অনলাইন ডেস্ক: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) একটি দোতলা বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর। বরাবরের মতো সেদিনও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কক্ষের দরজা একটু খোলা। উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী অভ্যাসবশে ডান হাতের আঙ্গুল কামড়াচ্ছেন। আনুমানিক সকাল ১০টায় তাজউদ্দীন আহমদের বিশেষ ফোনটি বেজে উঠল। ওই ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছাড়া ফোন করতে পারেন না। কী কথা হলো বোঝা গেল না। কিন্তু ফোন রেখে, চোখেমুখে সব পাওয়ার আনন্দ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ‘সবাইকে জানিয়ে দাও, আজ আমরা স্বাধীন। বিকেল চারটায় আত্মসমর্পণ।’
আজ সেই গৌরবের ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয়ের দিন। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জনের দিন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর লাখো প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসার সাথে স্মরণ করবে সেইসব শহীদদের; যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা।
বিজয়ের ৪৪ বছর পূর্ণ হল আজ। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। আজ প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহান বিজয় দিবসের সূচনা হবে। আজ সরকারি ছুটির দিন। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে নামবে জনতার ঢল। বিভিন্ন ভবনের ছাদে উড়বে গৌরবের জাতীয় পতাকা। এছাড়া যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এসময় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর আমন্ত্রিত সদস্যবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে তেজগাঁওয়ে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্যারেডে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে গণভবনে স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করবেন প্রধানমন্ত্রী। বিকালে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মিলিত হবেন। এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীও উপস্থিত থাকবেন।
দিবসটি উপলক্ষে জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে আজ মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রমসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং রাতে আলোকসজ্জা করা হবে। প্রধান প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপসমূহ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করা হবে।
এবার অন্যরকম গৌরব নিয়ে দেশবাসী বিজয় দিবস পালন করছে। কারণ দীর্ঘ ৪৪ বছর পর সম্প্রতি দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। তাই এবার স্বস্তি ও প্রশান্তি নিয়ে দেশবাসী বিজয় দিবস পালন করবে। অবশ্য ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে জাতির দায়মুক্তির সূচনা হয়েছিল।
যেভাবে বিজয় এলো : ব্রিটিশদের বিদায়ের পর নতুন রূপে বাঙালি জাতির ওপর শোষক হিসেবে আবির্ভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শ্রেণি। যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ একদিন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে আন্দোলন করে একটি মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল; সেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকেই আবার অস্ত্র ধরতে হল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তাদের হঠকারিতা, অদূরদর্শিতা এবং অবিমৃশ্যকারীতার কারণে দু্’অঞ্চলের মধ্যে তৈরি হয় ভেদ রেখা এবং বৈষম্যের বেড়াজাল। পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা আর অবহেলা চরম আকার ধারণ করলে প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হতে থাকে এ অঞ্চল। কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে বুটের তলায় তা পিষ্ট করার নীতি গ্রহণ করে তারা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে তারা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভকারী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলে না দিতে টালবাহানা শুরু করে শাসক গোষ্ঠী। ফলে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান। এক পর্যায়ে একাত্তরের ৭ মার্চ তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু দেন তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম।’ ঢাকা যখন এমন অগ্নিগর্ভ, তখন পাকিস্তানি শাসকচক্র আমাদের মুক্তির স্পৃহাকে দমনের পথ বেছে নেয়। রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার মাধ্যমে জন্ম হয় ২৫ মার্চের কালরাতের। এরপরই চূড়ান্ত হয়ে যায় আমাদের পৃথক পথচলা। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় চূড়ান্ত মুক্তির লড়াই। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিসংগ্রামের পর পরাজয় মেনে নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের ৯১ হাজার ৪৯৮ জন নিয়মিত, অনিয়মিত এবং আধা সামরিক সৈন্য নিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরার কাছে। শুরু হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পথচলা।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি: বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের গৃহীত দুই দিনের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, দলের সকল কার্যালয় ও বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, সকাল ৮টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, সকাল সাড়ে ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত শিখা চিরন্তনে আত্মসমর্পণের সময় বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে বিজয় মিছিল এবং আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জেপি’র বিবৃতি ও কর্মসূচি:জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম ৪৪তম বিজয় দিবস উপলক্ষে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিজয়ের এ বার্ষিকীতে আমাদের নতুন করে শপথ গ্রহণ করতে হবে দেশকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও পশ্চাত্পদ চিন্তা থেকে মুক্ত করার জন্য। নেতৃদ্বয় বলেন, আমরা আজকের এই বিজয়ের দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ যারা আমাদের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছিলেন, তাদের সকলের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।
দিবসটি উপলক্ষে আজ জাতীয় পার্টির (জেপি) সকল কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৮টায় সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। এছাড়া বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি কনফারেন্স হলে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় পার্টি (এ), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সিপিবি, সাম্যবাদী দল, গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। (সুত্রঃ ইত্তেফাক )