অপূর্নতা

অপূর্নতা

ন দশ বছরের একটা ছেলের জগৎ না বড়দের না ছোটদের। ওকে সময় দাও।
শরিফ জানে তার মা বরাবরই দোষারোপ করতে পছন্দ করেন, আজও হয়তো সেই চেষ্টাই করবেন।
তাই ঠান্ডা গলায় বললো, কিন্তু আম্মা এই বয়সতো আমিও পার করেছি।
এরকমতো ভাবনা ছিলোনা আমার। আব্বা আমাদের কত সময় দিতেন?
– কিভাবে থাকবে, তখন আমি ছায়ার মত তোমার পাশে ছিলাম, নিজ হাতে ধরে সব শিখাতাম।
– আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, সব আমার দোষ?
টিনার চিৎকারটা এতই জোরে ছিল যে কাজের মেয়ে ঘরে ঢুকে ওদের দেখে আবার বের হয়ে গেলো।
শ্রাবনের বয়স এবার দশ হবে। ওকে নিয়ে ওর দাদি আর বাবা মা অনর্থক লেগে গেলো।
শ্রাবন সব শুনছিলো চুপচাপ, ওর দোষ হয়েছে একটা রচনা লিখে।
ক্লাসের একটা বিষয় বাংলা, বাংলা রচনার খাতাটা প্যারেন্টস মিটিঙে দাদি দেখেছে। দাদি এসেই ওর বাবা মাকে বলেছে।
শ্রাবনের বাবা শরিফ উদ্দৌলার এই এক রচনা দেখা ছাড়াও অনেক কাজ আছে। আম্মার বাড়াবাড়ি কোনদিনই তার ভাল লাগেনি। আম্মা প্রচন্ড অভিমানী এবং অভিমান বুঝিয়ে দেন খুব সরাসরি।
উনার নাতি এমন আবেগপ্রবণ হবেনাতো কে হবে।
টিনা রাগে গজগজ করতে করতে বললো, আম্মা আপনি ইস্যু বানাচ্ছেন কেন? বোর হচ্ছেন? আর কিছু করার পাচ্ছেননা?
শরিফ টিনাকে ইশারা করে থামিয়ে দিলো।
মুহূর্তেই আম্মার ফর্সা গাল লাল হয়ে গেলো। একটু গলা উঁচু করে বললেন, টিনা প্যারেন্টস মিটিঙে আমাকে আর পাঠিয়োনা। তোমার দায়িত্ব তুমি করো এরপর থেকে।
টিনা রাগে দুঃখে শরীফের দিকে তাকালো।
এই প্যারেন্টস মিটিঙ হয়েছে সকাল নটায়। আগেরদিন শরিফের অফিসের পার্টি ছিল। লেট্ নাইটে বাড়ি ফিরে সকালে যাওয়া সম্ভব হবেনা দেখে শরিফই মাকে অনুরোধ করেছিল। এখন উনি সব ভুলে গেলেন?
শরিফ এবার অধিবেশন শেষ করার উদ্যোগ নিলো। আম্মা শ্রাবণকে আমরা আমাদের সাধ্যমতো সময় দেই। আমাদের বন্ধুবান্ধবদের বাচ্চাও বড় হচ্ছে, এরকম ছোট খাটো ব্যাপার নিয়ে মিটিং করার কিছু নেই। দেখি এবার ছুটিতে ওকে ওর পছন্দমত কোথাও ঘুরাতে নিয়ে যাবো।
টিনা তুমি দু একদিন ওর স্কুলে গেলেওতো পারো।
শরিফ ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
টিনা শ্রাবণকে ঘুমাতে যাবার নির্দেশ দিয়ে রুমে ঢুকে সুটকেস নিলো।
– কি ব্যাপার এতো রাতে সুটকেস কেন?
– আমি এখানে থাকবোনা।
– কেন?
– তোমার ছেলের দায়িত্ব পালন করতে পারছিনা তাই।
– ছেলেটা তোমারও।
– না ছেলে তোমার আর তোমার মায়ের।
– টিনা আমি বাসায় আসি শান্তির জন্য আর তোমরা সবকিছুতে বাড়াবাড়ি করো।
টিনা আর কথা না বাড়িয়ে ছেলের রুমে গেলো। কোথায় কমতি হচ্ছে তাতো বুঝতে হবে।
– শ্রাবন ঘুমাচ্ছো?
শ্রাবন বেড সাইড লাইট জ্বালিয়ে উঠে বসলো।
– টিনা ইতস্তত করে বলেই ফেললো, শ্রাবন তোমার ড্যাডির ফ্যাক্টরিতে কি বানায়?
– মেডিসিন মামনি।
– মেডিসিন বানানো কত ভালো কাজ তুমি জানো? ড্যাডি মেডিসিন না বানালে মানুষ অসুস্থ হলে ঔষুধ কোথায় পাবে? এজন্য বড় হলে তুমিও বানাবে।
– কিন্তু আমি বড় হলে অন্য কাউকে মেডিসিন বানাতে দিবো, আমি ড্যাডির ফ্যাক্টরি চালাবোনা।
– কেন শ্রাবন? কি পেয়েছো তুমি ঐ কবির ল্যাংড়ার দোকানে?
– মামনি উনার দোকানে কতদিন আমি উনাদের মেয়েকে উনার কোলে দেখেছি জানো?
– কতদিন!
– যতদিন উনার মেয়েকে দোকানে দেখেছি ততদিন।
– তোমাকে ছোটবেলায় আমরা কোলে নেইনি?
– আমাকে সার্ভেন্টসরা কোলে নিতো মামনি। তোমরা বেশি নিতে না।
– শ্রাবন তোমার দাদি তোমাকে স্লো পয়জনিং করছে, ল্যাংড়া কবিরের ফুলের দোকানে তোমাকে ইচ্ছা করে নিয়ে যায় যাতে তুমি আমাকে আর পছন্দ না করো।
– মামনি দাদু কখনো কারো নামে নালিশ করেনা। আমি নিজেই কবির আঙ্কেলদের লাইক করি।
– আমি এখনো বুঝতে পারছিনা শ্রাবন তোমার মনের ভিতর কি চলছে।
– মামনি সরি এই নিয়ে এতো কিছু হলো, আমি এতোকিছু ভাবিনি, আমি যতবার ওদের দোকানে গেছি উনাকে হাসতে দেখেছি।
উনারতো পা নেই তাই আন্টি উনাদের মেয়েকে স্কুলে আনা নেয়া করে। মাঝে মাঝে কাগজের বক্সে বিরিয়ানি খায় উনারা, আন্টিটা এতো মোটা তবুও আংকেল কোনদিন উনাকে খেতে মানা করেননা। উনারা কি মজা করে যে খায়, আমারও খেতে ইচ্ছা করে।
– আমরা তোমাকে বিরিয়ানি খাওয়াইনা?
– হ্যা খাওয়াতো, কিন্তু আমার সাথে বসে তুমি সবসময় স্যাড হয়ে খাও।
– এর মানে কি?
– যখনি এক সাথে খেতে বসি ড্যাডি বলে এটা খেওনা, সেটা খেওনা মোটা হয়ে যাবে। আর তুমি পিসফুলি খেতে পারোনা।
– ড্যাডি জোক করে বলে শ্রাবন।
– মামনি তুমি সবসময় ড্যাডিকে ভয় পাও। দাদুও ড্যাডিকে ভয় পায়। তুমি জিমের জন্য কোনদিন স্কুল থেকে নিতে আসোনা আমাকে।
– শ্রাবন মানুষ ফিট থাকার জন্য জিম করে।
– কিন্তু আমাদের মিস বলেছে ফিট থাকতে হলে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠতে হয়।
– এজন্য এখন আমাকে তুমি লাইক করোনা? কবির আংকলের মেয়ের কি তোমার মতো দামি গাড়ি আছে না এতো দামি টিফিন নেয়?
– বাট মামনি ওই মেয়েটা ওর বাবার মত অনেক হাসিখুশি থাকে, আমার ক্লাসের বেশিরভাগ ফ্রেন্ডস ওদের মত হাসিখুশি না।
– তোমাদের বাবা মা সব দেনতো তাই মূল্য বুঝোনা।
– সব দিয়োনা মামনি, সব পেলে বাচ্চারা ফ্রাস্টেটেড হয়ে যায়।
– এতো কিছু বুঝতে শিখেছো?
– না মামনি আমাদের সাইন্স মিস বলেছে।
– টিনা অবাক হয়ে বললো তাই বলে অপূর্ন জীবন তোমাকে এট্রাক্ট করে?
– মামনি কি বলছো?
– কিছুনা, এখন বলতো তুমি সত্যি কি হতে চাও বড় হয়ে?
– আমি বড় হয়ে ফুলের দোকান দিবো, আর কবির আঙ্কেলের মত হ্যাপি লাইফ হবে আমার।
– এজন্য রচনায় লিখেছো বড় হয়ে তুমি ল্যাংড়া কবিরের মতো হতে চাও?
– হ্যা। কবির আংকেল কাউকে স্কেয়ার করেনা।
– আচ্ছা এখন ঘুমাও শ্রাবন।
টিনা বুঝতে দিলোনা ওর আর কথা বলার শক্তি নেই, চোখ ভিজে আসছে বারবার।
স্বামী, সন্তান আর স্বাচ্ছন্দ নিয়েও এতটা অসহায়বোধ করলে কোন পথে হাটবে মানুষ?
টিনার হঠাৎ মনে পড়লো ওর বাবার বাড়িতে মা লেগে থাকতো ওকে খাওয়ানোর জন্য। এ বাড়িতে এসে শরীফ যেদিন প্রথম বলেছিলো ডাইনিং টেবিলে যে টিনা তুমি এতো খেতে পারো? দেখো তোমার ভুঁড়ি বের হয়ে যাচ্ছে। সেদিনও লজ্জায় চোখ ভিজে আসছিলো। কি এক অজানা অপরাধবোধ কাজ করছিলো আজকের মতোই।

শারমিন সারা