিছুদিনের জন্য অন্যত্র ভাড়া থাকতে হয়েছিলো আমি তার বাসায় গোছল করার জন্য যেতাম। তার ফ্রিজ খুলে খাবার খেয়ে নিতাম। কিন্তু কোন স্বদেশীয় বন্ধুদের সাথে আজও কোনদিন তা করতে পারিনি। মায়া এক অদ্ভুত ব্যাপার। কেমন করে যে কারো প্রতি মায়া বেড়ে যায় বোঝা মুশকিল। আর সে মায়া লুকানো বড়ই কঠিন।

এখন তামারার হাজব্যান্ড এর চিকিৎসা চলছে। তার মেয়েদেরকে জানায়নি। আমি এর মধ্যে একদিন বাসায় আসতে বললাম, আমার ছেলের জন্মদিনে। ঘরে ঢুকেই ইশারায় বলল কেথি যেন বুঝতে না পারে যে তার বাবা অসুস্থ কিংবা চিকিৎসা করানো হচ্ছে। আমি তাকে নিশ্চিত হবার আশ্বাস দিলাম। বাচ্চাদের উপরে পাঠিয়ে আমরা ড্রয়িং রুমে বসলাম। জানতে চাইলাম কিভাবে ও কি কি উপায়ে চিকিৎসা এগিয়ে যাচ্ছে। একা একা কিভাবে সামলাচ্ছে। তামারাকে অনেক দৃঢ় ও অসীম সাহসী দেখাচ্ছে। আমি এক দৃষ্ঠিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার দুটি মেয়ে, সে মেয়ে দুটি জানেনা যে তার মা কি এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সব কিছু একা একা সামলে নিচ্ছে। আমি তার অদমনীয় মনভাবে বিস্মিত, অভিভূত। সে আমার কাছে অকপটে সব কথা বলে যাচ্ছে। সান্তনা খুঁজছে। নিখাদ বন্ধুত্ব যাকে বলে। একজন মানুষের কাছে এরচে বড়ো প্রাপ্তি কি আছে! মানুষ আসলে মানুষের কাছে এটুকুই বোধ হয় চায়, এটা কি খুব বেশী চাওয়া!

আজ অনেক দিন পর তামারা ফোন করেছে। তার বড় মেয়ের একটি ছেলে হয়েছে। তার নিজের কোন ছেলে না থাকায় নাতি পাওয়াতে সে ভীষণ আনন্দিত। অথচ কিছু দিন আগেও সে বলেছিল এখনি সে নানী হতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়। কি এক অদ্ভুত আনন্দে তার কণ্ঠ দোলায়িত। তার আনন্দ দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। অনর্গল তার নবজাতক নাতির গল্প বলে যাচ্ছে। কেবলই ভূমিষ্ঠ হওয়া একটি শিশু তার সব বিষাদ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো কি এক অনুপম ভালোবাসায়। এভাবেই মানুষ বেঁচে থাকে, সফলতার স্বপ্ন দেখে, সম্ভাবনার বীজ বুনে।

কিছুদিন পর তামারা জানালো তার মেরিল্যান্ডের ইউনিটটা বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। কারন তার হাজব্যান্ড অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারছেনা। তাই ইউনিটটা বিক্রি করে সে একটা ভাড়া বাসায় চলে যাবে। কেননা তার পক্ষে একা বাড়ীর কিস্তি দেয়া সম্ভব হচ্ছনা। তার উপর প্রতিবন্ধী ভাই ও বাবা মা’র জন্য টাকা পাঠাতে হয়। এর মধ্যে বড় মেয়েটি তার ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে সিডনী থেকে বহুদুর বায়রন বে’ চলে গেছে, যে বাচ্চাটি ছিল তার উদ্দীপনার উৎস। তামারার চারপাশে ঘোর অমানিশা। কিছু কিছু মানুষ ভয়ানক মানসিক শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসে, কারো সাধ্য নেই সেই মানসিক শক্তিকে ভেঙ্গে দেয়ার। তামারা তাদেরই একজন। ক্ষণিক দুঃখ বোধে হয়তো খানিক বিচলিত হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু তার বুকের সীমান্তে চুপচাপ বয়ে যাওয়া দুঃখের নদীতে সে ডুবে যায়নি। কিছু ভাংচুর আর তোলপাড় নিয়ে মাঝে মাঝে চলে আসে আমার কাছে। কিছু গল্পকথা, কিছু প্রগলভতা আর রঙিন আশ্বাসে আমি নতুন করে রাঙিয়ে দিই তার ক্ষয়ে যাওয়া মালিন্য। আমি তার পারিবারিক কেউ নই। তবুও তার অন্তর্গত শিলাপাত আর দুঃখের প্লাবন আমাকে আপ্লুত করে। কিছু আশ্বাস আর সান্তনায় ভেঙ্গে যাওয়া তামারা জেগে উঠে নতুন উচ্ছসে। আমার বিশ্বাস, দেনা-পাওনার হিসাব বিহীন একটু ছোট্ট কথোপকথন, ক্লান্ত সময়ে হতে পারে বেঁচে থাকার অদম্য উত্থান……

কাজী সুলতানা শিমি

কাজী সুলতানা শিমি