ক্ষুধার পেটে যদি কাছাকাছি কোথাও থেকে মুরগীর ঝোল আর গরম ভাতের গন্ধ ভেসে আসে, তবে ক্ষুধার চিনচিনে ব্যাথারা উত্তেজিত হয় এবং পাকস্থলির বন্দী দেয়ালে আরও কষে আঘাত হানে। ১৯৮৪ সালের এরকম একটা মুরগীর ঝোল আর গরম ভাতের গন্ধের কথা মনে হলে আমার এখনও গা গুলিয়ে আসে। পাকস্থলী টুইটুম্বুর থাকলেও কেমন একটা চিনচিনে ব্যাথা টের পাই।
মাস মনে নেই। ঝমঝম বৃষ্টির কথা মনে আছে। কার্জন হল এলাকার শহিদুল্লাহ হলের দশাসই সাইজের জানালা পথে নাম না জানা গাছের ওপর ঝমঝম বৃষ্টির দৃশ্য এবং খোলা জানালা দিয়ে আসা বষ্টির ছাঁটের কথা মনে আছে। এপ্রিল মে হবে হয়তো। মামা যাচ্ছেন সুইডেনে। মোটামুটি স্থায়ী ভাবেই। শহিদুল্লাহ হলের ২০৬ নম্বর রুমের বাসিন্দা আমার ছোট মামা, মে।হন মামা। সয়েল সায়েন্স থেকে স্নাতক শেষ করে রাজনীতির কারণে দেশ ছাড়ছেন। আমি মামার স্নেহধন্য ভগ্নিপুত্র। ক্যাডেট কলেজে নবম শ্রেণির ছাত্র। কি জানি কি অজানা কারণে মামা দেশত্যাগের সময়টাতে আমাকে কাছে এনে রাখলেন।
ভোর বেলা টাঙ্গাইল থেকে এসে পরোটা-সুজি নাস্তা করেছি, শহিদুল্লাহ হলের ক্যান্টিন থেকে আনানো নাস্তা। গরম গরম পরোটা এবং নরম-গরম মিষ্টি সুজি। মামা কোথাও বাইরে গেলো। আমি রুমে একা। ছাত্রাবাস আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবে শহিদুল্লাহ হলের এ রুমটি ইতিহাস ইতিহাস গন্ধে ভরা- উঁচু ছাদ, বিশাল বিশাল গরাদের জানালা, উচু ভারি দরোজা। সিঙ্গেল রুম। একা একা আমি কি করি। এদিক ওদিক তাকিয়ে ঈদ সংখ্যা বিচিত্রা পেয়ে গেলাম। বাইরে কচু পাতায় টলোমলো বৃষ্টির পানি- জানালায় বৃষ্টির ছাঁট। আমি ইমদাদুল হক মিলন দিয়ে শুরু করলাম। পড়তে শুরু করলে আমি চারপাশ ভুলে যাই- সময় ভুলে যাই- বর্তমান ভুলে যাই। বুঁদ হয়ে ভ্রমন করি অক্ষর থেকে অক্ষরে, শব্দ থেকে শব্দে, বাক্য এবং পাতা পেড়িয়ে, লেখকের কল্পনার পথ ধরে এগিয়ে যাই। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। পড়তে পড়তে চোখ টনটন করছে। ক্লান্ত চোখ আর গল্পের নায়িকার লেখা প্রেমপত্রের পরবর্তী বাক্য পড়ার তৃষ্ণা ধরে রাখতে পারছি না। কারণ আমার তখন ক্ষুধা লেগেছে খুব।
ক্ষুধা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো গরম মসল্লার রসালো গন্ধের সাথে মুরগীর মাংশের গন্ধ মেশানো ঝোল ঝোল তরকারী এবং সাদা আতপ চালের বলক তোলা ভাতের সুগন্ধের কারণে। পাশের রুমে রান্না হচ্ছে। মামার বন্ধু হয়তো বা। পকেটে টাকাও নেই যে বাইরে কোথাও খেয়ে আসবো। মুরগীর ঝোল আর গরম ভাতের সুগন্ধে বন্দী হয়ে থাকলাম আরো অনেকক্ষণ।
আরো একবার মুরগীর ঝোল আর গরম ভাতের সুগন্ধের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিলো। ততদিনে আমি আংকারা প্রবাসী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ছাত্র এদিক ওদিক বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। সময়টা সামার ভ্যাকেশন। পরিচিত বাংলাদেশি অধিকাংশই ইংল্যান্ডে চলে গেছে তিন মাস কাজ করে পয়সা কামাবে বলে। কি এক কারণে আমার যেতে দেরি হচ্ছে। বন্ধু মুরাদের বাবা বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর। এই সূত্রে মুরাদ বাবা মায়ের সাথে অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে। আমরা থাকি সস্তা বাড়িতে ব্যাচেলার মেস এর মতো করে। মুরাদের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারনে মাঝে মাঝে ওর বাসায় যাই। ওর স্নেহবৎসল বাবা মা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। মাঝে মাঝে ওর বাসায় খাওয়া দাওয়াও করা হয়। তবে আমি খানিকটা লজ্জা পাই। মাঝে মাঝে খালাম্মার খাওয়ানোর প্রস্তাব খুব ভদ্রভাবেই প্রত্যাখ্যান করি।
একদিন হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার কাছে কোন টাকা নেই। ইংল্যান্ডে যাবো কয়েকদিনের মধ্যে। সুইডেনবাসী ছোট মামাকে জানালাম। মামা কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলেন। শনি রবিবারের ঝামেলার কারণে টাকা পেতে দেরি হলো। বাসায় কোন চাল, ডাল, তেল কিচ্ছু নেই। ফ্রিজও খালি। বন্ধুরা সবাই ইংল্যান্ডে। কি করি! হেঁটে হেঁটে মুরাদের বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। বাস ভাড়ার টাকাও নেই। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ। কয়েক কিলোমিটার হেঁটে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে তবে মুরাদের বাসা। মুরাদ বাসায়ই ছিল। ওর রুমে বসে গান শুনছি, গল্প-টল্প করছি। রান্না ঘর থেকে ভেসে আসছে মশলাদার মুরগীর ঝোল আর বাসমতি চালের সুগন্ধী গরম ভাতের আকর্ষণীয় গন্ধ। আমি সকাল থেকে কিছু্ই খাইনি। মুরাদের স্টেরিওতে বাজছে বব মার্লির থ্রি লিটল বার্ড। কিছুক্ষণ পর খালাম্মা এসে দরজায় কড়া নাড়লেন। মুরাদ দরজা খুলে দিতেই খালাম্মা বললেন, রিশা, তোমাকে খেতে বললে তুমি কখনই খাও না। আজ তোমাকে খেতে বলবো না। আমি মুচকি হাসলাম। ভাবলাম বলি, না খালাম্মা, আজকে আপনি না বললেও আমি জোর করেই খাবো। কিন্তু কিছুই বলা হলো না। আবারও পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ক্ষুধার্ত পেটে মুরগীর ঝোল আর গরম ভাতের গন্ধের স্মৃতি নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
(ইমতিয়াজ কায়েছ রিশা , সিডনি থেকে )