কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারের মতো গত সাড়ে তিন বছরে ‘রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ’ বা ‘অপহরণের’ পর পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন কমপক্ষে ২৭ জন। এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে কিছু অভিন্ন ছক বা মিল লক্ষ করা যায়। অপহৃত ব্যক্তিদের একটি বড় অংশকে অপহরণের পর ‘উদ্ভ্রান্ত’ অবস্থায় কোনো সড়কে পাওয়া যায়। কিন্তু ফিরে আসার পর অনেকে কোনো কথা মনে করতে পারেন না। বাকিরা মুখে কুলুপ আঁটেন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে ২০১৪ সাল থেকে জুন ২০১৭ পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন। তাঁদের মধ্যে মৃতদেহ উদ্ধার হয় ৪৪ জনের, পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে ফিরে আসেন ২৭ জন। বাকি ১৭৭ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা কখনো কখনো গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফিরে আসার পর নিখোঁজ ব্যক্তিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলেছেন, চোখ বেঁধে তাঁদের মাইক্রোবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর বাইরে তাঁরা কেউ আর বিস্তারিত কিছু বলেননি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ কিন্তু সরাসরি বলে না ডিবি বা র্যাব তুলে নিয়ে গেছে। তারা বলে ডিবি বা র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে। আমরা নিয়মিত এমন ভুয়া ডিবি ও র্যাব গ্রেপ্তার করছি। এত নিখোঁজ উদ্ধারের পরও যখন আমাদের নামে অভিযোগ ওঠে, তখন তো আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।’
তিনি বলেন, কখনো কখনো বড় বড় অপরাধীরা গা ঢাকা দেন ও পরিবার অভিযোগ করে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে।
১৮ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর কবি ফরহাদ মজহার গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগকে বলেছেন, শ্যামলীতে তাঁর বাসার সামনে থেকে তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল। এরপর আর কিছু তিনি জানেন না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণ বা রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর ফিরে আসার একটি ঘটনারও সুরাহা হয়েছে বলে জানা যায়নি। কারও কোনো শাস্তিও হয়নি। ফলে এটা নিয়ে জনমনে, বিশেষ করে সরকারের সমালোচকদের মনে আতঙ্ক দিন দিন বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটেই এ ধরনের অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের সম্মুখীন করা অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা সুদৃঢ় করার জন্য সরকারের উচিত ব্যবস্থা নেওয়া।
নিখোঁজ ও উদ্ধারের একই ছক
গত সাড়ে তিন বছরে নিখোঁজ অবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন এমন কমপক্ষে এক ডজন ব্যক্তিকে নিয়ে গণমাধ্যম সরগরম ছিল। তাঁদের নিখোঁজ থাকার সময়কাল সর্বনিম্ন ১৮ ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত মাস পর্যন্ত।
১৬ এপ্রিল, ২০১৪ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন। ৩৪ ঘণ্টা পর তাঁকে চোখবাঁধা অবস্থায় কে বা কারা মিরপুরে নামিয়ে দিয়ে যায়। তাঁর পকেটে তিন শ টাকাও গুঁজে দেয় অপহরণকারীরা। তিনি চোখের বাঁধন খুলে প্রথমে রিকশায় করে মিরপুর ১০ নম্বরে, পরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ধানমন্ডিতে যান। ধানমন্ডি কলাবাগান খেলার মাঠের পাশে স্টাফ কোয়ার্টারের কোনায় বসানো পুলিশ চেকপোস্ট তাঁকে আটকায়। পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে থানায় নিয়ে যায়।
আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় ফতুল্লা থানায় মামলা করেন তাঁর স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তবে ওই মামলার আর কোনো অগ্রগতি নেই।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বনানীতে তাঁদের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে সাদাপোশাকে থাকা পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন তাঁর স্ত্রী মেহের নিগার। পুলিশ সে সময় এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ২১ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর তাঁকে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
১০ মার্চ ২০১৫ সালে উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ ৬২ দিন পর ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে উদ্ধার হন। ১২ মে তিনি মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল থেকে তাঁর স্ত্রী হাসিনা খানকে ফোন করেন। ভারতীয় পুলিশের বরাতে বলা হয়, মেঘালয়ের গলফ গ্রিন এলাকায় ঘোরাঘুরির সময় পুলিশ তাঁকে আটক করে। সে সময় তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছিল।
সালাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি নিজে ভারতে আসেননি। যারা তাঁকে অপহরণ করেছিল, তারাই তাঁকে ভারতে রেখে গেছে। তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে চাননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন তানভীর আহমেদ। ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ দিবাগত রাতে তিনি নিখোঁজ হন। পাঁচ দিন পর তাঁকে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় বিমানবন্দর সড়কে হাঁটতে দেখে পুলিশ বাড়ি পৌঁছে দেয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী পুরান ঢাকার আদালতপাড়া থেকে নিখোঁজ হন গত বছরের ৪ আগস্ট। প্রায় সাত মাস অজ্ঞাত স্থানে থাকার পর তিনি বাড়ি ফেরেন।
গত বছরের ১৫ অক্টোবর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে, ৩০ নভেম্বর পাবনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী তানভির আহমেদ রংপুর থেকে পাবনা আসার পথে, ১ ডিসেম্বর তানভিরের বন্ধু ও একই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন পাবনার কলেজ ক্যাম্পাস থেকে এবং বরিশালের চাকরিপ্রার্থী তরুণ মেহেদী হাসান হাওলাদার বনানী থেকে, ৬ ডিসেম্বর ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় রাকিবুল ইসলাম রকি লক্ষ্মীপুর থেকে নিখোঁজ হন। তাঁরা সবাই পরে ফিরে আসেন।
চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদের বাবা নুরুল আলম, পাবনা মেডিকেল কলেজের দুই শিক্ষার্থীর বাবা সুরুজ্জামান ও নুরুল আলম সরকার বলেন, সন্তান ফিরে আসাতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। তাঁরা এ নিয়ে আর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করতে চান না।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘একজন অপহরণ বা নিখোঁজ হওয়ার নির্দিষ্ট সময় পর যদি রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে না পারে, তখন সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আমার মনে হয় নিরাপত্তা কাঠামোয় ব্যবস্থাগত ত্রুটি আছে। পুরো কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে সমাজ ও রাষ্ট্রের এখন উদ্যোগ নেওয়া অত্যাবশ্যক।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, পুলিশ যুক্তিসংগত কারণে কাউকে গ্রেপ্তার করলে আইন অনুযায়ী তাঁকে আদালতে উপস্থাপন করে। তা ছাড়া কেউ যদি কখনো অপহরণের অভিযোগ নিয়ে আসেন, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হয়। (প্রথম আলো)