জাপানে সময়টা যে কোন দিক দিয়ে চলে যায় সেটা টের পাওয়া মুশকিল । দুমাস যে কবে পার হয়েছে টের পায়নি । দুএকটা জাপানীজ শব্দ মুখ থেকে বের হয় । নিজ থেকে এগিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি । ঘর থেকে বের হলেই দেখতাম, পাশের বাসার বয়স্ক লোকজন বাড়ীর সামনের অংশ পরিস্কার করছেন । ময়লা বেশী নাই তার পরেও কাজে ব্যস্ত । যুবক কিংবা মধ্য বয়সের ব্যস্ত লাইফটা রক্তের সাথে মিশে গেছে । তাই ঘরের সামনে পরে থাকা সিগারেটের মোথাটাকেও সরতে ব্যস্ত ওনারা । অবসর জীবনের অফুরন্ত সময়টাকে এভাবেই ব্যস্ত করে রাখেন । শখ বিষয়ে রচনা ভুরি ভুরি পরেছি । জাপানের বৃদ্ধদের কাছে দেখলাম শখ কি জিনিস! কোমর বেঁকে যাওয়া সিনিয়র মহিলাদেরকে যখন ঘাসফুলের ছবি নিতে ক্যামেরার লেন্সকে পরিষ্কার করতে দেখি, তখন শখের আসল অর্থটা স্বচ্ছ হয় ।
জাপানীজ শিক্ষক শুভ সকাল ও ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জাপানীজ শিখিয়েছেন । শিক্ষক ও সহপাঠীদর সাথে প্র্যাকটিস করেছি অনেক । সত্যিকারের ব্যবহারের সুযোগ মিস করতে চাইতাম না । সকালের শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই মোক্ষম সুযোগটা কাজে লাগানোর জন্যই, উচ্চ স্বরে শুভেচ্ছা বিনিময় করতাম । কতেকদিন অপর পক্ষের উত্তর আসত, কতেকদিন আসত না । ব্যাপার কি? উত্তর না পাওয়ার দিনগুলোতে প্রতিপক্ষকে একটু চিন্তিত দেখাতো । প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলি যে ওনার মাথার চতুর্দিকে ঘুরপাক খেত সেটা বুঝতে সময় লাগতো না । ওহাইও গোজাইমাস ( শুভ সকাল ) এর জায়গায় আরিগাতো গোজাইমাস ( ধন্যবাদ ) প্রয়োগ হওয়াতে এই ঝামেলায় পরতে হত । নিজের ভুল বুঝতে পেরে,শুভেচ্ছার প্রতিউত্তরের চেয়ে কেটে পরাই শ্রেয় মন করতাম । এরকম ভুল শুধু যে আমিই করেছি তা নয় । আমার মত অনেক বিদেশীই একই পথের পথিক ছিলেন ।
সহধর্মীনীকে জাপানে আনার ব্যবস্থা করতে দৌড়াদৌড়ি ভালই করেছি । সাথে ভায়রা ভাইকে ব্যস্ত রেখেছিলাম । কাগজপত্র সংগ্রহে সাইকেল অনেক চালিয়েছি । সিটি অফিস, ইমিগ্রেশন অফিসে যেতে হয়েছে দুতিনবার । নিরাশ করেননি ওনারা । টেলিফোনে যোগাযোগের ঝামেলার অবসান শেষ পর্যন্ত হতে চলল ! টেলিফোন ঝামেলা সেটা আবার কি জিনিস ? সেই সময়ের কথা চিন্তা করলে এখনো আশ্চর্য হতে হয় । এখানকার মত তখন তো নেটের যুগ ছিল না । মুঠোফোন কথাটাও তখন ডিকশনারীতে ছিল কিনা সন্দেহের ব্যাপার । জাপানে ওটা থাকলেও আমাদের নাগালের বাইরে । ল্যান্ড ফোনই একমাত্র সম্বল । শীতের রাতে কাপতে কাপতে কয়েন বক্স থেকে কথোপকথন হতো । উনি মানে সহধর্মীনী থাকতেন দিনাজপুর এ । উনি দিনাজপুর কলেজে প্রানি বিদ্যা পড়ান আর আমি এখানে বয়স্ক জাপানীজ শিক্ষিকার কাছে জাপানীজ ভাষা শিখি । শনিবার রবিবার আসলেই ব্যস্ত হতাম যোগাযোগ করতে । সরাসরি যোগাযোগ হত না । ওর হল লাইফের বান্ধবী পলির বাসার টেলিফোনটা সার্ভিস দিয়েছে অনেকদিন ।
আমার একাকিত্বের অবসান হওয়ার দিনটি ঘনিয়ে আসল । গিন্নী আসছে! স্বার্থপর মানুষের মত মনে হল আর রান্নাবান্না করা লাগবে না । বিদেশ বিভুয়ে এটা যে একটা যৌথ প্রসেস সেটা বেমালুম ভুলে গেলাম । হল লাইফে নিজের খাবারের থালাখানা পরিষ্কার করলেও বাড়ি কিংবা বাসার জীবন করিনি কখনো । এখানে এসে দেখলাম থালা বাসন ঘষামাজার কাজটা পুরুষরাই বেশী করে ।
জাপানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত কোন সন্দেহ নাই । ফোন করলে দশ মিনিটেই ট্যাক্সি হাজির হবে । সমস্যা হলো ট্যাক্সিটা ডাকা ! জাপানে বেশি দিন হয় নাই, তাই ভাড়ার অ্যামাউন্টটাও একটু বেশি মনে হতো। সবকিছুকে ছাপিয়ে মেইন সমস্যা ছিল ভাষা । আমার জাপানীজ ও ইংরেজী দুটোই বোধগম্য হতো না জাপানীজ ট্যাক্সি চালকদের কাছে । তাই বাধ্য হয়েই এক জাপানিজ বন্ধুকে বলেছিলাম জাহাজঘাটে পৌঁছে দিতে । সময়টা ছিল ভোররাত । মধ্যরাতে উঠে কয়েনবক্স থেকে সেই জাপানীজকে বিরক্ত করার কথা মনে করলে এখনো হাসি ও লজ্জা দুটোই ভর করে । ঢাকা এয়ারপোর্টে কর্মরত বন্ধু লিকুকে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম যে কানসাই এয়ারপোর্টে পৌছানোয় আমার দেরি হতে পারে । ম্যাসেজ গিন্নীর নিকট পৌছেছে তবে লিকু কর্তৃক ভাষান্তরিত হয়ে । হাসি, টেনশন , আনন্দ সবকিছুই স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে । বিরহ দুই মাসের অথচ মনে হয়েছিল যেন দুই যুগ । সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দেখা হলো আমাদের জাপান নামক ভিন দেশে ! বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসরের তদারকি, ঘরে লেকচারার গিন্নীর পুরোপুরি খবরদারি ! শুরু হলো আমাদের ভিন দেশের সংসার ..
জাপানে লাইফটা ছকে বাধা । ল্যাব, বাসা, বাজার, একটু ঘুরতে বেড়ানো এই আর কি! রবিবারে কি করব ? শনিবার কোন শপিং মল এ যাবে এ জাতীয় চিন্তা ভাবনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে সবাই । অনেকের শখ হয় ক্যারাতে শেখার , নিজে জুডোতে ভয় পেলেও ছেলেকে পাঠায় জুডো শিখতে। আমরা কপোত কপোতি ঘুরতে বেড়াই শপিং মল এ কিংবা সমুদ্রের ধারে ।
গিন্নীর সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা আছে তবে সময়ের কারনে অভিজ্ঞতায় কিছুটা মরিচা ধরেছিল । ছোটবেলায় নাকি শ্বশুর আব্বাকে সাইকেল চালানো দেখাতে যেয়ে রাস্তার পাশেই উল্টে পরেছিল! সাইকেল সে চালাতে পারে তবে সমস্যা হল, সাইকেল চালানো শুরু ও চালানো শেষে সাইকেলকে থামানোর কাজটা করতে হচ্ছিল অন্যদের সাহায্য নিয়ে । আসলেই গোঁড়াতেই গলদ ছিল! সেই গলদ দুর করতে সহধর্মীনীর সাইকেল চালনোর ট্রেনিং চলল পুরাদমে । ছোট আপা মেইন ইন্সট্রাকটর আর আমি হেলপার । বাচ্চাদের সাইকেল চালানো শেখানোর সব টেকনিক প্রয়োগ করি । সাইকেল চালানো যতদিন শেখেনি আমার সাইকেলের পিছনে ওকে নিয়ে আমি মার্কেটে যাই ।
নববর্ষের বন্ধে একদিন ইচ্ছে হল সমুদ্র দেখতে যাব । জাপানে নববর্ষ মানেই বাংলাদেশের ঈদের মত । ঈদে ঢাকার রাস্তাঘাটের মত শহরগুলো ফাকা হয়ে যায়, গাড়ীর ভিড় হয় হাইওয়েগুলোতে । ছোট ছোট রাস্তাগুলো ফাকাই থাকে । ডাবলিং করে সাইকেল চালানো নিষেধ জানা স্বত্বেও ড্যামকেয়ার ভাব । সমুদ্র বাসা থেকে বেশ দুরেই । কিলোমিটারে ১০ এর বেশী হবে । যেন তেন সমুদ্র না! প্রশান্ত মহাসাগর । স্কুল জীবনে নামটা শুনলেই শরীরে কাটা দিত! সেই প্রশান্ত মহাসাগর । গিন্নি সেজেছে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা সবচেয়ে দামি লম্বা পোশাকে। প্রশান্ত মহাসাগরের নীল পানি নিজের হাত দিয়ে ছুয়ে দেখবো ! ভাবতেই ভাল লাগে । ওকে পিছনে বসিয়ে যাত্রা শুরু করলাম । সে গাইছে এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো ! আমি মাঝে মাঝে গানের মাধ্যমে করা প্রশ্নের জবাব দেই । তবে বেশীর ভাগ সময় ডিসেম্বরের শীতেও কপালে জমা ঘাম হাত দিয়ে সরানোয় ব্যস্ত থাকি । ভালই চলছিল আমাদের সিনেমার মত ইমেজিনারি শুটিং । সমুদ্রের নীল পানিকেও দেখছিলাম একটু দুরে । হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পেলাম গিন্নীর মুখ থেকে। আমাদের গাওয়া গানের তালে তালে জামার কাপড় ও সাইকেলের চাকার কখন যে মিতালি ঘটেছে টের পাইনি । মিতালী শেষে ঝগড়া বাধিয়ে আমাদের জানান দিয়েছে । সে যাত্রায় বেচে গিয়েছিলাম দুজনই । ক্ষতিটা শুধু দামি জামাটার নিচের অংশটুকুর উপর দিয়েই গিয়েছে । যতদিন ঐ ঘটনার কথা মনে করেছি ততদিনই গিন্নির মুখ থেকে একটা হাহাকার শুনতে হয়েছে আমাকে । আর সেটা হল আমার এত সুন্দর দামী জামাটা একদিনের বেশী পরতে পারলাম না! আজ এতদিন পরেও সেই দুর্ঘটনার কথা মনে করে শিহরে উঠি । পুলিশ মামুরাও যে পাসপোর্ট দেখতে চায়নি সেজন্য শুকরিয়া আদাই করি ।
আরো পড়ুন :