জাপানে আসার ৯-১০ মাস হয়েছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ সমষ্টি প্রয়োগ করে মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা অর্জন করেছি ততদিনে! সেই শব্দ সমষ্টিকে ব্যাকরণের ভাষায় বাক্য বলে কিনা সেটা বোঝার ক্ষমতা তখনো হয়নি! জাপানী ভাষা শিক্ষার ক্লাসে প্রতিবারই হাত উঠাই শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দিতে । উত্তর সঠিক ছিল না বেঠিক ছিল বোঝার উপায় ছিল না । কেননা প্রশ্নের উত্তরের বিশ্লেষন বোঝার ক্ষমতা তখনো হয়ে ওঠেনি । আমার এই জাপানী ভাষার অতীব গুনটি নজর এড়ায়নি এক জাপানীজ বন্ধুর । একদিন পত্রিকার এক কাটিং এনে সামনে ধরলো। জাপানীজে লেখা ! কানজির ( চায়নিজ ক্যারেকটার ) আগে পিছে হিরাগানা জোড়া লাগানো । জাপানীজ ক্লাসে দুই দিনেই হিরাগানার মাষ্টার বানিয়েছে । খবরে যে সেই হিরাগানা বর্নগুলো আছে সেটা বুঝছি ! হিরাগানা অনেকটা আমাদের বর্ণমালার অ আ ক খ এর মত । কানজিগুলোর মনের ভাব প্রকাশ করতে সাহায্য করে । বলা চলে হিরাগানা গুলি যুক্ত হয়ে কখনো Noun কখনো Pronoun কখনো Verb হয়। আমি একবার পত্রিকার দিকে একবার জাপানীজ বন্ধুর মুখের দিকে রাউন্ডট্রিপ ভ্রমন শুরু করি । অবসর প্রাপ্ত আমার সেই জাপানীজ ইন্জিনিয়ার বন্ধু বুঝতে পেরে সাইন ল্যাংগুয়েজ ও ইংরেজি শব্দখন্ড দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন । যেটুকু বুঝলাম সেটার সারমর্ম হলো একটা কম্পিটিশন হতে যাচ্ছে । যোগ্য শুধু এই এলাকার বসবাসরত বিদেশীরা । দৌড় ঝাপের প্রতিযোগিতা না, জাপানী ভাষায় বক্তৃতা প্রতিযোগিতা । এই জাতীয় প্রতিযোগিতায় এক্সপার্ট না হলেও অভিজ্ঞতা আছে । আব্বার লিখিত বক্তৃতা মুখস্থ করে অনেকবার স্টেজে উঠে কোকিল কন্ঠে থুক্কু পুরুষ হাঁসের কন্ঠে ভাষন দিয়ে পুরস্কার ও ছিনিয়ে এনেছিলাম যতদুর মনে পরে । হাঁসের ফ্যাসফ্যাসা আওয়াজের মত হলো আমার গলার আওয়াজ । সামনা সামনি থেকে কথা বললে বুঝা যায় আমি পুরুষ মানুষ । টেলিফোনের মত ইথার নির্ভর যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে প্রতিপক্ষের সমস্যা হয় আমার জেন্ডার নিয়ে । বাংলাদেশে টেলিফোনের ব্যবহার না করায় সেটা বুঝতে পারিনি । এদেশে টেলিফোনের রিসিভার উঠিয়ে মসিমসি ( হ্যালোর অনুরুপ জাপানীজ) বললেই , বাসার ঠি কানা ও মালিকের নাম কনফার্ম করে বলে ‘ দাননা সামা ওনেগাইশিমাছু’ । যেটার অর্থ হলো হাজবেন্ড কে ডেকে দাও । এরমক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় অনেকবার পরেছি । শুধু জাপানীরা না এক সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বান্ধবীরাও দোটানায় ভূগে আমার কন্ঠ শুনে । কিছুদিন আগে আমেরিকা থেকে মোনা ফোন করেই বলে উঠল কে আখি ( আখি আমার গিন্নীর নাম ) ! রিসিভার নিয়ে তখন আধাপাকা দাড়িওয়ালা আমি । মোনা তো গলার চিকিৎসা করার উপদেশ দিয়েছিল সেদিন । এই বয়সে এসে গলাকে কোকিল কন্ঠি বানানোর ইচ্ছে নেই !
এই গলা দিয়েই ছিনিয়ে এনেছিলাম অনেক পুরষ্কার । এবার ছিনিয়ে নিব আন্তর্জাতিক পুরষ্কার । মনে মনে পুলকিত হয়ে অংশগ্রহনে সায় দিয়েছিলাম । ছোটবেলা বাপের সাহিত্য দিয়ে কাজ চালিয়েছি । বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টেজের ধারে কাছে না থেকে শ্রোতা ছিলাম । এবার কে লিখে দিবে আমার জ্বালাময়ি বক্তৃমা ! আব্বা তো উপর থেকে মুচকি হাসছেন । যাই হোক লাইব্রেরি ঘুরে, জাপানী কালচারের ইংরেজি বই ধার করে, বাংলাদেশের কালচারের সাথে জাপানিজ কালচারের তুলনা করে ইংরেজিতে লিখলাম দেড় দু পাতার রচনা । রসকসের র ও ছিলনা সে বক্তৃতায় ।
জাপানীজ বন্ধু সেটা কোথা থেকে যেন ট্রেন্সলেট করে দিলেন । শুরু হল মুখস্থ করার প্রক্রিয়া । জাপানীজ বন্ধু রীড করে আমি বাংলায় টুকলিফাই করি । গলার স্বর কোথায় উচু হবে কোথায় আদ্র হবে কিছুই জানি না । রসকস আনতে জাপানিজ বন্ধুটি আবার কিছু অংশ মডিফাই করলেন । জাপানীজ জাতিটা রোবোটিক হলেও এরা প্রানখুলে হাসে হাসির খোরাক পেলে !সেটা বুঝতে পেরেই এনেছিলেন এই মডিফিকেশন । ওয়ার্কিং ডে গুলোতে রিহার্সেল চলে রাতে আর শনি রবিবার গাড়িতে । উনি ড্রাইভার আর আমি পাশের সীটে বক্তৃতা পাঠক । পুরাদমে চলছিল আমার বক্তৃতা মুখস্থ প্রক্রিয়া । অবশেষে হৃদয়ঙ্গম করলাম লেকচার । উপস্থাপনের দিন আসলো ঘনিয়ে ।
কম্পিটিশনের দিনে গিন্নী সাজলো নীল শাড়ীতে নতুন বৌ আর আমাকে বানালো সুটেড বুটেডে বিলেতি ভদ্ররনোক ! ফুরফুরা মেজাজে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়ে চক্ষু চড়কগাছ । গড়গড় করে জাপানীজ বলা চাইনীজ বান্ধবী ও থাইল্যান্ডের বন্ধুরা বুকে বড় বড় ফুল লাগিয়ে ঘুড়ছে। বুকে ফুল লাগানো মানে কম্পিটিশনের প্রতিযোগি । প্রথম পুরষ্কার, ১০ হাজার ইয়েন ব্যবহারের লিস্টটা হৃদয়ের ভিতরেই টুকরা টুকরা করলাম ! মনে মনে ইস্তফা দেবার কথাও ভেবেছিলাম । জাপানীজ বন্ধু ও গিন্নীর হাস্যোজ্জল মুখ দেখে বুকে পাথর চেপেছিলাম !
শুরু হলো প্রতিযোগিতা । হাততালিতে কৃপনতা দেখায় না জাপানী জাতিটা । কমবেশী সব প্রতিযোগিদের হাততালি দিয়েই খুশি করেছিল । বিচারকের আসনে প্রফেসর, টেলিভিশনের অ্যানাউন্সারদের অভিব্যক্তিতে কোন পরিবর্তন দেখলাম না । ওনারা হাসেও না কাদেও না । বক্তৃতা শেষ হতেই শুরু হয়েছিল ফলাফল ঘোষনা ও পুরষ্কার বিতরন ।
জাপানী জাতিটার বৈশিষ্ট্য হলো কাউকে নিরাশ করে না । চ্যাম্পিয়ান , রানারআপ ও তৃতীয় স্থানের বাহিরেও অনেকগুলো পুরষ্কারের ব্যবস্থা রাখবেই । এই যেমন আর্টিসটিক, হাস্যকর, স্পেশাল ইত্যাদি । কম্পিটিশন শেষে দেখা গেল প্রায় সবারই হাতে একখানা করে সার্টিফিকেট । আমিও যোগাড় করলাম একখানা । চ্যাম্পিয়ান ও রানারআপের পজিসন এজ এক্সপেকটেড । চাইনিজদের নিকট থেকে চ্যাম্পিয়নের ঝান্ডা অন্য কোন বিদেশী ছিনিয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে আমাদের চোখে পরে নাই ! চ্যাম্পিয়নের প্রাইজমানির টাকাটা পেলে পেটপুজা করার প্লান ছিল । চপস্টিক দিয়ে পেট ভরানোর সুযোগ যে সেদিন হয় নাই তা নয় । প্রাইজমানি না পেলেও জাপানিজ বন্ধুটা কিন্তু ব্যবস্থা নিয়েছিল চপস্টিক্স ব্যবহারের!
আজ এতদিন পরে, রোজা রমজানের দিনে, ইফতারের আগে, পেটে রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে, স্ত্মৃতির ভেলায় ভাসি। আমি চপস্টিক্সের ব্যবহার কিছুটা রপ্ত করলেও গিন্নি সেদিন সাহায্য নিয়েছিল ফর্ক ও চামচের ! এখন দুজনেই চপস্টিক্স চালাতে শিখেছি । ওয়েটারদের আর বিরক্ত করি না । কিন্তু সেদিনের সেই বাংলাদেশী ইউরোপিয়ান ও জাপানিজ কালচারের সংমিশ্রণ খাদ্যভক্ষন এখনো মনে পরে …
আরো পড়ুন :